বিশ্বব্যাপী তামাক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করতে তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিকেই সবথেকে কার্যকর মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু তামাকের কর বাড়ানোর বিষয়টি উত্থাপিত হলেই তামাক কোম্পানিগুলো চোরাচালান বৃদ্ধি, লভ্যাংশ হ্রাস এবং সরকারের রাজস্ব কমে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে কর বৃদ্ধির বিরোধীতা করে থাকে। অথচ, তামাকজাত দ্রব্যের উপর সামান্য পরিমানে মূল্য ও কর বৃদ্ধি সত্তেও ২০২৩ সালে সিগারেট বিক্রিতে রেকর্ড (৪০,৩৭৯ কোটি টাকা) গড়ে বিএটি। এমনকি উক্ত বছরে পূর্বের বছরের তুলনায় লভ্যাংশ বৃদ্ধি পায় ১২%। এমনকি বাংলাদেশে গত ১০ বছরে বিএটি উৎপাদন দ্বিগুণ করার পাশাপাশি ৫ গুণ বেশি মুনাফা লাভ করেছে। মূলত তামাক কর বৃদ্ধির বিপরীতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (ঘইজ) সহ নীতিনির্ধারকদের বিভ্রান্ত করার জন্য তামাক কোম্পানিগুলো এসকল খোঁড়া ও ভিত্তিহীন যুক্তি উপস্থাপন করে।
এফসিটিসি’র আর্টিকেল ৬ এ তামাক নিয়ন্ত্রণে উচ্চ হারে কর বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা (WHO, 1 January 2017) উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তামাক কোম্পানিতে বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যমান শেয়ার, তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ, মিথ্যাচারের ব্যাপকতা এবং একটি শক্তিশালী তামাক কর নীতি না থাকায় প্রায় প্রতিবছরের বাজেটে তামাকজাত দ্রব্যের কর বৃদ্ধি করা হলেও তার পরিমাণ মোটেই আশানুরূপ নয়। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি ও মাথাপিছু আয় বিবেচনাতেও প্রতিনিয়ত ভোক্তার কাছে সস্তা হয়ে যাচ্ছে তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য।
উল্লেখ্য, তামাকজাত দ্রব্যের কর আদায়ে প্রচলিত এ্যাডভ্যালোরেম কর পদ্ধতিটি প্রচলিত আছে তা বেশ জটিল ও একাধিক মূল্যস্তরভিত্তিক। যা ধূমপায়ীদেরকে তামাক সেবনে নিরুৎসাহিত করার পরিবর্তে তুলনামূলক নিম্ন মূল্যস্তরের তামাকজাত দ্রব্য গ্রহণে উৎসাহিত করে। প্রচলিত উচ্চ ও নিম্ন মূল্যস্তরের বিশাল মূল্য পার্থক্যই তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমানোর ক্ষেত্রে এই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটের মোড়কে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য উল্লেখপূর্বক সকল পর্যায়ে এই মূল্যে বিক্রয় নিশ্চিতের জন্য এসআরও-১৪০ জারি করা হয়। কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলো নিয়ম লঙ্ঘন করে ভোক্তা পর্যায়ে অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি করছে। অথচ কর পরিশোধ করছে মোড়কে উল্লেখিত মূল্যের ওপর। এই অতিরিক্ত মূল্যের উপর কোনো কর পরিশোধ না করায় সরকার প্রতিবছর প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতির সম্মূখীন হচ্ছে এবং ফুলেফেপে উঠছে কোম্পানির মুনাফা। এই অতিরিক্ত মুনাফা তারা সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কার্যক্রম এবং পণ্যের প্রচার, প্রসার ও সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যয় করছে। পাশাপাশি, বাজেটে তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণে ‘তদুর্ধ্ব’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, যা প্রচলিত কর কাঠামোর স্তর সংখ্যা আরো বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়। এই সুযোগে কোম্পানিগুলো মূল্যস্তর পরিবর্তন না করেও নতুন ব্র্যান্ড বাজারজাতকরণের সুযোগ পায়। এক্ষেত্রে করভার থাকে অপরিবর্তনীয় এবং সরকার বড় রাজস্ব ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
সকল প্রকার ব্যবসা শুরু করার জন্য ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক হলেও তামাকের মতো একটি ক্ষতিকর পণ্য বিক্রয়ে ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণে তামাক কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। তামাক কোম্পানি ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, সকল তামাকজাত দ্রব্য বিক্রেতাদের জন্য লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা এবং ভাসমান বিক্রি নিষিদ্ধ করলে বহু নিম্ন আয়ের মানুষের জীবিকার ওপর সরাসরি আঘাত আসবে। অথচ জরিপে দেখা যায়, দেশে মাত্র ২.৪ শতাংশ ভ্রাম্যমান বিক্রয়কেন্দ্র শুধুমাত্র তামাকজাত দ্রব্য হয়। আর দেশের মোট বিক্রয়কেন্দ্রগুলোর মধ্যে মাত্র ১৮.৫ শতাংশ বিক্রিয়কেন্দ্র অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করে। সংখ্যার বিচারে এটি তামাক কোম্পানির স্বার্থসংলিষ্টদের দাবিকৃত সংখ্যার ত্রিশ ভাগের মাত্র এক ভাগ মাত্র। তামাক নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক কর আদায় নিশ্চিত করতে ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’ অনুযায়ী প্রত্যেকটি তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়কেন্দ্রকে লাইসেন্সিংয়ের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়”।
