তামাক আমাদের দেশে খুব পরিচিত একটি পদার্থ যা নিয়মিত গ্রহণে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। আমাদের দেশে নেশা জাতীয় পণ্যের মধ্যে হরহামেশাই দেখা যায় বিড়ি, সিগারেট, পানের সাথে জর্দা ইত্যাদি। ধূমপান করার কোনো শ্রেণি নেই। একেবারে দরিদ্র থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত সবার মধ্যেই ধূমপায়ী খুঁজে পাওয়া যাবে। রাস্তাঘাটে, বাসে, চা’র দোকানে, পার্কে, অফিসে সবস্থানেই ধূমপায়ী ধূমপান করছে। ধূমপান ধূমপানই। ক্ষতি তো ক্ষতিই। ধূমপান করার অর্থ হলো এক ধরনের বিষ পান। আশ্চর্য বিষয় হলো এই সত্য জেনেই পৃথিবীতে বহু মানুষ ধূমপায়ী। তারা প্রকাশ্যে এবং বেশ তৃপ্তির সাথেই ধূমপান করে। নিজের ক্ষতি নিজে করার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কি হতে পারে! চোখের সামনে প্রাপ্ত এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষকেই এসব নেশা জাতীয় পদার্থ গ্রহণ করতে দেখা যায়। এসবের মূল উপাদান হলো তামাক। আজ আমরা সবাই জানি যে তামাক একটি ক্ষতিকর পদার্থ। মানব শরীরের কঠিন রোগের উৎস এই তামাক। তথ্যে দেখা যায়, তামাক মূলত হৃৎপিন্ড, লিভার ও ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। ধূমপানের ফলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রেস, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ ও ক্যান্সার এর ঝুঁকি বহুগুণে বৃদ্ধি করে। তামাক গ্রহণের প্রচলিত পদ্ধতি হলো বিড়ি, সিগারেট বা জর্দা। আপনি ধূমপান না করলেও আপনি তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন না। কারণ হয়তো যার পাশে আপনি বসে আছেন তিনি নিশ্চিন্তে সিগারেট টানছেন। তিনি নিজেও জানেন যে ক্ষতি তিনি নিজের ও আপনার ক্ষতি করছেন আবার আপনিও বুঝতে পারছেন। কিন্তু আপনার কিছু করার নেই। যার করার আছে সেই ধূমপায়ী ব্যক্তিটি জেনেও কিছু করবে না। খুব কম ক্ষেত্রেই আপনি অসুবিধা হচ্ছে বলার পর হাতের জলন্ত সিগারেটটি ফেলে দেয়। আবার উল্টোটাও ঘটে। তিনি রেগে যান। নানা বাক্যবাণে বিদ্ধ করে। এসব ভেবেচিন্তে অনেকেই কিছু বলতে যান না। আপনি তখন একজন নিষ্ক্রিয় ধূমপায়ী। প্রতিদিন নিস্ক্রিয় ধূমপায়ীর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। এর মধ্যে কিন্তু আপনার-আমার শিশু সন্তানও রয়েছে যে আদৌ জানে না যে তার ফুসফুসের ক্ষতি কেন হচ্ছে। আগামী বাজেটে তামাক পণ্যের উপর কার্যকর কর ও মূল্যবৃদ্ধির দাবি উঠেছে। এর আগেও বিড়ি, সিগারেটের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার কমানো যায়নি। এই মূল্য আরও বৃদ্ধি করলেও যে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে এর গ্যারান্টিও দেওয়া যাবে না।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ (GATS, ২০১৭) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী ২ কোটি ২০ লক্ষ (২০.৬%) এবং ধূমপায়ী ১ কোটি ৯২ লক্ষ (১৮%)। বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯.২ শতাংশ (এঝঐঝ, ২০১৪), যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।’ তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ অকালে মৃত্যু বরণ করে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ: এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী পরোক্ষ ধূমপানের কারণে পৃথিবীতে বছরে ১৩ লক্ষ মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তামাকপণ্যের ধোঁয়ায় আক্রান্ত হওয়ার নিরাপদ কোনো মাত্রা নেই। তামাকের ধোয়াঁয় রয়েছে ৭,০০০টি রাসায়নিক পদার্থ যার মধ্যে ৭০টি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী। ফুসফুস ক্যান্সার, স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ পরোক্ষ ধূমপান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়া কোন ব্যক্তির মারাত্মক করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি একজন ধূমপায়ীর মতোই।’
গ্লোব্যাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে আচ্ছাদিত কর্মস্থলে কাজ করেন এমন প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠির ৪২.৭ শতাংশ (৮১ লক্ষ) পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। প্রায় ২৪ শতাংশ (২ কোটি ৫০ লক্ষ) প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ গণপরিবহনে যাতায়াতের সময়, ১৪.৭ শতাংশ রেস্তোরাঁয় এবং ৩৬.২ শতাংশ চা-কফির স্টলে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো প্রায় ৩৯ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ (৪ কোটি ৮ লক্ষ) বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। প্রতিবছর প্রায় ৬১,০০০ শিশু পরোক্ষ ধূমপানজনিত বিভিন্ন অসুখে ভোগে।”বিশ্বে প্রতিবছর ৮০ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় তামাক। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তামাকজনিত ক্ষতির পরিমাণ বছরে ১.৪ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার।
