Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলা নবজাতক শিশুটির দোষটা কী ছিল?


১৫ জুলাই ২০২০ ১৬:০৮

আচ্ছা, জন্মের পর একটা বাচ্চার কি কোন ধর্মীয় পরিচয় থাকে? তার শরীরের কোনো অংশে কি কোনো ধর্মের সিল মারা থাকে? জাত-পাত-বংশের কোন চিহ্ন থাকে? একটা ফুটফুটে নবজাতক শিশু নিষ্পাপ অবস্থায় এই কলুষিত পৃথিবীতে আসার পরেই যেকোনো বিষয়ে ব্যক্তিস্বাধীন মতামত দেবার মত মানসিক পরিণতি আসবার আগেই তাকে আমরা নানা ধর্ম-জাত-পাত আর বংশের সিল্ মেরে এক দলে ফেলে দেই, তারপর বাকি জীবন তাকে সেটাই বয়ে বেড়াতে হয়।

কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর উপজেলার ঘাটুরায় এক নবজাতককে মৃত্যুর পরেও ধর্মের কারণে চরম নিষ্ঠুর পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। গোরস্থান থেকে তার লাশ তুলে ফেলে দেওয়া হয়েছে রাস্তায় এবং সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে যে কোনো কিছুতেই ধর্ম টেনে এনে নোংরামি করা এই দেশে এমন জঘন্য ঘটনা নিয়ে তেমন কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়নি। এর সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবী ওঠা কিংবা কোন ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি।

বিজ্ঞাপন

অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে ঘটনাটা, তাই না? কিন্তু আসলেই ঘটেছে এটা, শিশুটা আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের একজনের সন্তান হওয়ায় এমন ভয়াবহ অমানবিক ঘটানো হয়েছে। ঘটনার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফেনী সদর উপজেলার বাসিন্দা ও সেখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক সাইফুল ইসলাম এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ঘাটুরা এলাকার স্বপ্না বেগমের নবজাতক সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় গত ৭ জুলাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের খ্রিস্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে জন্মানো কন্যা সন্তানটি নির্ধারিত সময়ের আগে জন্মেছিল। হাসপাতালে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছিল তাকে, পরবর্তীতে গত বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে শিশুটি মারা যায়।

বিজ্ঞাপন

ধর্মীয় রীতি মেনে সেই দিন সকাল ৭টার দিকে শিশুটির মরদেহ ঘাটুরা এলাকার একটি সরকারি কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকালেই স্থানীয় প্রত্যেকটা মসজিদের ইমাম ও মৌলভিরা রীতিমত মাইকিং করে এলাকাবাসীকে জড়ো হতে বলেন। আহমদিয়া বিদ্বেষীরা জড়ো হলে এক পর্যায়ে নবজাতকের মরদেহ কবর থেকে তুলে কবরস্থানের বাইরের সড়কে ফেলে দেওয়া হয়। কারা এই ঘটনার সাথে জড়িত সে ব্যাপারে কেউই স্পষ্ট করে মুখ খোলেনি। একপর্যায়ে স্থানীয় থানা থেকে পুলিশ আসে এবং তাদের প্রহরায় বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কান্দিপাড়া এলাকায় আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব কবরস্থানে বাচ্চাটার মরদেহ দাফন করা হয়।

শিশুটির বাবা সাইফুল ইসলাম ক্ষোভের সাথে সংবাদমাধ্যমকে জানান, আমি জানতে পেরেছি ঘাটুরার এই কবরস্থানের জায়গাটি একজন হিন্দু ভদ্রলোক দিয়েছিলেন। এরপর থেকে এলাকার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন মারা গেলে এখানে গত ৫০ বছর ধরে দাফন করে আসছেন। যদি তাদের কোনো আপত্তি থাকতো- তাহলে আমাদের বলতে পারতো পরবর্তীতে আর যেন কাউকে এই কবরস্থানে দাফন করা না হয়। কিন্তু দুই দিনের একটা শিশুর মরদেহ কবর থেকে তুলে ফেলে দিবে এটা কল্পনাও করা যায় না। এর বিচার আল্লাহ করবেন।

অদ্ভুত ব্যাপারটি হচ্ছে এই কবরস্থানটির জায়গা দান করেছিলেন ওই এলাকার বিখ্যাত দানবীর পিনাকী ভট্টাচার্য। সনাতন ধর্মাবলম্বী হলেও তার দেওয়া এই জায়গায় তৈরি কবরস্থানে সুন্নীসহ অন্যান্য গোত্র ও আহমাদিয়ারা সবাই কবর দিয়ে আসছিল বলে জানালেন সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নং ওয়ার্ডের মেম্বার মো. মহসিন খন্দকার। তার বাবা মেম্বার থাকাকালে দ্বিখণ্ডিত কবরস্থানটিকে একীভূতও করেছিলেন। এতদিন কোনো পক্ষের মধ্যেই কোন ধরনের সমস্যা না হলেও হঠাৎ করেই গত বৃহস্পতিবার এলাকার প্রায় সকল মসজিদ থেকেই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াবার উদ্দেশ্যে ইমাম ও হুজুরেরা মাইকিং শুরু করেন।

আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের কাউকে কবর দেওয়া যাবে না ঘোষণা দিয়ে তারা সরাসরি বাচ্চাটার লাশ তুলে রাস্তায় ফেলে দেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সেলিম উদ্দিন দুই পক্ষের সাথে আলাপ আলোচনা করে অবশেষে বাচ্চাটার লাশ কান্দিপাড়া এলাকায় আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের কবরস্থানে দাফন করলেও এই ভয়ংকর পৈশাচিক ঘটনা কারা ঘটালো সে ব্যাপারে কোনরূপ তথ্য দিতে পারেননি। সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকায় হয়তো বাচ্চাটার পরিবার এ নিয়ে মামলা করেনি, কিন্তু পুলিশও উদ্যোগী হয়ে আইনি উদ্যোগ নেওয়া কিংবা মামলা কিংবা তদন্তের কোনরূপ চেষ্টাই করেনি!

অর্থাৎ আমরা এমন এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি যখন একই ধর্মের স্রেফ ভিন্ন তরিকার, ভিন্ন চিন্তাধারার হওয়ায় একদল ধর্মান্ধ পিশাচ কবর থেকে সদ্যমৃত নিষ্পাপ বাচ্চার লাশ তুলে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে এবং তাতে আমাদের কারোরই কিছু যাচ্ছে আসছে না। খুব স্বাভাবিকভাবে যেন মেনে নিয়েছি আমরা এই ভয়াবহ ঘটনাটা। কোথায় কে কী লিখলো, কী পরলো, কার সাথে ঘুমালো আর কী মতবাদ সমর্থন করল, তাতে আমরা সোচ্চার শোরগোল তুললেও এই ঘটনায় আমাদের কারো ধর্মানূভুতিতে কোন ধরনের আঘাত লাগেনি।

ধর্মীয় কারণে একজন মানুষের লাশ অবজ্ঞা ভরে কবর থেকে তুলে ফেলার ঘটনাই তো ভয়ংকর অমানবিক, সেখানে একটা নবজাতক শিশু, পৃথিবীতে আসবার পর যার কোন ধর্ম না, বর্ণ না, জাত-পাত কিছুই না, একমাত্র পরিচয় ছিল সে মানুষ, সেই নিষ্পাপ প্রাণকে মরে যাওয়ার পরেও স্রেফ ধর্মীয় কারণে এই চরম লাঞ্ছনা ও অপমান সহ্য করতে হল, এটা ঠিক কিভাবে আমরা মুখ বুজে হজম করে গেলাম, সামান্য প্রতিবাদ জানালাম না, এই ঘটনা ঘটানো নরপিশাচ অমানুষের দলের শাস্তির দাবীতে ভয়েজ রেইজ করলাম না, ব্যাপারটা আসলেই স্তব্ধ হবার মতই বিচিত্র!

একইসাথে যে প্রশ্নটা খুব শক্তভাবে সামনে আসে সেটা হচ্ছে যে বছরের পর বছর যেখানে আহমাদিয়ারা সাধারণ কবরস্থানে কবর দিয়ে আসছিল, কোন ধরনের বাধা কিংবা সমস্যা হলো না, সেখানে হঠাৎ এতদিন পর কেন একসাথে এলাকার প্রত্যেকটা মসজিদ থেকে মাইকিং করে পরিকল্পিতভাবে আহমাদিয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হল? কী কারণে এই চরম আক্রমণাত্মক ও ভয়াবহ নির্দয় আচরণ দেখাবার সাহস পেলো এই ধর্মান্ধরা?

পুলিশ তদন্ত করলে অবশ্যই বেরিয়ে আসতো। তবে গত কয়েক মাস আগে আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এক ভয়ংকর উসকানিমূলক বিদ্বেষ ছড়িয়েছিলেন হেফাজতের ইসলাম বাংলাদেশের আমির দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফী। এ বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে সিলেটের ৪নং খাদিমপাড়া ইউনিয়নের জামেয়া আরাবিয়া ইসলামিয়া ধনকান্দি মাদ্রাসার ২২তম বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলে তিনি উপস্থিত জনগণের সামনে বলেন, “কাদিয়ানী তথা আহমদিয়া মুসলিম জামাতের অনুসারীরা কাফের। এতে কেউ সন্দেহ রাখতে পারবে না। কাদিয়ানীরা যে আকীদা-বিশ্বাস মেনে চলে তা বিশ্বাস করলে কেউ মুসলিম থাকতে পারে না, কারণ তারা মুসলমান নয়। কাদিয়ানীদেরকে যারা কাফের বলে না, তারাও কাফের। তার কোন সন্দেহ নেই। কাদিয়ানীদেরকে কোন মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করা যাবে না। যদি দাফন করা হয় কবর থেকে তুলে নদীতে ভাসিয়ে দিতে হবে।”

