শহর—এই শব্দটি উচ্চারণ করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কংক্রিটের দালান, হইচই, যানজট, হর্নের আওয়াজ, এবং এক অস্থির জীবনের প্রতিচ্ছবি। অথচ মানুষের আবাসের এই নগর সভ্যতা একসময় গড়ে উঠেছিল সুপরিকল্পিত ও স্বস্তিকর জীবনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। আধুনিকতা, প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির এই রঙিন মোড়কে আমরা ধীরে ধীরে ভুলে গেছি প্রকৃতির সান্নিধ্য, সবুজ গাছপালা, নির্মল বাতাস আর নির্মলতার মূল আবেদন। এই ভোলার পথেই জন্ম নিয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়, জলবায়ু পরিবর্তন, উষ্ণতা বৃদ্ধি, এবং মনুষ্য জীবনের ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব। এই বাস্তবতায় নতুন করে জেগে উঠেছে এক স্বপ্ন—সবুজ শহরের স্বপ্ন। সবুজ শহরের ভাবনা নিছক রোমান্টিক কল্পনা নয়। এটি একটি প্রয়োজন, সময়ের দাবি এবং আগামী প্রজন্মের প্রতি আমাদের দায়িত্ব। একটি সবুজ শহর কেবল প্রাকৃতিক উপাদানে পরিপূর্ণ একটি স্থান নয়, এটি এমন একটি বসতি যেখানে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের মধ্যে বাঁচে। গাছপালা, উন্মুক্ত স্থান, জলাশয়, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, সৌরশক্তি ব্যবহার, পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা, এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি ব্যবস্থার সম্মিলন ঘটিয়ে গড়ে ওঠে এমন শহর। এটি একটি জীবনদর্শন যেখানে উন্নয়ন মানে কেবল উচ্চ দালান কিংবা যান্ত্রিক নাগরিক জীবন নয়, বরং প্রতিটি পদক্ষেপে প্রকৃতির প্রতি সম্মান এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চলা। টেকসই নগরায়নের ধারণা এই স্বপ্নকেই বাস্তবে রূপ দেওয়ার এক বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক প্রক্রিয়া। নগরায়ন অগ্রগতি এনে দিলেও এর সাথে এসেছে অসংখ্য সমস্যা: বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, বিশুদ্ধ পানির অভাব, জ্বালানির সংকট এবং বসবাসের অনুপযোগী পরিবেশ। এসব সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কৃত হয়েছে যে শহরগুলোর উচিত তাদের কাঠামো পুনর্গঠন করা, এমনভাবে যাতে তারা পরিবেশবান্ধব হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারে। এর মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছে “সবুজ শহর” নির্মাণের পথচলা। তবে এই পথ সহজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সামাজিক সচেতনতা, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং প্রতিটি নাগরিকের অংশগ্রহণ। সবুজ শহরের ভাবনা নিয়ে পরিকল্পনা করলে তার প্রতিটি স্তরে থাকতে হবে পরিবেশগত চেতনা। নগর পরিকল্পনায় বাড়তি গাছ লাগানো, বহুতল ভবনের ছাদে বাগান তৈরি, ফুটপাত ও রাস্তায় বৃক্ষরোপণ, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা, সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুশক্তির ব্যবহার—এসব কিছুকে একত্রে দেখতে হবে একটি সমন্বিত কাঠামোর মধ্যে। শুধু পরিকল্পনা করলেই হবে না, এর বাস্তবায়নে নানা চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে হয়। জমির স্বল্পতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, অর্থায়নের ঘাটতি, এবং প্রশাসনিক অনিচ্ছা—এসবই সবুজ শহর নির্মাণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এর