Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মাতৃমৃত্যু দর্শন


২৫ জুলাই ২০২০ ২০:২১

যদি কোন স্বর্গীয় দূত এক হাতে  স্বর্গ ও অন্য হাতে শৈশব নিয়ে এসে আমাকে বলে –বলো কোনটা নিবে? আমি বিমুগ্ধ চিত্তে শৈশব নিয়ে নিবো। অবশ্য, শৈশবের প্রতি এই অনুভূতির মূলে আছেন মা। এটা সম্ভবত সবার ক্ষেত্রেই এক। অনেকেই বুঝতে পারে; আবার কেউ কেউ পারেনা। আজ থেকে প্রায় বারো বছর আগে প্রকাশিত একটা লেখায়  আমি আমার সাড়ে তিন বছর বয়সী শৈশবের স্মৃতিচারণ করেছিলাম। আর তা ছিল মাকে ঘিরেই। তবে পরে গবেষণা করে দেখেছি, মায়ের সাথে আমার স্মৃতির কথা মনে আছে এরও আগে থেকে। যেমন, বয়স যখন দুই  তখন বন্ধু মাসুদের সাথে আমার একবার মারামারি হলো। মা মাসুদকে আদর করে কোলে নিয়ে আমাকে হালকা ঝাড়ি দিলেন। ঘরে এসে আমাকে বুঝালেন- তুমি ওর সাথে আর কখনো এমন করবেনা, কারণ ওর মা নেই। আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম- ওর মা কোথায় মা? মা একটু চুপ থেকে বলেছিলেন –মারা গেছে। আমি ফের প্রশ্ন তুললাম- মারা গেলে এখন কোথায়? মা শান্তসুরেই বললেন – আল্লার কাছে।

বিজ্ঞাপন

এরপর থেকে মাসুদ আমার খুব ভালো বন্ধু। আমার জীবনের প্রথম বন্ধু সেই মাসুদই। বয়স যখন তিন চারে আসল। তখন প্রতিদিন মাসুদের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতাম- এটা কিভাবে সম্ভব? ও থাকে কি করে? আমারতো মা একটু চোখের আড়াল হলেই দম আটকে যায়, মনে হয় পৃথিবীটা শূন্য। মাঝে মধ্যেই মাকে জিজ্ঞেস করতাম- মাসুদ ওর মাকে ছাড়া কিভাবে থাকে মা? মা বলতেন- আল্লাহই ব্যবস্থা করেন, ওর মনকে ভুলিয়ে রাখেন;  তাছাড়া ওর তো কোন কিছু মনে নেই। তখন কত কথা হতো মার সাথে, হাজার হাজার প্রশ্ন। মা রান্নাবান্না আর গেরস্থালীর কাজ কর্ম করার মধ্যেই জবাব দিতেন। মাঝে মধ্যে তো বিরক্ত হতেনই।

বিজ্ঞাপন

আমাদের রান্না ঘরের উপরে একটা বড় কড়ই গাছ ছিল। ওটাতে কাকসহ বিভিন্ন পাখি এসে বসত। কাক এসে ডাকাডাকি করলেই মা বলতেন – ঐ কাউয়া আল্লাহরে ডাক। কাক কা কা করতেই থাকত।  ঐ সময়  বয়স দুই এরও নিচে। একবার আমার জ্বর হলো। রাতে জ্বর বেড়ে গেলে মা আমাকে চেপে ধরে বললেন- মনে মনে আল্লাহরে ডাকো বাবা। আমি বুঝতেছিনা আল্লাহরে কিভাবে ডাকে। আমি লজ্জায় প্রশ্নও করতে পারিনা। মনে মনে কা কা করতে থাকলাম। কারণ মা যখন কাককে বলেছিলেন, কাকতো তখন কা কা করেতেছিল। মা বিরক্ত হবেন ভেবে শৈশবে এমন অনেক সহজ প্রশ্নের উত্তরের জন্য মাকে জিজ্ঞেস করতামনা, নিজে নিজেই মিলিয়ে নিতাম।