ঠিক পড়েছেন, ঠিক এই ভাষাতেই আহমদ শফী আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের লাশ তুলে নদীতে ভাসিয়ে দিতে বলেছিলেন আজ থেকে চার-পাঁচ মাস আগে। আর সেই উসকানির বাস্তবায়ন আমরা দেখলাম গত সপ্তাহেই, একটা নিরীহ নিষ্পাপ বাচ্চার লাশ রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলার মাধ্যমে। ইসলামের অনেকগুলো মাজহাব আছে, ফেরকা আছে, ধারা আছে, তরিকা আছে, দল এবং মত আছে। শুধু ইসলামই না, পৃথিবীর নানা ধর্মেরই এমন নানা ভিন্ন মতাবলম্বী দল মত-পথ ও ভাগ আছে। এখন একটা ধর্মের এক ধরনের মতাবলম্বী দল যদি বাকি মতের ও ধারার দলকে বাতিল ঘোষণা করে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়, তখনই উগ্র অন্ধত্ব গ্রাস করে ফেলতে থাকে সবকিছু।

একটা রাষ্ট্রে প্রত্যেক ধর্মের এবং ধর্মের প্রত্যেক মতের ও পথের মানুষের কারোর ক্ষতি না করে এবং কোন ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী ও জনগণের জন্য ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে জড়িত না হয়ে নির্বিঘ্নে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের এবং না পালনের অধিকার আছে। এবং কেউই কোন যুক্তি বা কারণ দেখিয়েই কাউকে তার ধর্ম ও ধর্মীয় মতাদর্শ পালনে বাধা দেওয়ার অধিকার রাখে না। শুধুমাত্র তারই ধর্ম এবং ধর্মীয় মতবাদ সঠিক আর বাকিদের সব মতবাদ ভুল, সেটা দাবি করে বাকি মত-পথ-ধারার ধর্মাবলম্বীদের একঘরে করবার, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালাবার, কতল করবার বা মারা গেলে কবরস্থানে মাটি দিতে না দেওয়ার হুমকি দেওয়ার অধিকার রাখে না কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীই।

যেকোনো সভ্য সমাজে এটা একেবারেই সাধারণ একটা চাহিদা, ব্যক্তিস্বাধীনতায় বাঁচা এবং বাঁচতে দেওয়া। অথচ কী অবলীলায় আমাদের ধর্মগুরুরা মানুষের এই খুব স্বাভাবিক অধিকারটাও নষ্ট করে দিতে চাইছে, লাশ তুলে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে! হেফাজতের আহমদ শফী কি এই বাচ্চাটার লাশ তুলে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলার ঘটনার দায় এড়াতে পারেন? আহমাদিয়ারা বা অন্য সকল সংখ্যালঘু ইসলামী ধারার অনুসারীরা কারো কোন ক্ষতি না করে স্রেফ ভিন্ন ধারার মতবাদে ইসলাম ধর্ম পালন করলে তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিভিন্ন ধারার সমস্যাটা ঠিক কোথায়?

এই উগ্র দল বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উসকানি ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে তাদের নির্মূল ও দেশছাড়া করার পর যে একই ধর্মের ভিন্ন ধারার অনুসারীদের নির্মূল করা শুরু করবে, সেটা কি আমরা বুঝতে পারছি? প্রকাশ্যে এমন ভয়াবহ উসকানি ও হুমকি দেবার পরেও আহমদ শফীর বিরুদ্ধে কি কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? ঘাটুরা এলাকায় এতদিন সকল ধারার মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান বজায় থাকলেও হঠাৎ করেই কারা বিদ্বেষ ছড়াতে শুরু করলো? কবরস্থান থেকে লাশ তুলে ফেলার সাহস দেখালো কারা? এরা যে ভবিষ্যতে আহমাদিয়াদের নির্মূলে আরও ভয়াবহ কোন ঘটনা ঘটাবে না, তার নিশ্চয়তা কি?

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে না কেন সেটা নিয়ে সোচ্চারকন্ঠে প্রতিবাদ কবে জানাবো আমরা?

লেখক: অ্যাক্টিভিস্ট

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামে আগুনে পুড়ল ৫ দোকান
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৩৪

আরো

সম্পর্কিত খবর