মানে এই নয় যে পথ থেমে যাবে। মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও সচেতনতা যদি যথেষ্ট হয়, তাহলে এসব প্রতিকূলতাকেও জয় করা সম্ভব। বিশ্বজুড়ে ইতিমধ্যেই এই ভাবনার বাস্তব প্রতিফলন ঘটছে। ডেনমার্কের কোপেনহেগেন, কানাডার ভ্যাঙ্কুভার, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট, কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল—সবখানেই গড়ে উঠছে সবুজ নগর ব্যবস্থা। এসব শহর শুধু দৃষ্টিনন্দন নয়, বসবাসের উপযোগীতাও অনেক বেশি। এগুলো উদাহরণ হতে পারে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্যও, যারা এখনো টেকসই নগরায়নের সূচনালগ্নে অবস্থান করছে। তবে শুধুই বিদেশি উদাহরণ দিয়ে চলবে না। স্থানীয় বাস্তবতা বুঝে, মানুষের চাহিদা ও প্রকৃতির অবস্থা বিবেচনা করে নির্মাণ করতে হবে নিজস্ব সবুজ শহর। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঢাকাকে যদি সবুজ শহরে রূপান্তর করার স্বপ্ন দেখা হয়, তাহলে তার জন্য চাই সুনির্দিষ্ট, সুপরিকল্পিত ও সাহসী পদক্ষেপ। যেমন—বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন, গণপরিবহনের পরিবেশবান্ধবীকরণ, নদী ও খাল পুনরুদ্ধার, এবং শহরের গাছপালা রক্ষার সুনিশ্চিত উদ্যোগ।
এইভাবেই ধীরে ধীরে নির্মিত হতে পারে এক নতুন শহর—যেখানে শিশুদের জন্য খেলার মাঠ থাকবে, প্রবীণদের জন্য থাকবে হাঁটার পথ, কাজ শেষে মানুষ ফিরবে নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে, আর ভবনের জানালা দিয়ে তাকালেই চোখে পড়বে সবুজের হাসি। এই শহর কেবল ভবিষ্যতের জন্য নয়, বর্তমানের জন্যও প্রাসঙ্গিক। কারণ, আমরা এখন এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে উন্নয়ন ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন না করতে পারলে সব উন্নয়নই হবে অর্থহীন। সবুজ শহরের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রথমেই মুখোমুখি হতে হয় নগরের বাস্তব চিত্রের। আজকের শহর মানেই ঘনবসতি, অপরিকল্পিত আবাসন, যানজটের শৃঙ্খল, এবং প্রাকৃতিক উপাদানের ধ্বংস। শহরের বৃক্ষ আচ্ছাদন হারাতে হারাতে এখন এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে বেড়ে গেছে কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস। নদী ও খাল বুজিয়ে তৈরি হয়েছে ভবন, খেলার মাঠ পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক প্লাজায়। এই প্রেক্ষাপটে সবুজ শহরের বাস্তবতা নিয়ে কথা বলা অনেক সময় আদর্শবাদ মনে হতে পারে। কিন্তু আদর্শ ছাড়া কোনও পরিবর্তন সম্ভব নয়। আর পরিবর্তনের প্রথম ধাপ হলো বাস্তবতা স্বীকার করে সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়া। বাস্তবতার মুখে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রশাসনিক সমন্বয়ের অভাব। একটি শহর নিয়ে পরিকল্পনা করলেই হয় না, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য থাকতে হয় একাধিক প্রতিষ্ঠান, তাদের মধ্যে সুস্পষ্ট দায়িত্ববন্টন ও সহযোগিতা। আজকের অনেক শহরে দেখা যায় যে এক সড়ক খুঁড়ে কাজ শুরু করে এক প্রতিষ্ঠান, পরে আরেকটি প্রতিষ্ঠান এসে আবার খুঁড়ে ফেলে। এতে একদিকে যেমন সময় ও অর্থের অপচয় হয়, অন্যদিকে নাগরিক দুর্ভোগ বাড়ে এবং পরিবেশ দূষণ হয়। সবুজ শহরের জন্য দরকার এমন একটি প্রশাসনিক কাঠামো, যেখানে নগর পরিকল্পনার প্রতিটি স্তরে পরিবেশের ভূমিকা অগ্রাধিকার পাবে এবং সিদ্ধান্ত হবে