Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘স্বপ্নপুরী’র করোনা মোকাবেলার গল্প


১৪ জুলাই ২০২০ ১৯:৫৪

প্রায় সাড়ে ষোল কোটি মানুষের ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশের নাম ‘স্বপ্নপুরী’। নানা সীমাবদ্ধতা স্বত্বেও দেশটি উন্নতির সোপানে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলো। পৃথিবীর অনেকের কাছে পরিচিত হচ্ছিলো উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে। ধারাবাহিক জিডিপি গ্রোথে প্রথম সারিতেই ছিলো দেশটি। সমৃদ্ধি তখন কল্পনার সীমা পার হয়ে বাস্তবের হাত ছুঁই ছুঁই করছে। কেবলই সময়ের বাপার। কিন্তু বাধ সাধলো প্রকৃতি!

২০২০ সালের শুরু থেকে কোভিড-১৯ নামক এক অতিমারিতে আক্রান্ত হলো পুরো বিশ্ব। উৎপত্তিস্থল চীন হলেও দ্রুততার সাথে দিকে দিকে ছড়িয়ে গেল সেই ভাইরাস। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য সর্বত্রই তার করাল গ্রাসে আক্রান্ত। তবে স্বপ্নপুরী দেশটির প্রতি সৃষ্টিকর্তার বিশেষ আশীর্বাদ ছিল। ফলে শুরুতেই আক্রান্ত হলো না দেশটি। প্রস্তুতি নেয়ার জন্য পেল পর্যাপ্ত সময়।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বজুড়ে ভাইরাসটির ভয়াবহতা দেখে স্বপ্নপুরী দেশটির নীতি নির্ধারকরা বুঝতে পারলেন তারা কেউই ‘করোনার চেয়ে শক্তিশালী’ নন। তারা খুব ভালো করেই জানেন প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। তাই করোনাভাইরাস মোকাবেলায় তারা বিস্তারিত কার্যক্রম হাতে নিলেন। করোনা প্রতিরোধের জন্য গঠন করা হলো জাতীয় কমিটি। কমিটিতে জায়গা পেলেন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যবিদ, অণুজীববিজ্ঞানী, গবেষক, মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, প্রশাসনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা। শুধু কমিটি গঠনই নয়। সামগ্রিক পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার জন্য দফায় দফায় মিটিং করা হলো, চূড়ান্ত হলো কর্মপরিকল্পনা।

স্বপ্নপুরী দেশটির রাজধানীর উপকন্ঠে অবস্থিত একটি বিমানবন্দরই বিদেশ থাকা আসা মানুষদের মূল প্রবেশদ্বার। নীতি নির্ধারকরা বুঝতে পারলেন বিমানবন্দর এবং স্থলবন্দরসমূহে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা গেলেই দেশে করোনা ভাইরাসের প্রবেশ রোধ করা যাবে। তাই ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকেই বিদেশী ফ্লাইট নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাবনা রাখলেন তারা। একই সাথে জরুরী প্রয়োজনে বিদেশ থেকে আসা মানুষদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নেয়ার জন্য ভাড়া করা হলো বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকার সকল হোটেল। অব্যবহৃত সরকারি আবাসনগুলোকেও একই কাজে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। বিদেশ থেকে যারাই আসলেন তাদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের আওতায় আনা হলো। প্রবাসীরাও ‘কান্ট্রি সিস্টেমকে ফাক’ করার পরিবর্তে সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে কোয়ারেন্টিনে চলে গেলেন চৌদ্দ দিনের জন্য।

বিজ্ঞাপন

তারপরও মার্চ মাসের শুরুতে প্রথম করোনাভাইরাসের আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হলো দেশটিতে। দেশটির নীতি নির্ধারকরা ইতোমধ্যেই দক্ষিণ কোরিয়ার শিনছনজি চার্চের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বিস্তারিতে স্টাডি করে রেখেছেন, যেখানে একজন ব্যক্তি থেকেই হাজারো মানুষের ভিতর ছড়িয়ে পড়েছিল করোনাভাইরাস। তাই প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার সাথে সাথেই রাজধানী ঢাকাকে সমগ্র দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলো। গড়ে তোলা হলো কঠোর নিরাপত্তা বেস্টনি যেন একজন মানুষও বের হতে না পারেন।