Tobaco Atlas-2018 অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে ১ লক্ষ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ তামাক জনিত রোগে অকালে মৃত্যুবরণ করে। Global Adult Tobacco Survey 2017 অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৫ বছর তদুর্ধ বয়সীদের ৩ কোটি ৭৮ লাখ (৩৫.৩%) মানুষ নানা উপায়ে তামাক ব্যবহার করে। এর মধ্যে ১ কোটি ৯২ লাখ মানুষ বা ১৮% জনগোষ্ঠী ধূমপান করে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল বিশ্বে এবং অনুন্নত দেশগুলোতে তামাক শুধু রোগ সৃষ্টি বা মৃত্যুর পেছনেই কারণ হচ্ছে না বরং তা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সমস্যার কারণ হয়েও দাড়াচ্ছে। দেখা যায় যে ধূমপানের নেশা অতি দরিদ্র থেকে শুরু করে ধনীক শ্রেণির মধ্যে রয়েছে। যে কোনোভাবে দিনে তার বিড়ি সিগারেটের নেশা পূরণ করবেই। এতে একদিনে যেমন আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ চলে যায় তামাকের পেছনে আবার অন্যদিকে এর ফলে সে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আয়ের একটি বড় অংশই খরচ হচ্ছে চিকিৎসার পেছনে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রসমূহ ১৯৮৭ সালে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস চালু করে। কিন্তু ত্রিশ বছরের বেশি সময়েও তামাক জাতীয় পদার্থ ব্যবহার কমছে না। উইকিপিডিয়ার তথ্যে জানা যায়, সিগারেটে ৫৭টি মারাত্বক রাসায়নিক উপাদানের সন্ধান পাওয়া গেছে যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এদের মধ্যে অন্যতম ক্ষতিকারক উপাদান হলো নিকোটিন। যা আজ আমরা এক ধরনের বিষ হিসেবেই জানি। গবেষণায় দেখা যায়, দুটি সিগারেটে যে পরিমাণ নিকোটিন আছে তা যদি একটি সুস্থ মানুষ এর দেহে ইঞ্জেক্ট করে দেয় তাহলে সেই মানুষটি তখনি মারা যাবে।
বাংলাদেশে প্রচলিত ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ এর ৪ ধারা অনুযায়ী প্রকাশ্যে ধূমপানের ফলে জরিমানা হিসেবে প্রথমবার অনধিক ৩০০ টাকা এবং দ্বিতীয় বা পরবর্তী প্রতিবারের জন্য দ্বিগুণ টাকা দিতে হয়। এছাড়া ১০ ধারা অনুযায়ী, সিগারেট, বিড়ি ইত্যাদি তামাকজাতীয় দ্রব্যের মোড়কে ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিংবা ধূমপান হৃদরোগের কারণ লেখা বাধ্যতামূলক। ধূমপান বা তামাক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং এটি অভ্যাসে মারাত্বক সব রোগের ঝুঁকিতে পরতে পারে এটা প্রায় সবাই জানে বা বোঝে। কিন্তু এতকিছু জানার পরেও কিন্তু তা গ্রহণ করছে। সুতরাং এই অভ্যাস ছাড়তে হবে বা ত্যাগ করতে হবে। এতে একদিকে যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হবে এবং অন্যদিকে আর্থিকভাবে লাভবান হবে অর্থাৎ মাস শেষে কিছু অর্থ সাশ্রয় হবে। তামাকের ব্যবহার থেকে বের হয়ে আসার প্রধান উপায় হলো নিজেকে তামাক জাতীয় পদার্থ গ্রহণের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে এবং অন্যকেও তামাক গ্রহণে নিরুৎসাহিত করতে হবে। যদিও নিজে এ ধরনের দীর্ঘদিনের অভ্যাস ছেড়ে দেওয়া সহজ কথা নয়। তবে মানুষ ইচ্ছা করলে সবকিছু করতে পারে- এই সত্যের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। তামাক আমাদের স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতির ক্ষতিসাধন করছে। একটি পরিবারের উন্নতিতে বাধা হিসেবে কাজ করছে তামাক। সুতরাং এটা পরিহার করতে হবে। পরিবার থেকেই তামাক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা যায়। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, পাকিস্থান সহ বিশ্বেও ১০৯ টি দেশ সিঙ্গেল সিগারেট স্টিক বা ছোটো প্যাকেট বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। শ্রীলংকায় সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রয় নিষিদ্ধ করার উদ্যোগটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বিড়ি-সিগারেটে খুচরা বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে। বিশেষভাবে উঠতি বয়সী শিশু-কিশোরদের দিকে অভিভাবকরা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কোনো বন্ধুর পাল্লায় পরে আপনার সন্তানও কৌতুহলবশতঃ বিড়ি, সিগারেট ধরতে পারে। সেখান থেকে প্রথমেই তাকে ফেরানো যাবে। ব্যাপকভাবে তামাকের ক্ষতিকারক দিক নিয়ে প্রচারণা চালাতে হবে। তামাকের মারাত্মক স্বাস্থ্য ক্ষতি থেকে জনস্বাস্থ্যকে সুরক্ষার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশ শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করছে। বিশেষত, শিশু-কিশোরদের তামাকপণ্যের ছোবল থেকে রক্ষায় অনেক দেশ তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচার বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে তামাক কোম্পানিও বসে নেই। বিজ্ঞাপন প্রচারের অন্যতম কৌশল হিসেবে তারা তামাকপণ্যের প্যাকেটকে বেছে নিয়েছে। আকর্ষণীয় ডিজাইন, রং এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য সম্বলিত প্যাকেট তৈরি করে তরুণদের তামাকপণ্যে আকৃষ্ট করার কাজ অব্যাহত রেখেছে। এভাবেই একদিন এই দেশ তামাকমুক্ত হবে। সুস্বাস্থ্য এবং সুন্দর সমাজ গঠনে তামাক থেকে দূরে থাকতে হবে এবং রাখতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট