Thursday 05 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চট্টগ্রামের খাল-নালার বেহাল দশা: বর্ষা আসার আগেই বিপদের বার্তা

সুমন বৈদ্য
৩ জুন ২০২৫ ১৯:১২

চট্টগ্রাম — পাহাড় ও সমুদ্রবেষ্টিত এক অপরূপ শহর, প্রকৃতির অনন্য সৌন্দর্যের এক নিদর্শন। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানা হিসেবে এর গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, তেমনি এর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যও অভূতপূর্ব। তবে দুঃখজনকভাবে, এই নৈসর্গিক নগরীর সৌন্দর্য ও নাগরিক জীবন আজ হুমকির মুখে পড়েছে অব্যবস্থাপনা ও অযত্নে পড়ে থাকা খাল-নালার কারণে।

বছর ঘুরে আবারো বর্ষা আসন্ন। কিন্তু তার আগেই চট্টগ্রামের জনজীবনে উদ্বেগের ছায়া নেমে এসেছে। কারণ সুস্পষ্ট—শহরের খাল, ড্রেন ও নালাগুলো ভরাট হয়ে গেছে ময়লা, মাটি ও দখলের কারণে। প্রায় প্রতিটি মৌসুমেই দেখা যায়, একটু ভারী বৃষ্টি হলেই রাস্তাঘাট ডুবে যায়, বাসা-বাড়িতে পানি উঠে যায়, ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হয় এবং জনজীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ।

বিজ্ঞাপন

অথচ এই শহরে এক সময় ৪৫টিরও বেশি প্রাকৃতিক খাল ছিল, যেগুলোর মাধ্যমে পানি দ্রুতই নদীতে চলে যেত। আজ সেই খালগুলো অধিকাংশই দখল, ভরাট ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মৃতপ্রায়। নানা উন্নয়ন প্রকল্প ও বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও বাস্তবায়নের ধীরগতি এবং সমন্বয়হীনতা চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বর্ষাকাল আসলেই নগরীর বেশিরভাগ সড়ক, অলিগলি ও নিচু এলাকাগুলো জলমগ্ন হয়ে পড়ে। সামান্য বৃষ্টিতেই বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল, স্থবির হয়ে পড়ে নাগরিক জীবন। অফিসগামী মানুষ, স্কুলগামী শিক্ষার্থী, এমনকি রোগী পরিবহনে সমস্যায় পড়ে অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত। বৃষ্টির জল আর নোংরা পয়ঃবর্জ্যের মিশ্রণে তৈরি হয় জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি—যা ডেঙ্গু, টাইফয়েড, পানিবাহিত নানা রোগ ছড়ানোর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বছরের পর বছর নানা ধরণের প্রকল্পের উদ্যোগে নিয়ে থাকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। কিন্তু সেই প্রকল্পের ছিটেফোঁটা যেনো কোনো কাজে আসছে না চট্টগ্রাম জলাবদ্ধতার উন্নয়নে। উল্টো বছরের পর বছর বাড়তেই থাকে এই জলাবদ্ধতার কারণে মৃত্যুর মিছিল। খাল-নালার গুলো অপরিচ্ছন্ন এবং পরিচর্যার অভাবে চট্টগ্রামের খাল-নালা যেনো সাধারণ জনগণদের মধ্যে মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছে। খাল-নালার অপরিচ্ছন্নতার ভয়াবহ থেকেই যে জলাবদ্ধতার আবির্ভাব হয় তার একটি ভয়াবহ পরিসংখ্যানের দিকে চোখ বুলানো যাক। গত ছয় বছরে নগরে খাল-নালায় পড়ে অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ২ জন, ২০২১ সালে ৫, ২০২৩ সালে ৩, ২০২৪ সালে ৩ ও চলতি বছর ১ জন।

২০২১ সালের ৩০ জুন মেয়র গলি এলাকায় চশমা খালে পড়ে অটোরিকশাচালক ও এক যাত্রীর মৃত্যু হয়। ওই বছরের ২৫ আগস্ট নগরের মুরাদপুরে চশমা খালে পা পিছলে পড়ে তলিয়ে যান এক সবজি বিক্রেতা , তাঁর মরদেহ এখনো পাওয়া যায়নি। এরপর ৬ ডিসেম্বর একই খালে তলিয়ে যায় এক শিশু। তিন দিন পর নগরের মির্জা খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর নগরের আগ্রাবাদের মাজারগেট এলাকায় ফুটপাত থেকে পা পিছলে নালায় পড়ে মৃত্যু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর।

২০২২ সালে খাল-নালায় পড়ে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে চট্টগ্রাম নগরের উত্তর আগ্রাবাদের রঙ্গীপাড়া এলাকার একটি নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় দেড় বছরের শিশু। ১৬ ঘণ্টা পর নালার আবর্জনার নিচ থেকে শিশুটির নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়। এর আগে ৭ আগস্ট চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ফতেহপুর ইসলামি হাটসংলগ্ন বাদামতলা এলাকার নালায় পড়ে মৃত্যু হয় কলেজছাত্রীর। এ ছাড়া ১ সেপ্টেম্বর বাদশা মিয়া ব্রিকফিল্ড এলাকায় খালে পড়ে নিখোঁজ হয় শিশুর। শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয় সিডিএ আবাসিক এলাকার খাল থেকে।

২০২৪ সালের ২৭ মে আছদগঞ্জের কলাবাগিচা খালে পড়ে মৃত্যু হয় এক পথচারীর । ১১ জুন বিকেলে চাক্তাই খালের স্লুইসগেট-সংলগ্ন এলাকায় নিখোঁজ হয় অজ্ঞাতনামা এক শিশু। প্রায় ১৪ ঘণ্টা পর তার লাশ পাওয়া যায় পাশের রাজাখালী খালে। একই বছর ৯ জুন আগ্রাবাদ এলাকার নাসির খালে পড়ে মারা যায় সাইদুল ইসলাম নামের সাত বছর বয়সী এক শিশু।

আর ২০২৫ সালেও নিখোঁজ হয় আরো একটি শিশু| নিখোঁজ হওয়ার ১৪ ঘণ্টা পর গতকাল শনিবার সকাল ১০টার দিকে নগরের চাক্তাই খাল থেকে উদ্ধার করা হয় নিখোঁজ থাকা শিশুর নিথর দেহ। আগের দিন শুক্রবার রাত আটটার দিকে কাপাসগোলার হিজড়া খালে তলিয়ে যায় সে। এরপর শুরু হয় ‘উদ্ধারযজ্ঞ’। সিটি করপোরেশনের টনক নড়ে। সরে যায় খালে জমে থাকা ময়লার স্তূপ। ডুবুরিরা তল্লাশি চালান। পরবর্তী সময়ে প্রায় চার কিলোমিটার দূরের চাক্তাই খালে ভেসে ওঠে মরদেহ। স্থানীয় এক ব্যক্তি উদ্ধার করে ডাঙায় তোলেন।

এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। আর প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সঠিক না হওয়ার কারণ জলাশয় ভরাট করা থেকে শুরু করে ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা অমান্য করে প্রকল্প বাস্তবায়ন, সেইসাথে দুর্বল বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। শুধু এখনই না, গত দুই দশক ধরে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের জন্য দূর্ভোগের অপর নাম যেনো বর্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অল্প বৃষ্টিতেই যেনো চট্টগ্রাম শহরের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা যেনো শেষ হওয়ার কোনো সুরাহা তৈরি হচ্ছে না।

চসিক, সিডিএ, ওয়াসা, ও পাউবো জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে ব্যয়ে ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ করেছে ১৪ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। কিন্তু এত এত টাকা খরচ করেও জলাবদ্ধতার উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি। উল্টো অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা বড় রূপ নিয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এ অবস্থায় সংস্থাগুলো পরস্পরকে দায়ী করছে। কী কারণে চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা হচ্ছে? একটু পিছনের ইতিহাসের দিকে চোখ বুলানো যাক।

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার সেই কারণ বের করতে ২০২২ সালে চার সদস্য নিয়ে ‘জলাবদ্ধতার কারণ অনুসন্ধান কমিটি’ গঠন করা হয়। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসকে প্রধান করে এই কমিটি পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু দুই বছর পেরিয়ে গেলেও সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়নি।গত এক দশকে চট্টগ্রাম নগরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ- এ ছয়টি রাষ্ট্রীয় সংস্থার প্রতিটির নিজস্ব মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে। এসব সংস্থা নিজেদের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছাড়াই স্বাধীনভাবে কাজ করে। যা জলাবদ্ধতা নিরসনে অন্যতম বাঁধা।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ- এ ছয়টি রাষ্ট্রীয় সংস্থার প্রতিটির নিজস্ব মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে। এসব সংস্থা নিজেদের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছাড়াই স্বাধীনভাবে কাজ করে। যা, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন না হওয়ার প্রধান কারণ। জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারমহল হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে। কিন্তু যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এসব মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত ছিল, তা হয়নি। ফলে হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়েছে, যে যার মতো কাজ করে যাচ্ছে। প্রকল্পগুলোর কাজে সমন্বয়হীনতাই এখন প্রধান সমস্যা।’

১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে শহরের প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টার্শিয়ারি ড্রেনেজ ব্যবস্থা সুনির্দিষ্ট করেছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম শহরে মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে আগ্রহ নেই সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর। বরং কিছু ক্ষেত্রে মাস্টারপ্ল্যানের সুপারিশের ঠিক উল্টো প্রকল্প গ্রহণ করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যান সবচেয়ে বেশি অমান্য করছে বড় সংস্থাগুলো। কোটি টাকা খরচ করে মাস্টারপ্ল্যান করে তা অনুসরণ না করার কারণে একদিকে অর্থের অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে পরিকল্পিত নগরী গড়ার পরিবর্তে ‘কংক্রিটের জঙ্গলে’ পরিণত করা হচ্ছে চট্টগ্রামকে।

জলাবদ্ধতা নিরসনে মাস্টারপ্ল্যানে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। নগরীর ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টি খাল সিডিএ জলাবদ্ধতা প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাকি ২১টি খাল খনন করা হচ্ছে না। ৫০০ কিলোমিটার ড্রেনের মধ্যে মেগা প্রকল্পে আছে ৩০২ কিলোমিটার। বাকি ১৯৮ কিলোমিটার প্রকল্পে নেই। এছাড়া পরিকল্পনায় দ্রুত বাড়তে থাকা শহরের পানি নিষ্কাশনের জন্য চারটি নতুন খাল খননের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে একটি খালের নির্মাণকাজ ২০১৪ সালে শুরু হলেও এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু এ খালগুলো হলো প্রাইমারি ড্রেন। সেকেন্ডারি ও টার্শিয়ারি ড্রেনগুলো আগের মতোই পুরোনো এবং জরাজীর্ণ। ফলে বৃষ্টির পানি সরু ও জরাজীর্ণ অভ্যন্তরীণ ড্রেনের মাধ্যমে প্রাথমিক খালে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে।’

তবে আশ্চর্য্য বিষয়হলো সিডিএর ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়েছিল ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট। ওই সময় প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালের জুনেই কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু কিন্তু বর্তমানে এই প্রকল্পের আকার এখন ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। চলতি বছরের ৩০ জুন প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে সংশোধন হয়ে প্রকল্পটির মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের জরিপ অনুসারে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চট্টগ্রাম শহরের গড় উচ্চতা এক মিটারেরও কম। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি এলাকায় এ উচ্চতা দশমিক ২ মিটারেরও কম। বিপরীতে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকায় সমুদ্রের পানির উচ্চতা ০.৫ থেকে ২.৫ মিটার পর্যন্ত বেড়েছে। এসব এলাকা জোয়ারের পানির গড় উচ্চতা ২.৫ থেকে ২.৭৬ মিটার। অতিবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়ের পানির স্তর ২.৫ থেকে ৪.৫ মিটার পর্যন্তও বাড়ে। এছাড়া জোয়ারের কারণে চট্টগ্রাম মহানগরের প্রায় ৬৯ শতাংশ এলাকা বছরের নানা সময়ে কম-বেশি প্লাবিত হচ্ছে।

জলাশয় ভরাটপরিবেশ অধিদপ্তরের ১৯৮১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চট্টগ্রামে প্রায় ২৫ হাজার পুকুর ও জলাশয় ছিল। কিন্তু একটি সমীক্ষা অনুসারে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহরে মাত্র ১ হাজার ২৪৯টি জলাশয় অবশিষ্ট ছিল। অর্থাৎ গত চার দশকে চট্টগ্রামের প্রায় ২৪ হাজার জলাশয় নাই হয়ে গেছে।অথচ চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে এবং তারপর ভূগর্ভে পুনরায় পানির সংস্থান করতে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ খোলা জায়গা থাকা দরকার। কিন্তু শহরের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য সিডিএ আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে প্রায় সব খোলা জায়গা ব্যবহার করেছে।চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্য মতে, আগ্রাবাদ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২০১১ সালে ২৪১ ফুট থেকে ২০২১ সালে ৩১২ ফুটে নেমে আসে। শহরের পাহাড়তলী এলাকায় ২০১১ সালে ১৩৬ ফুট থেকে ২০২১ সালে ২৭৪.৬ ফুটে নেমে আসে। খুলশী এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২০১১ সালে ভূপৃষ্ঠের ২২০ ফুট নিচে ছিল, যা ২০২১ সালে ৩৪৫ ফুটে নেমে আসে। বায়েজিদ এলাকায় তা ২০১১ সালে ছিল ১৫৫ ফুট এবং ২০২১ সালে ১৯৮ ফুটে নেমে আসে।

আরেকটি হলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চট্টগ্রাম নগরে প্রতিদিন তিন হাজার টন কঠিন বর্জ্য তৈরি হয়। যা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সূত্র মোতাবেক দৈনিকভিত্তিতে মাত্র দুই হাজার টন বর্জ্য অপসারণ করতে পারে। কিন্তু বাকি এক হাজার টন বর্জ্য ফেলে দেওয়া হয় ড্রেন ও খালে। যা জলাবদ্ধতার আরেকটি কারণ।

পাহাড়, সমুদ্র ও নদী দিয়ে ঘেরা চট্টগ্রামের নগর–পরিকল্পনায় প্রতিটি সড়কের সঙ্গেই যুক্ত আছে ছোট–বড় নালা। আর অনেক খাল হারিয়ে গেলেও যেগুলোর অস্তিত্ব এখনো আছে, সেগুলোও বৃষ্টির মৌসুমে হয়ে ওঠে বিপজ্জনক। কিন্তু নগরের বেশির ভাগ নালাই উন্মুক্ত। নালায় স্ল্যাব আর খালগুলোয় নিরাপত্তাবেষ্টনী থাকতে হবে, সেটি যেন গুরুত্বহীন। নালায় বা খালে পড়ে কেউ হতাহত হলেও কারও যেন কিছু যায় আসে না, ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা। যদিও আবার কোথাও কোথাও বসেছে নিরাপত্তাবেষ্টনী, স্ল্যাব। কোথাও খালি পড়ে আছে। আবার মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, চকবাজার, ২ নম্বর গেট, মেয়র গলি, আল ফালাহ গলি, মেহেদিবাগ, নালার ওপর কোথাও স্ল্যাব আছে, কোথাও নেই। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে খাল-নালা রয়েছে ১ হাজার ১৩৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে নিরাপত্তাবেষ্টনী ছাড়া খালের পাড় রয়েছে প্রায় ১৯ কিলোমিটার। উন্মুক্ত নালা রয়েছে ৫ হাজার ৫২৭টি স্থানে। এসবের ১০ শতাংশ নালায়ও নিরাপত্তাবেষ্টনীর কাজ হয়নি।

এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যুরো পরিসংখ্যান (বিবিএস)এর তথ্য মোতাবেক, দুর্যোগসংক্রান্ত ২০১৬-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯-২০১৪ পর্যন্ত জলাবদ্ধতায় বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩১ মিলিয়ন ডলার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে এবং ধারণা করা হয়, এ ক্ষতি না হলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রতি বছর শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি হতো। গত এক দশকে (২০১১-২০২১) জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণ কেন্দ্র খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, আসাদগঞ্জ ও কোরবানীগঞ্জ ২ হাজার ৫১৭ টাকার ক্ষতি হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ী। এছাড়া চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার প্রভাব পড়ে: সড়কে জলাবদ্ধতার পানিতে চলাচল কয়েক ঘণ্টার জন্য সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়; জলাবদ্ধতার কারণে চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রধান সড়ক থেকে গলিপথ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রতি বছর; প্রধান সড়কে পিচ উঠে চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে; রিকশা ও ভ্যান ভাড়া বৃদ্ধি পায়; জলাবদ্ধতার পানিতে চলাচল করে নষ্ট হয় ব্যক্তিগত ও পাবলিক পরিবহন। চট্টগ্রাম মহানগরীতে আগস্ট, ২০২৩-এর জলাবদ্ধতার কারণে চসিকের ১ হাজার ৩০০ কিমি সড়কের মধ্যে ৫০ কিমি সড়ক সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এছাড়া দুই কিমি ফুটপাত ও দুই কিমি ড্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বর্ষাকালে জলাবদ্ধতায় ড্রেনে পড়ে ১১ ব্যক্তির করুণ মৃত্যু হয়।

চট্টগ্রামে পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও পানি নিষ্কাশনের জন্য সমন্বিত কোনো ব্যবস্থা না থাকায়, জলাবদ্ধতা সমস্যা মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্প কর্তৃপক্ষ শহরের ব্রিজ ও কালভার্টের নিচে তিন সেবা সংস্থার (ওয়াসা, বিটিসিএল ও কর্ণফুলী গ্যাস সিস্টেম) ১২৩টি পাইপলাইন চিহ্নিত করেছে, যেখানে বর্জ্যগুলো আটকে জলাবদ্ধতা সমস্যাকে প্রকট করে তুলছে। যেকোনো নগরের প্রাকৃতিক ও মানবিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পুকুর ও জলাশয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে চট্টগ্রাম শহরের বহু বিখ্যাত পুকুর-দীঘি-জলাশয়-ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নগরীর পুকুর জলাশয়গুলো পানি চক্রের একটি ক্ষুদ্রতম অংশ এবং জলাশয়গুলো তাপমাত্রা কমাতে এবং বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি ধারণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত জলাশয় ও পুকুর ভরাট নিষিদ্ধ হলেও সবার সামনেই চট্টগ্রামে অবাধে নগরের পুকুর-জলাশয়-ডোবার ভরাট কাজ চলছে নির্বিঘ্নে। ২০০০ সালে প্রণীত আইন অনুযায়ী স্থানীয় সরকার, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও সিডিএ জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান সংরক্ষণ করবে। কিন্তু এ আইনকে বিভিন্নভাবে ফাঁকি দিয়ে পুকুর ও জলাশয় ভরাটের কাজ চলছে। ১৯৯১ সালে জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রামে জলাশয়ের সংখ্যা ১৯ হাজার ২৫০, অন্যদিকে সিডিএর ডিটেইলড এরিয়া প্লানের আওতায় ২০০৬-০৭ সালে ৭৭০ বর্গকিলোমিটার জলাশয় চিহ্নিত করছে ৪ হাজার ৫২৩টি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের মোরশেদ ও তৈয়ব চৌধুরী (এমফিল গবেষণায় ২০১৮) তথ্যতে দেখা যায়, নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে ১ হাজার ৩৫২টি জলাশয় চিহ্নিত করেন এবং, চট্টগ্রামে প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে পুকুর ও জলাশয় হ্রাস পাচ্ছে। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সব পুকুর ও জলাশয় ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের ফলে নগরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিপর্যস্ত হচ্ছে এবং অল্প সময়ের বৃষ্টিতে পর্যাপ্ত জলাশয়ের অভাবে নগরী তলিয়ে যাচ্ছে জলাবদ্ধতায়। চট্টগ্রাম শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন উৎস থেকে দৈনিক আড়াই থেকে তিন হাজার টন বর্জ্য সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রায় ৭০ লাখ নগরবাসীর বর্জ্য অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে দৈনিক ২৫০-৩০০ টন বর্জ্য রাস্তা, নালা, নর্দমা, খালে বিচ্ছিন্নভাবে পড়ে থাকে এবং পরবর্তী সময়ে এসব বর্জ্য নালা ও খালে পড়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতা ও শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম শহরের শত শত টন বিভিন্ন প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতিনিয়ত জমা হচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে, ফলে নদীদূষণসহ ভরাট হচ্ছে তলদেশ। কর্ণফুলী নদীতে ২০১৮ সালের ড্রেজিংয়ের সময় ৪৮ লাখ ঘনমিটার বালিযুক্ত মাটি উত্তোলন করা হয়; এর মধ্যে ২২ লাখ ঘনমিটার ছিল পলিথিনযুক্ত বালিমাটি।

চট্টগ্রাম মহানগরীর ৭০-৭৫ লাখ জনসংখ্যার বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে নগর পরিবেশের ওপর প্রতিকূল প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। প্রাকৃতিকভাবে চট্টগ্রাম একটি ব্যতিক্রম শহর এবং সমুদ্র, পাহাড়, নদী ও ঢালুভূমির মাঝখানে এ শহরের অবস্থান। পানি নিষ্কাশনের জন্য চট্টগ্রাম শহরে প্রাকৃতিকভাবে একটি চমৎকার ব্যবস্থা থাকার পরও এখানে জলাবদ্ধতার সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে কোনো স্থানে পানি জমে বা আবদ্ধ থাকলে তাকে জলাবদ্ধতা বলে। চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে দেখা যায়, এখানে ৩০ মিনিট থেকে প্রায় ৫ ঘণ্টা পর্যন্ত জলাবদ্ধতা স্থায়ী হয়। জলাবদ্ধতার গভীরতা স্থানভেদে শূন্য দশমিক ৫০ থেকে ১ দশমিক ৬০ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে মূলত জোয়ারজনিত এবং বর্ষাকালীন এ দুই ধরনের জলাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়, তবে মূলত বর্ষাকালীন জলাবদ্ধতা সমস্যা প্রকট। চট্টগ্রামে বর্ষার সময় ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার বৃষ্টিতে মহানগরীর ৪০-৫০ শতাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। মৌসুমি বায়ু দীর্ঘ সময় সক্রিয় থাকলে বৃষ্টিপাত অধিক হয়, তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে ইদানী বৃষ্টির ধরন ও তীব্রতায় পরিবর্তন এসেছে। ফলে অল্প সময়ে এ অধিক বৃষ্টির পানি ধারণ করতে পারছে না এ বন্দর শহর। স্লুইস গেট যথাযথ কার্যকর না হওয়ায় জোয়ারের পানি অনুপ্রবেশ করে নগরের নিচু এলাকা সহজে প্লাবিত হয় এবং বর্ষাকালে বৃষ্টির সময় জোয়ার বিদ্যমান থাকলে চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার প্রকট দীর্ঘ হয়। আগের এক গবেষণায় (আকতার ও অন্যান্য, ২০২২) দেখা যায়, চট্টগ্রামে যদি জলাবদ্ধতায় পানির গভীরতা যদি এক মিটার হয়, তবে শহরের ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ২৫ শতাংশ বসতবাড়িতে জলাবদ্ধতার পানি প্রবেশ করে। বিদ্যমান খাল ও নালা পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রশস্ত ও পরিচ্ছন্ন না হওয়ায় জলাবদ্ধতা প্রকট হচ্ছে।

নগরীর বাদুরতলা জঙ্গিশাহ বাইলেন এলাকায় প্রবাহিত চাক্তাই খালের কাজ চলছে। কিন্তু সেখানে নেই কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী।আগ্রাবাদ রঙ্গীপাড়ার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় খালে পড়ে গত বছর বর্ষায় শিশুর মৃত্যু হলেও খাল ও নালাগুলো এখনও অরক্ষিত। নগরীর মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, শুলকবহর, মেহেদিবাগ, চটেশ্বরী মোড়, চকবাজার, দুই নম্বর গেট, মুন্সিপুকুরপাড়, রহমান নগর, মেয়র গলি, নাসিরাবাদ, আলফালাহ গলি এলাকার নালা ও খাল উন্মুক্ত। জায়গাগুলোতে দেওয়া হয়নি কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী বা রেলিং।

চট্টগ্রাম একটি পাহাড়ি শহর। প্রতিদিনই অসাধু লোকজন এখানে পাহাড় কাটছে। বৃষ্টি হলে পাহাড়ের বালুকাময় মাটি ভেসে গিয়ে খালে পড়ে। এভাবে খালসমূহ ভরাট হয়ে পানি প্রবাহে বাধা তৈরি হয়, যা শহরে জলাবদ্ধতার আরেকটি কারণ। সিডিএ প্রকল্পের একটি বড় দুর্বলতা হলো এখানে পলিফাঁদ নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।তাছাড়া একসময় চট্টগ্রাম শহরে পুকুরের মতো প্রচুর জলাশয় ছিল যেগুলো বৃষ্টির পানি ধরে রাখত। বিগত ৪০ বছরে ভবন নির্মাণের জন্য প্রায় ৭০ শতাংশ জলাশয় ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এর ফলে বৃষ্টির পানি জমার জায়গার অভাবে জলাবদ্ধতা বেড়েছে।অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির হাত থেকে শহরকে রক্ষার জন্য সিডিএ কর্তৃক বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোতে ৪১টি স্লুইস-গেটের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এসব স্লুইস-গেট নির্মাণের কাজ এখনও শেষ না হওয়ায় বৃষ্টির পানি সময়মতো পাম্প করে বের করা যাচ্ছে না। এটি জলাবদ্ধতা সংকটকে বাড়ানোর আরেকটি কারণ।

তবে ব্যর্থতার মাঝেও নতুন করে আশা দেখাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিডিএ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কন্সট্রাকশন ব্রিগেড।

পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবোর অধীনে চলমান ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা/জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ নামের প্রকল্পটির খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পে বিভিন্ন খালের সাথে যুক্ত ২৩টি স্লুইস গেইট থাকছে।

কর্ণফুলী নদীর তীরে বাঁধসহ রাস্তা নির্মাণে ২ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকার অন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। এতে খালের মুখে ১২টি স্লুইস গেইট নির্মাণ করা হয়েছে ইতিমধ্যে। এরমধ্যে আছে চাক্তাই ও রাজাখালীর মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি খাল।

এছাড়া বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত দুই দশমিক নয় কিলোমিটার দীর্ঘ বাড়ইপাড়া খাল খননে ব্যয় হচ্ছে ১৩৭৪ কোটি টাকা। এই খালটির কাজ ৯৫ শতাংশ শেষ হয়েছে।

অন্যদিকে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কন্সট্রাকশন ব্রিগেডের অধীনে প্রকল্পের অগ্রগতি এখন পর্যন্ত ৮৪ শতাংশ। ৩৬টি খালের মধ্যে ২৫টি খালের কাজ শতভাগ শেষ।

“বাকিগুলোর মধ্যে ছয়টি খালের কাজ ৯০ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে। আর পাঁচটি খালের কাজ ৯০ শতাংশের নিচে।”

অন্যদিকে প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ১৭৬ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ, ৪৫টি সেতু, ৬টি কালভার্ট, ৪২টি সিল্ট ট্র্যাপ, পাঁচটি রেগুলেটর নির্মাণ, ১০ দশমিক ৭৭ কিলোমিটর নতুন নালা, ৮৫ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার খালের পাশে সড়ক নির্মাণ ও ১৫ দশমিক ৫০ কিলোমিটার নালা সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।

তারপরেও এর মধ্যে প্রশ্ন থেকেই যায় আসন্ন বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার সম্মুখীন হবে কি চট্টগ্রাম নগরবাসী!

তাই আসন্ন বর্ষার আগেই খননকৃত খালগুলোয় বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে, যা দ্রুত অপসারণ দরকার। মামলার কারণে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে, তা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে হবে।আর্থিক অগ্রগতি ও ভৌত অগ্রগতি সমান্তরালে আনতে হবে। পাহাড় কাটা ঠেকাতে এবং কেটে ফেলা অংশ ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যদিকে বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন আবর্জনা উৎপাদিত হয় চট্টগ্রাম মহানগরে। বর্তমানে এর মধ্যে চসিক অপসারণ করে গড়ে দৈনিক ১ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন। অবশিষ্ট অংশ বিভিন্নভাবে নালা-খালে নিক্ষিপ্ত হয়। তাই চসিকের উচিত আবর্জনা অপসারণের ক্ষমতা এখনই দ্বিগুণ করতে হবে। নালা-খালে অবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে উদ্বুদ্ধকরণের পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

চট্টগ্রাম মহানগর একটি দ্রুত বর্ধিষ্ণু নগর‌ এর পাশাপাশি জনসংখ্যা ও অবকাঠামো বৃদ্ধির প্রবণতা খুবই গতিশীল। বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর এই নগরে; আর বন্দরের সুবিধা পেতে এই নগর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় দ্রুত শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে এবং উঠছে। আবার সাগর-পাহাড়-সমতল আর বনের সমাহার এই নগর ভ্রমণপিপাসুদেরও আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু জলাবদ্ধতার সমস্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই দ্রুত বর্ধিষ্ণু নগর ক্রমাগত বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়ার ঝুঁকে পড়েছে। এই দ্রুত বর্ধিষ্ণু নগরের জলাবদ্ধতা সমস্যা এখন সর্বজনবিদিত। জলাবদ্ধতার সমস্যা স্থায়ী নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি কার্যকর মনোনিবেশ প্রয়োজন।

ড্রেনেজ-ব্যবস্থা পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব নিতে হবে।এই সংস্থাটি আগে থেকেই এ কাজ করে আসছে। তা ছাড়া সংস্থাটি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় জনগণের প্রতি এর দায়বোধও বেশি। দায়িত্ব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুততার সঙ্গে চসিকের জনবল, যন্ত্রবল ও আর্থিক সক্ষমতা কার্যোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে একটি ড্রেনেজ সেল গঠন করতে হবে। অভ্যন্তরীণ ও বাইরের বিশেষজ্ঞ ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এটি গঠিত হতে পারে। এই সেলের কাজ হবে ড্রেনেজ-ব্যবস্থা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করে ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানে পরামর্শ দেওয়া। ওয়ার্ডভিত্তিক প্রতিটি নালা-খালের পরিস্থিতির লগবুক সংরক্ষণ হলে তা এই সেলের কাজের সহায়ক হবে।সর্বোপরি জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও সক্রিয় করে বর্জ্য অব্যবস্থাপনা ও খাল-জলাভূমি দখলের বিরুদ্ধে একটি স্থায়ী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আর কাজটি করতে জনপ্রতিনিধিদেরই এগিয়ে আসতে হবে। আর এভাবেই জলাবদ্ধতার মতো মৃত্যুপুরী অবস্থা থেকে রক্ষা পাবে চট্টগ্রামবাসী।

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি

সারাবাংলা/এএসজি

চট্টগ্রামের খাল-নালার বেহাল দশা মুক্তমত সুমন বৈদ্য

বিজ্ঞাপন

আজ পবিত্র হজ
৫ জুন ২০২৫ ১২:০৫

আরো

সম্পর্কিত খবর