তামাক কর বৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে অকার্যকর করতে তামাক কোম্পানিগুলো ভ্রান্ত তথ্য প্রচার করে যে তারা ব্যাপক রাজস্ব দেয়। কিন্তু এর বিপরীতে হওয়া স্বাস্থ্যক্ষতি, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক ক্ষতির তথ্য তারা গোপন রাখে। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি কর্তৃক এক গবেষণায় (২০১৭-১৮ সালের) দেখা যায়, তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা বাবদ সরকারের ব্যয় হওয়া ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকার বিপরীতে এই খাত থেকে রাজস্ব পাওয়া যায় ২২ হাজার কোটি টাকা। যা গত ৬ বছরে অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। পাশাপাশি, বার্ষিক ৮০ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন করে তামাক যা জলজ প্রাণী, মাটি, বনভূমি ধ্বংসসহ পরিবেশের নানান ক্ষতিসাধন করে। স্বাস্থ্যক্ষতির সাথে সাথে পরিবেশের উপর এই বিশাল ক্ষতি আর্থিক মূল্যায়নে নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের পরিচালনা পর্ষদে সরকারের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার অবস্থান কর বৃদ্ধিসহ সরকারের সার্বিক তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করছে। বিগত ২০১০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সরকারের উচ্চপদস্থ ২১ জন কর্মকর্তা ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির নীতনির্ধিারণী পর্যায়ে যুক্ত ছিলেন এবং বর্তমানেও রয়েছেন।
জাতীয় বাজেট ঘোষণার পূর্বে তামাক কোম্পানিগুলো বিভিন্ন গণমাধ্যমে চোরাচালান, নকল সিগারেট ও ব্যান্ডরোল আটক বিষয়ক খবর প্রচারের মাধ্যমে চোরাচালানের ভীতি সৃষ্টির মাধ্যমে এনবিআরসহ সকল নীতিনির্ধারকদের মাঝে তামাক কর বৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করে থাকে। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী মোট তামাক বাণিজ্যের ১২% অবৈধ চোরাচালানের মাধ্যমে হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই চোরাচালানের শতকরা হার মাত্র ৫% এর আশেপাশে এবং এর অধিকাংশই ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য।
বিশ্বের অনেক দেশ চোরাচালান এবং কর ফাঁকি সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সরবরাহ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য উন্নত ও ডিজিটালাইজড ট্যাক্স ট্র্যাকিং এবং ট্রেসিং সিস্টেম গ্রহণ করা হলেও বাংলাদেশে এখনও আধুনিকতার সেই ছোঁয়া লাগেনি। বিশেষ করে ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্যের কর ও মনিটরিং ব্যবস্থা সবথেকে দুর্বল। বাংলাদেশের মোট তামাক ব্যবহারকারীদের ৫০% এর বেশি মানুষ ধোঁয়াবিহিন তামাক ব্যবহার করলেও এই খাত থেকে প্রাপ্ত মোট রাজস্বের ১% এরও কম আসে ধোঁয়াবিহীন তামাক থেকে।” সমস্যা সমাধানে কর আদায় ও মনিটরিং ব্যবস্থায় বারকোড, ডিজিটাল ট্যাক্স স্ট্যাম্পসহ সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির ব্যবহার করদাতার তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে করের হার বাড়ানো, সাপ্লাই চেইন সম্বন্ধে সঠিক ধারণা প্রদানসহ রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে এবং ট্যাক্স আদায় প্রক্রিয়াকে আরো সহজতর করবে।
তামাক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে ভোক্তার ক্রয়সক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাওয়া জরুরি। কাজেই তামাক বিরোধী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে আগামী বাজেটে সরকার মহোদয়ের কাছে সিগারেটের ৪টি মূল্য স্তরকে নামিয়ে ৩টিতে আনার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি বন্ধ করতে এনবিআরকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক অবদান রাখার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
লেখক: সমন্বয়কারী, বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট