Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মাদকের বিরুদ্ধে প্রয়োজন সামাজিক ও আইনি যুদ্ধ


২৭ জুন ২০২০ ০০:২৪

মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস আজ। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৮৭ সালে ৪২ তম অধিবেশনে পৃথিবীকে মাদকের করালগ্রাস থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে প্রতিবছর ২৬ জুন মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই থেকে বিশ্বব্যাপী দিনটি পালিত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবসের এবারের স্লোগান— ‘শুদ্ধ জ্ঞানেই সঠিক যত্ন হবে, জ্ঞানের আলোয় মাদক দূর হবে।’

বিজ্ঞাপন

মাদকবিরোধী দিবসটি পালনের প্রাক্কালে আন্তর্জাতিক এ দিবসের ইতিহাস আমাদেরও স্মরণ করা দরকার। উইকিপিডিয়ার তথ্যসূত্রে জানা যায়, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে উৎপাদিত আফিম দিয়ে চীনকে অর্থনৈতিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করার প্রতিক্রিয়ায় ১৮৩৯ সালের এই দিনে চীনের সম্রাট মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ব্রিটেনের সঙ্গে চীনের এই যুদ্ধই ইতিহাসে প্রথম আফিম-যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই চীন আধুনিক যুগে প্রবেশ করে এবং উন্নতির পথে যাত্রাও সূচিত হয়।

বিজ্ঞাপন

সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনার কারণে অত্যন্ত সীমিত পরিসরে দেশে দিবসটি পালন করবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তবে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাদকবিরোধী প্রচার কার্যক্রম চালানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

তবে এইসময়েও বাংলাদেশের যুবসমাজের একটি বিরাট অংশ মাদকের করালগ্রাসে নিমজ্জিত। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই দেশে যুবসমাজের মধ্যে মাদকাসক্তির পরিমাণ সাম্প্রতিক সময়ে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। সিগারেট থেকে নেশা শুরু করলেও মাদকের প্রতি আসক্তি তাদের ধীরে ধীরে শুরু হয়। বেশির ভাগই শুরু হয় বন্ধুবান্ধবের সাহচর্যে। মূলত মাদক কেনার অর্থ জোগাড় করতে গিয়েই কিশোর-তরুণেরা নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।

জীবনকে মাদকমুক্ত করা না গেলে, সমাজ ও সংস্কৃতিও নিমজ্জিত হতে থাকবে অবক্ষয়ে। বিশ্বের অনেক দেশই মাদকের গ্রাসে দিশাহীন হয়ে গেছে। এদের মধ্যে আফ্রিকার কিছু দেশও রয়েছে। যুবসমাজের উল্লেখযোগ্য অংশ যদি মাদকে আসক্ত থাকে তাহলে কোনো জাতি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না।

পুলিশ প্রশাসনের মতে ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও খুনসহ রাজধানীতে সংঘটিত অধিকাংশ অপরাধের সঙ্গেই মাদকাসক্তির সম্পর্ক রয়েছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ীদের একটি বড় অংশই মাদকাসক্ত এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের ফলে প্রতিবছর ৫৭ হাজার লোকের মৃত্যু হয় এবং তিন লাখ ৮২ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে।

এটা সত্য যে, আজ যখন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হচ্ছে, তখন বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে এশিয়ার অন্যতম মাদক-সংকুল ও পাচারের কেন্দ্রে থাকা দেশে। আরও ভয়াবহ হলো, এ বিষয়ে সরকারি মহলে উদ্বেগের বদলে নীরবতাই বেশি লক্ষণীয়।

বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও মাদকাসক্তির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। যেসব দেশে মাদক উৎপাদিত হয় সেসব দেশের চক্রের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থিত, যেমন দক্ষিণ-পূর্বে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও লাওসে পপিগাছ (আফিম) উৎপন্ন হয়। আবার উত্তর-পশ্চিমে গোল্ডেন ক্রিসেন্ট পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরান। ফলে এতদঞ্চলের মাদক ব্যবসার প্রভাব বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করে।

মাদকের সর্বব্যাপী বিস্তার ঠেকিয়ে তরুণ প্রজন্মকে এর অভিশাপ থেকে রক্ষায় সর্বশেষ বাংলাদেশে ২০১৮ সালের ৪ মে দেশজুড়ে বিশেষ অভিযান শুরু করে র‌্যাব। এরপর পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থাও মাদকবিরোধী অভিযান চালায়। অভিযানে এখন পর্যন্ত কয়েকশ’ ব্যক্তি মাদক কারবারে জড়িত থাকায় অভিযুক্ত হিসেবে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যায়। গ্রেপ্তার হয় কয়েক হাজার। তবু মাদক নির্মূল করা যায়নি। মাদক কারবার চলছেই।

করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারিও মাদককে রুখতে পারেনি। কিছুদিন আগে সংবাদমাধ্যমে করোনাকালীন মাদক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বক্তব্য পড়ছিলাম। সেখানে তিনি জানিয়েছিলেন, করোনার এই সময়ে আগের মতো ধারাবাহিকভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণের অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ কোনো একটি ইউনিটের একজন সদস্য করোনা আক্রান্ত হলেই ওই ইউনিটের সব সদস্যকে কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হচ্ছে। আবার অভিযান চালাতে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে।

তবে এই অবস্থায় মুল প্রশ্নটি হলো, এত অভিযান সত্ত্বেও মাদকদ্রব্যের কারবারিরা তাঁদের অবৈধ কারবার কীভাবে চালিয়ে যেতে পারছেন? ইয়াবাসহ অধিকাংশ মাদকদ্রব্য বাংলাদেশের ভেতরে উৎপাদিত হয় না, পাশের দেশ থেকে পাচার হয়ে আসে। ইয়াবা আসছে পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে, আসছে স্থল ও সমুদ্র উভয় পথে। কিন্তু কীভাবে আসতে পারছে? এ প্রশ্নটি আমাদের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ডের প্রতি। এই দুটি বাহিনীর দায়িত্ব উভয় সীমান্তপথের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; শুধু মাদকদ্রব্য নয়, যেকোনো পণ্য ও ব্যক্তির অবৈধ প্রবেশ ও প্রস্থান প্রতিরোধ করা।

সীমান্ত পেরিয়ে মাদক আসা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে, বাংলাদেশের জলসীমান্ত ও স্থলসীমান্তকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্ছিদ্র করতে হবে। দেশের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত বাহিনীগুলোকে তা নিশ্চিত করতে হবে। তা করতে না পারলে মাদকবিরোধী অভিযান চূড়ান্ত বিচারে কোনো ফল দেবে না।

বাংলাদেশেও এখন মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক ও আইনি যুদ্ধ প্রয়োজন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে বিভিন্নসময়ে পাওয়া খবরে দেখা যাচ্ছে, একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা-সাংসদ এই ব্যবসায় জড়িত। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও কেউ কেউ এসবে জড়িত রয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে।

এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। আর তাই মাদক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলে সরকারের প্রচেষ্টাও যেমন আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন, তেমনি নিবিড় পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম শক্তিশালী করাও জরুরি। তবেই মাদকমুক্ত সোনার দেশ হবে আমাদের প্রিয় স্বদেশভূমি।

বিজ্ঞাপন

মাদকের টাকার জন্য মা'কে খুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭

আরো

সম্পর্কিত খবর