রাজধানীবাসীকে সম্পূর্ণরূপে একুশ দিনের জন্য ঘরে থাকার নির্দেশনা দেয়া হলো। এলাকভিত্তিক গড়ে তোলা হলো স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, যারা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দেবেন। তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসলো সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। রাজধানীর পাশাপাশি সারাদেশে মানুষের চলাচল সীমিত করা হলো, বন্ধ করে দেয়া হলো স্কুল, কলেজসহ জনসমাগম হতে পারে এমন সব কার্যক্রম।

করোনা রোগী শনাক্তের পরপরই দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা পরবর্তী ধাপের কাজ শুরু করলেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা থেকে তারা ভালো করেই জানেন করোনা প্রতিরোধের অন্যতম মূল মন্ত্র টেস্ট, টেস্ট এবং টেস্ট। তাই শুরুতেই তারা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে থাকা সকল আরটি পিসিআরের তালিকা তৈরি করলেন এবং সেগুলোকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। পরিকল্পনা করা হলো দেশটির বিভাগীয় শহর এবং বৃহৎ জেলা শহরগুলোতে সর্বমোট বিশটির মতো উচ্চক্ষমতার টেস্ট সেন্টার স্থাপন করা হবে যেন প্রতিটি টেস্ট সেন্টারে দিনে কমপক্ষে এক হাজার করে টেস্ট করা যায়। এর জন্য বিদ্যমান আরটি পিসিআর মেশিনের সাথে প্রয়োজনীয় নতুন পিসিআর মেশিনও অর্ডার দেয়া হল। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে বিদেশ থেকে নিয়ে আসা হলো পর্যাপ্ত টেস্ট কিট। দেশটির সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে কাজ করার জন্য নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনবল তৈরি করলো যারা টেস্ট প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত থাকবেন।

প্রফেশনালদের পাশাপাশি টেস্ট কাজে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিতে এগিয়ে আসলো সদ্য পাশকৃত ইন্টার্ন ডাক্তার এবং বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিক্যুলার রিলেটেড সাবজেক্ট থেকে পাশ করা গ্র্যাজুয়েটর।

নমুনা সংগ্রহের জন্য দেশের সকল উপজেলা ও জেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ট্রায়াজ সিস্টেম অনুসরণ করে নমুনা সংগ্রহের বুথ স্থাপন করা হলো। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ দেয়া হলো দুটি করে যানবাহন যার একটি নমুনা পরিবহনের কাজে এবং অন্যটি সম্ভাব্য করোনা রোগী পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হবে। প্রতিটি সরকারি জেলা হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার জন্য আলাদা উইং প্রস্তুত করা হলো। নিশ্চিত করা হলো পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ।

রাজধানীতে সরকারি হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করা হলো। সরকারের পক্ষ থেকে বিশাল আকারের কয়েকটি কনভেশন সেন্টার অধিগ্রহণ করা হলো। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হলো সেই কনভেশন সেন্টারে তাদের সামর্থ্যানুযায়ী লজিস্টিক সরবরাহপূর্বক মেকশিফট হাসপাতাল তৈরি করার। দেশের স্বার্থে বেসরকারি হাসপাতালগুলোও লাভের চিন্তা বাদ দিয়ে এগিয়ে আসলো।

দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোভিড প্রতিরোধের ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা হিসেবে কাজ করতে যাওয়া ডাক্তারদের নিরাপত্তার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করলেন। তিনি পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) যথাযথভাবে উচ্চারণ করতে পারার পাশাপাশি এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও সম্যক অবহিত ছিলেন। তাই তিনি জরুরী ভিত্তিতে পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) আমদানীর পাশাপাশি দেশটির গার্মেন্টস শিল্পের নীতিনির্ধারকদের সাথে বসে দেশেই উন্নত মানের পিপিই তৈরির উদ্যোগ নিলেন। দেশটি যে বস্ত্রখাতের অন্যতম শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ সেকথা তো বলতেই ভুলে গিয়েছিলাম। পিপিই এর পাশাপাশি নিশ্চিত করা হলো অন্যান্য সকল নিরাপত্তা সরঞ্জামও।

একুশ দিনের কঠোর লকডাউন শেষে রাজধানী থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাওয়া মানুষদের পুনরায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নেয়ার জন্য দেশের সকল আশ্রয়কেন্দ্র এবং প্রতিটি ইউনিয়নের এক বা একাধিক স্কুলকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন/ আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে গড়ে তোলা হলো। স্থানীয় সরকারের অধীনে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং পৌরসভার মেয়ররা এই কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেলেন। কোয়ারেন্টিন সেন্টারসমূহ পরিচালনায় কাজে লাগানো হলো আনসার বাহিনী, গ্রাম পুলিশ এবং কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডেরদের। সার্বিক মনিটরিং ব্যবস্থায় থাকলেন স্ব স্ব সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্যরা। করোনাভাইরাসের আক্রমণ শুরু হবার পর থেকে তাদের কেউই নিজ এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও যাননি। যে আশা ভরসা নিয়ে মানুষজন তাদের নির্বাচিত করে সংসদে পাঠিয়েছে তার প্রতিদান দেয়ার এমন চমৎকার সুযোগ কেউই হাতছাড়া করতে চাননি।

স্বাস্থ্যবিভাগের নীতিনির্ধারকদের তড়িৎ ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ এবং বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবস্থাপনায় করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবা থেকে দ্রুতসময়েই মুক্তি পেল স্বপ্নপুরী নামক দেশটি। সারাবিশ্বের মহাপরাক্রমশালী দেশগুলোও যখন ঠিকমত বুঝে উঠতে পারছে না কিভাবে করোনাভাইরাসেরর আক্রমন সামলে উঠবে তখন বিশ্বের বুকে এক আশ্চর্য বিস্ময় হিসেবে উচ্চারিত হচ্ছে স্বপ্নপুরীর নাম। করোনা প্রতিরোধের রোলমডেল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এই দেশটির কাছ থেকে পরামর্শ নিতে লাগলো আক্রান্ত অন্যান্য দেশ। পিপিইসহ অন্যান্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম রপ্তানির বিপুল পরিমাণ কার্যাদেশ পেয়ে দেশটির অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াতে লাগলো। বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলো তাদের ফ্যাক্টরি স্থাপনের পরবর্তী ঠিকানা হিসেবে বেছে নিলো স্বপ্নপুরীকে। এ যেন বিপরীতে হিত হলো দেশটির জন্য।

জুলাই মাস। দেশটির প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টের বাজেট অধিবেশনে বক্তব্য দেয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। বক্তব্যের শুরুতেই তিনি ঘোষণা দিলেন স্বপ্নপুরী দেশটি এখন করোনা মুক্ত। টেবিল চাপড়ে আনন্দ প্রকাশ করলেন উপস্থিত সংসদ সদস্যরা। সারাদেশের মানুষের মনে ছড়িয়ে পড়লো আনন্দ হিল্লোল। প্রধানমন্ত্রীর চোখ দুটোও টলমল করছে করোনা জয়ের আনন্দে। রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তিনি ভাবলেন, তিনি সৌভাগ্যবান, কেননা তার সরকারের স্বাস্থ্যবিভাগের দায়িত্বে ছিলেন একদল দক্ষ, নীতিবান, সৎ ও কর্মঠ মানুষ!

লেখক: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। ছদ্মনাম- ডার্ক নাইট।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামে আগুনে পুড়ল ৫ দোকান
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৩৪

আরো

সম্পর্কিত খবর