পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে মানুষ চোখে সর্ষে ফুল দেখে। এটা প্রবাদ। যুগ যুগ ধরে এই কথা লোক মুখে চলে আসছে। তারপরেও একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকে যায়। বিপদে পড়লে, অবস্থা বেগতিক দেখলে মানুষ অন্য কোনো ফুল না দেখে সর্ষে ফুল দেখে কেন? এর কোন মীমাংসা হয় না। ধারণা করে নেওয়া যায়, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মানুষ চোখে যা দেখে তা হরিৎ বর্ণের। সরিষা ফুল গাঢ় হলুদ রঙের, তাই। আসলে সে তখন চোখে কিছু স্পষ্ট দেখতে পায় না। যা দেখে তার সব ঘোলাটে, অস্পষ্ট। সম্ভবত সে কারণেই মানুষ চারিদিকে ধুলোয় অন্ধকারই দেখে থাকে।
আমাদের আজকের দশা হয়েছে সেরূপ। গেলো পনের বছরে যা দেখেছি, তা বলা যায় নি। যা শুনেছি তা মাথা পেতে নিতে বাধ্য হয়েছি। যা করেছি তা বাধ্য হয়েই করেছি। বিপরীতে কিছু লোক তখন ডুগডুগি বাজিয়ে বেজায় মজা করেছে, ঠাট্টা-মশকরা করে যারপরনাই আনন্দ পেয়েছে। তারা যা বলেছে তা-ই যেন বেদবাক্য। তারা যা চেয়েছে সেটাই চূড়াস্ত। যা করেছে সেটাই প্রশ্নাতীত সঠিক। প্রকৃতি তার বিরুদ্ধে কৃত অন্যায়ের প্রতিশোধ নিয়ে থাকে। এই সত্য আমরা ধারণ করি না। তবে নিজের বিপক্ষে গেলে মুখে আওড়াতে ভুল করি না। যখন বুঝতে পারি তখন চরম মূল্য দিযেই বুঝি।
হাওয়া ঘুরে। এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। তারও রকমফের আছে। দখিনা হাওয়া সব সময় সবারই ভালো লাগে। কিন্তু কখনো কখনো উত্তুরে হাওয়াও বয়ে থাকে। পূবাল হাওয়ার কথা আমাদের সবার জানা। সেরূপ ঘুর্ণি হাওয়ার কথাও। এক হাওয়ার এত রূপ স্বাভাবিক সময়ে বোঝা যায় না। বোঝার চেষ্টাও করি না। গা-ই করি না। অনুকূল হাওয়ায় থাকলে কে এসবের পরোয়া করে?
আমাদের বর্তমান সময়কাল অনেকটা আশা-নিরাশার দোলাচালে অতিবাহিত হচ্ছে। একদা যারা ছিলো প্রবল প্রতাপান্বিত তারা আজ ফোকরবাসী। মাঝে-মধ্যে জীবন বাঁচাতে ও ‘আলো আসবেই’ এ বিশ্বাসে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাচালি করে হাওয়ার গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করছে। গুহাবাসী জীবন মোটেই সুখকর না। তাতে না আছে পর্যাপ্ত আলো, না আছে পর্যাপ্ত নি:শ্বাস নেওয়ার মত নির্মল বাতাস, না আছে নড়াচড়া করার মত স্বাচ্ছন্দ্যময় স্পেস। তদুপরি মাথার উপর নীলাকাশ দেখা যায় না। অথচ মনের মাঝে সেই এক গীত ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ অনবরত বাজতেই থাকে। টানেলের ওপ্রাস্তে মাঝে-মধ্যে আলোর ছটা দেখা গেলেও আসলে তা আলো না। মরিচীকা। মুহুর্তেই আশা জাগায় আবার পরক্ষণেই নিরাশায় নিমজ্জিত করে। বাইরে যারা আছে, যারা একদা তাদের খেদমতগার ছিলো, তারা মাঝেমধ্যে ‘গুগলি’ বলের ঘূর্ণি দিলেও পাবলিক তাতে আস্থা রাখে না। শুধু ভরসা এটুকু যে, হাওয়া ঘুরে। এই বাক্য-ই এখন তাদের কাছে আশা জাগানিয়া। এ নিয়েই বেঁচে আছে পরিত্যক্ত গোষ্ঠী।
৫ আগস্ট যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন নিয়ে এসেছে আমাদের জীবনে তার নির্যাস পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা যাচ্ছে না আজো। নানা সমীকরণ আর নানা প্লেয়ারের কারিশমায় দেশের দৈনন্দিন চিত্র আজ বেশ ঘোলাটে, গোলমেলে। পনের বছরের অনিয়মের চর্চার পর নিয়মের ক্যাসেট বাস্তবেই বাজবে তা অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না, তবে আশা করে। দশ মাস পার হয়ে গেলো টালমাটাল অবস্থা সামাল দিতে দিতে। এখনো ‘হাওয়া ঘুরে’র থিওরিতে আস্থাবাদীরা সোচ্চার। একের পর এক ঢেউয়ের তরঙ্গ তুলে তারা যে অস্থিরতা সৃষ্টি করার কৌশল বেছে নিয়েছে তাতে তারা শতভাগ সফল। পাবলিককে কনভিন্স করতে না পারলেও খানিকটা কনফিউজ করে দিতে পেরেছে এটা বলা যায়। এরই মধ্যে বশংবদদেরকে দিয়ে জিগির উঠাতে পেরেছে ‘আগেরটাই ভালো ছিলো’। এটাই তাদের প্রাথমিক বিরাট সাফল্য। যারা তাদের উপকারভোগী ছিলো তারা ভেতর থেকে ঘুটি নাড়ছে কখনো বড়ে দিয়ে, কখনো ঘোড়া দিয়ে, কখনো নৌকা দিয়ে কখনো রাজা-মন্ত্রী-পাইক-পেয়াদা দিয়ে। কখনো তা বিধ্বংসী রূপ পরিগ্রহ করেছে। কখনো হাস্যকর হয়েছে। কখনো গভীর গভীরতর ইঙ্গিতবাহী হয়েছে। মোটকথা পর্যায়ক্রমে লেফট উইং, রাইট উইং, মিড ফিল্ড, ফরোয়ার্ড সব দিক দিয়েই সাঁড়াশি আক্রমন চালানো হয়েছে, হচ্ছে। ধারণা করা যায় এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
