ঈদুল আজহা মানেই বাঁধভাঙা আনন্দ আর প্রিয়জনের সান্নিধ্যে ফেরার উৎসব। কিন্তু এই আনন্দের সাথে প্রায়শই জুড়ে থাকে বাড়ি ফেরার এক পরিচিত ভোগান্তি আর অস্থিরতা। যখন সারাদেশ উৎসবের আমেজে মেতে ওঠার প্রস্তুতি নেয়, তখন ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যায় অগণিত মানুষ। রেলস্টেশনে দীর্ঘ সারি, বাস কাউন্টারে ভোরের ভিড় কিংবা লঞ্চঘাটের অব্যবস্থাপনা—এসব চিত্র আমাদের দীর্ঘদিনের চেনা। তবে আশার কথা হলো, গত এক দশকে তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় বিস্তার এই ভোগান্তিকে অনেকটাই কমিয়ে এনেছে। তাই এবারের ঈদযাত্রা আরও স্বস্তিদায়ক হবে, এমন প্রত্যাশা নিয়েই অনলাইন টিকেটিংয়ের অগ্রযাত্রার গল্প আজ উন্মোচন করা যাক।
দেড় দশক আগের কথা ভাবলেই চোখে ভাসে টিকেটের জন্য সীমাহীন দুর্ভোগের চিত্র। ঈদে বাড়ি ফেরার টিকিট যেন ছিল সোনার হরিণ। রাত জেগে কমলাপুর রেলস্টেশন বা বাস কাউন্টারে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ছিল নিয়মিত ঘটনা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, রোদ-বৃষ্টির ভ্রুকুটি আর ধৈর্যের চরম পরীক্ষায় ক্লান্ত হতো শরীর ও মন। এতকিছুর পরেও টিকিট জুটবে কিনা, তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। ফলস্বরূপ, অনেকেই বাধ্য হতেন ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে ট্রাক, পিকআপ ভ্যান বা মোটরসাইকেলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে, যা প্রায়শই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কারণ হতো।
আকাশপথে যাত্রাও খুব একটা সুখকর ছিল না। বিমানের টিকিট কাটার প্রক্রিয়া ছিল বেশ জটিল। বিভিন্ন এজেন্সির দপ্তরে যাওয়া, ফর্ম পূরণ করা এবং ব্যাংকে ছোটাছুটি করা ছিল এক সাধারণ ব্যাপার। অনেক সময় দীর্ঘসূত্রিতার কারণে টিকিট ফুরিয়ে যাওয়ায় ভেস্তে যেত বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা।
এই অচলায়তন ভাঙতে শুরু করে তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ বিমান এবং ২০১২ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ে তাদের টিকিট ব্যবস্থা অনলাইনে নিয়ে আসে। এই দুটি পদক্ষেপ ছিল দেশের পরিবহন খাতে ডিজিটালাইজেশনের পথে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। যদিও শুরুতে ইন্টারনেটের ধীরগতি, অনলাইন লেনদেনের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের পরিচিতি কম থাকায় এর ব্যবহার সীমিত ছিল।
তবে সময়ের সাথে সাথে উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এবং মোবাইল পেমেন্ট সিস্টেমের ব্যাপক প্রসারের ফলে এই বাধাগুলো অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছে। বিকাশ, রকেট এবং অন্যান্য ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে ঘরে বসেই সহজে টিকিট কেনার সুবিধা মানুষকে জটিলতা থেকে মুক্তি দিয়েছে, খুলে দিয়েছে এক নতুন দিগন্ত।
এবারের ঈদুল আজহা উপলক্ষে বাংলাদেশ রেলওয়ে গত ২৪ মে থেকে অনলাইনে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু করেছে। সুপরিচিত ‘রেলসেবা’ ওয়েবসাইট ও অ্যাপের মাধ্যমে যাত্রীরা কোনো রকম লাইনে না দাঁড়িয়ে, ঘরে বসেই সকাল ৮টা থেকে তাদের কাঙ্ক্ষিত আসনের তথ্য পাচ্ছেন এবং টিকিট সংগ্রহ করতে পারছেন। প্রথম দিনই এর প্রমাণ মিলেছে: সকাল ৯টা পর্যন্ত মাত্র এক ঘণ্টায় ১৫ হাজার ৬৫৮টি টিকিট বিক্রি হয় এবং সারাদেশে বরাদ্দকৃত ১ লাখ ৮০ হাজার ৩৫৫টি টিকিটের মধ্যে সকাল নাগাদ বিক্রি হয় ১৯ হাজার ৮৬৭টি। ওয়েবসাইটে ১ কোটি ১৪ লাখ হিট প্রমাণ করে অনলাইন টিকেটিংয়ের চাহিদা ও গুরুত্ব কতটা বেড়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ৩ জুনের যাত্রার জন্য ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রামসহ পূর্বাঞ্চলের ২৩টি ট্রেনে ১৬ হাজার ৭৬টি আসন এবং পশ্চিমাঞ্চলের ২০টি ট্রেনে ১৬ হাজার ৭৬৫টি টিকিট বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই সহজলভ্যতা নিঃসন্দেহে যাত্রীদের প্রাথমিক ভোগান্তি কমিয়ে এনেছে, কারণ অপেক্ষার প্রহর গোনার পরিবর্তে টিকিট নিশ্চিত করার স্বস্তি এখন হাতের মুঠোয়।
শুধু বাংলাদেশ রেলওয়েই নয়, বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও অনলাইন টিকেটিং সেবাকে আরও সহজলভ্য করে তুলেছে। ২০১৪ সাল থেকে ‘সহজ’ নামক একটি প্ল্যাটফর্ম বাস, ট্রেন, লঞ্চ এবং বিমানের টিকিট এককভাবে সরবরাহ করে আসছে। ২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করা ‘গোজায়ান’ বিমান টিকিটের পাশাপাশি হোটেল বুকিং, ট্যুর প্যাকেজ এবং ভিসা প্রসেসিং সেবাও দিচ্ছে। ‘শেয়ার ট্রিপ’ ২০১৪ সাল থেকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের টিকিট বুকিং প্রক্রিয়াকে করেছে আরও মসৃণ। এছাড়া ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’, ‘বিডিটিকিটস’, ‘বাইটিকিটস’, ‘যাত্রী’, ‘পরিবহন.কম’-এর মতো আরও অনেক প্ল্যাটফর্ম ঘরে বসেই সব ধরনের পরিবহনের টিকিট নিশ্চিত করার সুযোগ করে দিয়েছে।
প্রযুক্তি এবং তথ্যই আজকের দিনের সবচেয়ে বড় শক্তি। কিন্তু এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সঠিক জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা না থাকলে বিভ্রান্তি ও অহেতুক ভীতি কাজ করতে পারে। তাই অনলাইন টিকেটিংয়ের সুবিধা পুরোপুরিভাবে ভোগ করতে হলে এর ব্যবহারবিধি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা অপরিহার্য।
অনলাইন টিকেটিং ব্যবস্থা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলেও কিছু চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। দেশের সব প্রান্তে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, এখনও অনেকের কাছে ইন্টারনেট বা স্মার্টফোনের সুবিধা সহজলভ্য নয়। ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতি নিয়েও কারও কারও মধ্যে অহেতুক শঙ্কা কাজ করে। এই ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর্মশালা আয়োজন এবং সহজবোধ্য শিক্ষামূলক ভিডিও তৈরি করা জরুরি। পাশাপাশি, টিকিট কালোবাজারি, প্রতারণা ও বিভ্রান্তি রোধে একটি শক্তিশালী তদারকি কর্তৃপক্ষ থাকা প্রয়োজন, যেখানে যাত্রীরা অভিযোগ জানাতে পারবেন এবং দ্রুত প্রতিকার পাবেন।
অন্যদিকে, সফটওয়্যারের গুণগত মান, সার্ভারের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঈদ বা অন্যান্য উৎসবের সময় যখন টিকিটের চাহিদা তুঙ্গে থাকে, তখন যেন ওয়েবসাইট বা অ্যাপ ক্র্যাশের শিকার না হয় এবং যাত্রীদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা যেন সুরক্ষিত থাকে, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগ, বেসরকারি খাতের সহযোগিতা এবং সর্বোপরি যাত্রী ও গ্রাহকদের সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজন।
অনলাইন টিকেটিংয়ের অগ্রযাত্রা কেবল টিকিট বিক্রির একটি আধুনিক ব্যবস্থা নয়, এটি সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস, যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি যাত্রার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির সঙ্গেও জড়িত। তথ্যের সঠিক ব্যবহার এবং প্রযুক্তির সেতুবন্ধন আমাদের ঈদযাত্রাকে করতে পারে ভোগান্তিমুক্ত ও আনন্দময়।
সকল অংশীজনের আন্তরিক প্রচেষ্টা, কার্যকর কর্মসূচি এবং যাত্রীদের সচেতনতাই পারে একটি স্বপ্নের পূর্ণতা দিতে: ঘরে ফেরা হবে স্বাচ্ছন্দ্যে আর নিরাপদে। ঈদের আনন্দ হবে পরিপূর্ণ, ভোগান্তি নেমে আসবে সর্বনিম্নে। অনলাইন টিকেটিংয়ের পরবর্তী অধ্যায় উন্মোচিত হোক আরও উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ছোঁয়ায়, যা আমাদের প্রতিটি ঈদযাত্রাকে করে তুলবে আরও সুন্দর ও নিরাপদ।
লেখক: শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়