সমন্বিত। অন্যদিকে নাগরিক অংশগ্রহণও এই বাস্তবতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। পরিবেশবান্ধব শহর গড়ার স্বপ্ন তখনই সফল হতে পারে, যখন শহরের মানুষ নিজের দায়িত্ব নিজেই নেবে। এটি হতে পারে একটি ছোট্ট পদক্ষেপ, যেমন—নিজের বাড়ির ছাদে গাছ লাগানো, পলিথিন ব্যবহার না করা, বা ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলা। এই ছোট ছোট আচরণই একটি বড় সংস্কৃতির জন্ম দেয়, যেটি শহরকে বদলে দিতে পারে। কিন্তু বর্তমান নাগরিক জীবনে এই সচেতনতা গড়ে তোলা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা, সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম এবং সাংস্কৃতিক উদ্ভাবন। অর্থনৈতিক বাস্তবতাও এখানে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেকেই বলে থাকেন, সবুজ শহর নির্মাণ ব্যয়বহুল, এতে উন্নয়নের গতি কমে যাবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই ব্যয় একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। যদি শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হয়, যদি সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ বাড়ানো হয়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে এই ব্যবস্থাগুলো অর্থনীতিতে সাশ্রয় এনে দেয়। শুধু আর্থিক দিক থেকেই নয়, স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক দিক থেকেও এটি লাভজনক। কারণ, একটি পরিচ্ছন্ন, দূষণমুক্ত শহর মানেই সুস্থ নাগরিক, কম চিকিৎসা খরচ এবং কর্মক্ষম মানবসম্পদ। প্রযুক্তির ব্যবহারের বিষয়টিও সবুজ শহরের বাস্তবতা নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ। স্মার্ট নগর ব্যবস্থার মাধ্যমে যেমন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তেমনি আবর্জনা সংগ্রহ, পানি সরবরাহ ও বিদ্যুৎ ব্যবহারেও আনতে পারে নিয়মিততা ও দক্ষতা। তবে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হলে সেই অনুযায়ী অবকাঠামো, প্রশিক্ষিত জনবল এবং রক্ষণাবেক্ষণের দক্ষতা থাকতে হয়। এই দিকগুলো এখনো আমাদের অনেক শহরে অনুপস্থিত। তাই প্রযুক্তির সুফল পেতে হলে আগে এই ভিত্তিগুলো মজবুত করতে হবে। অবশেষে যে দিকটি উপেক্ষিত থাকে, তা হলো সংস্কৃতি ও মনোভঙ্গি। শহরের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক, তা কেবল বসবাস নয়, এটি একটি মানসিক সংযোগ। যখন কেউ শহরকে নিজের মনে করে, তখন সে শহরের রক্ষণাবেক্ষণে ভূমিকা রাখতে চায়। কিন্তু যদি শহর হয় কেবল ভোগের স্থান, তাহলে তাকে রক্ষা করার অনুভবও জন্মায় না। সবুজ শহর নির্মাণের জন্য দরকার এমন এক সংস্কৃতি, যেখানে নাগরিক এবং শহরের সম্পর্ক হবে দায়িত্বপূর্ণ, যত্নশীল এবং সহানুভূতিশীল। সবুজ শহরের স্বপ্ন আর বাস্তবতা—এই দুইয়ের মাঝে পার্থক্য থাকলেও তা অতিক্রম করার সাহস ও সদিচ্ছা থাকলে প্রতিটি শহরেই শুরু হতে পারে পরিবর্তনের নতুন অধ্যায়। টেকসই নগরায়নের এই যাত্রা আমাদের বর্তমানকে রক্ষা করবে, ভবিষ্যতের জন্য সৃষ্টি করবে এক নিরাপদ আশ্রয়। একদিন আমাদের সন্তানরা বড় হবে এমন শহরে, যেখানে গ্রীষ্মে রোদের পাশাপাশি থাকবে গাছের ছায়া, বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার বদলে হবে জলাশয় পূর্ণতা, এবং প্রতিটি নিঃশ্বাসে থাকবে প্রাকৃতিক নির্মলতা। সেই দিনের স্বপ্নেই আজকের লড়াই, আজকের পরিকল্পনা, এবং আজকের অঙ্গীকার।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