আমরা সারাক্ষণ ঐক্যের কথা বলি। কিন্তু আশাকরি অন্যরা আমার সাথে ঐক্য করবে, সংহতি প্রকাশ করবে। আমি কম কিসে? এই করে করে অনৈক্যের দেওয়াল উঁচু হয়েছে, ক্রমান্বয়ে আরো উঁচু হচ্ছে। অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করে, উসকে দিয়ে, একে অপরকে সমূলে নাশ করে দিতে আমাদের জুড়ি নেই। তেপ্পান্ন বছরে আমরা কোন মেজর ইস্যুতেও এক হতে পারি নি। হলেও ক্ষণিকের জন্য, পাবলিককে দেখানোর জন্য।
নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যেই হবে কিনা, সংস্কার হবে কি না এখনো স্পষ্ট না। অথচ পাবলিক চায় একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, ভালো লোকের নেতৃত্ব এবং দুষ্টের দমন ও শিষ্টের প্রতিপালনের অনুশীলন। তার জন্য আনুষঙ্গিক যে কাজ করা দরকার তার কোন কথা নেই। ভোটার তালিকার অবস্থা কীরূপ কেউ জানে না। তেপ্পান্ন বছরে ভূয়া ভোটার তালিকাভুক্ত করার কথা সবাই জেনে এসেছে। সরকারে যারা থাকে তারা নিজেদের মত করে ভূয়া ভোটার অন্তর্ভুক্ত করে। বিরোধী শিবিরে যারা থাকে তারা এ নিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা করে। বশংবদ নির্বাচন কমিশন কানে তুলো দিয়ে চোখ স্থির রাখে সরকার কী বলে তার উপর। ভোটার এলাকা চিহ্নিতকরণ আরেক সমস্যা। তেপ্পান্ন বছরে যে যার মত করে এলাকা কাটাকুটি করেছে, এ নিয়ে হৈ চৈ হলেও পরিবর্তন কিছু হয় নি। এবারেও সেরকম হবে কিনা কে জানে? ভোট কেন্দ্র স্থাপনেও অবলম্বন করা হয় অসদুপায়। কেন্দ্র প্রভাবশালী প্রার্থীর বাড়ীর কাছে হবে নাকি নিরপেক্ষ জায়গায় হবে নাকি এলাকার মাঝখানে হবে তা নিয়েও কথা তুলছে না কেউ। হয়ত উঠবে তফশিল ঘোষণার পর। ব্যালটের হেফাজত, ভোটার সনাক্তকরণ, ভোট গ্রহণ ও ভোট গণনা নিয়েও অতীতে অনেক কাণ্ড ঘটেছে। গণনা শেষে প্রিজাইডিং অফিসারের রেকর্ডকৃত ফলাফল শীটে অতীতের মত জোরপূর্বক কোন পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকবে কিনা? সেটাও নিশ্চিত না।
নির্বাচন পূর্ব ও নির্বাচন কালীন স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও কালো টাকার প্রভাব রোধ করা যাবে কিনা? রোধ করার উপায় কি? নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকা কীরূপ হবে, পুলিশ-আনসার- অন্যান্য বাহিনীরইবা ভূমিকা কীরূপ হবে? তেপ্পান্ন বছরে নির্বাচন পূর্ব ও নির্বাচন কালীন প্রশাসন ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বিস্তর অডিও-ভিডিও ও পাবলিকের চাক্ষুষ করা অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেগুলো মোটেই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অনুকূল ছিলো না। তার উপর গত তিনটি প্রহসনের নির্বাচন তো অকল্পনীয় বদ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
পাবলিক উপুর্যুপরি এরূপ তামাশা দেখে দেখে ক্লান্ত-ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা নির্বাচন চায় তবে ‘বিগত মার্কা’ নির্বাচন না। কিন্তু সে পথে আমাদের মেহনত কই? এখন পর্যন্ত এর কোনটি নিয়েই নির্বাচনী দলগুলোর কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না। মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা তো অনেক পরের বিষয়। সব মিলিয়ে মাথায় কিছু আসছে না, চোখে সর্ষে ফুল ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। চারিদিকে বিভিন্ন জার্সি গায়ে খেলোয়াড়দের কারিশমা দেখে চোখে ধুলায় অন্ধকার দেখা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এত কিছু হতাশার মাঝেও একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশায় গোটা দেশ যেমন গভীর প্রতীক্ষায় আছে তেমনি প্রত্যাশিত নির্বাচন ভণ্ডুল করার উদ্দেশ্যে কোন কোন গোষ্ঠী নির্বাচনকে বিতর্কিতও করার অপচেষ্টা করতে পারে। তা যাতে না হতে পারে সে জন্য সবারই অনেক করণীয় আছে। অতএব, সাধু সাবধান।
লেখক: কলামিস্ট