মা তার শেষ সময়টা কাটিয়েছেন আমার সাথে। এ সময় মা আমাকে ঐরকম প্রশ্ন করতেন। আমি পড়াশুনায়   বেশী মনোযোগী থাকলে মাঝে মাঝে চুপ থাকতাম, কখনোবা বিরক্ত হতাম। বেশী বিরক্ত হলে মা রাগ করতেন। একদিনতো বলেই ফেললেন, আমি তোর বাসায় থাক্মুনা । আমি হাসি দিয়ে বললাম, আমার আবার বাসা এলো কোত্থেকে মা! পোলাপাইনের বাসা হয়? বাসার মালিকতো হন মা-বাবারা। এটা আপনার বাসা বলেই তো আপনি এত স্বাধীন এখানে। মা তখন মুচকি হাসি দিয়ে টিভির সাউন্ড বাড়িয়ে দিলেন। মার  সাথে আরেকটা বিষয় নিয়ে বাঁধতো। আর তা হলো হাত ধোয়া। মাঝে মধ্যে এমন হতো যে- মা এই মাত্র হাত ধুয়ে এসেছেন ; কিন্তু আমি দেখিনি।  তাই, আমাকে দেখানোর জন্য আবার হাত ধুইতে হতো। আমি  বলতাম,   ‘আঙ্গুলের মাথা দিয়ে সবকিছু ধরা হয় তাই আঙ্গুলের মাথা বেশী করে ধুইবেন’।  আর তাই  ধুয়ে এসে বলতেন, নে তোর আঙ্গুলের মাথা, ধুইছি মাথা, হইছে এইবার মাথা ঠিক, পাগল? ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে মা মাঝে মাঝে রাগ হয়ে বলতেন তোর ওইসব ইউ,সি,এল, অক্সফোর্ডের বেইল নাই। আমি তখন হেসে বলতাম, ‘তাতো জানি মা, আমরা গরীব মানুষ, আপনি হলেন জমিদারের নাত্নি। ব্রিটিশ আমলে আরিফ উল্লাহ  মাস্টর আপনারে ডাবল প্রমোশন দিছিলো। আমরা কি আর আপনার মতো অত বুদ্ধি রাখি মা?’ তখন এই  অগ্নিশর্মা চোখেও মিট করে হেসে দিতেন মা। মা বলেছিলেন, যদি ছোট বেলায় বিয়ে না হয়ে যেত তবে চারুকলায় পড়তেন।  মা’র পছন্দের সব গান মনে আছে – ওরে পাষাণী আমার চোখেরও পানি, মধু মালতি ডাকে আয়, তোমারও লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে কিংবা বিভিন্ন যাত্রাপালার গান যেমন গুনাই বিবি  ও রহিম বাদশা-রূপবান কন্যা।

গত ১০ জুলাই ছিল বাবার ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৭ সালের ২৫ জুলাই “বাবার অচিন দেশ ভ্রমণ” নামে আমার একটা লেখা প্রথম আলো প্রকাশ করেছিল।  আজ ২৫ জুলাই। গত বছর এই দিনেই পৃথিবী থেকে মা’র শারীরিক প্রস্থান ঘটে। এটা শুধু শারীরিক প্রস্থানই, কারণ মায়েদের মৃত্যু হয়না। আমাদের নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে, কথার সুর, টান, লয়ে নিত্যকার কাজেকর্মে  মা আছেন, বাবাও আছেন, তবে কম। আমরা যারা এটা উপলব্ধি করতে পারিনা তারা দুর্ভাগা। কারণ, সন্তানের অস্তিত্বের সাথে মায়ের ভালোবাসা যেভাবে মিশে থাকে তা প্রাকৃতিক। যারা এই প্রাকৃতিক নিয়মকে এড়িয়ে যায় তারা স্বাভাবিক জীবনে নেই। তাদের জীবন অস্বাভাবিক, বিকৃত। এই করোনাকালে টাঙ্গাইলের সখীপুরে যে সন্তানেরা মাকে বনে রেখে এসেছে তারা বিকৃত জীবনের চর্চাকারী। আপনি ভোরে ঘুম থেকে উঠে জানালা খুলে যে পাখিটা বা বিড়ালটা দেখতে পান ওরাও তাদের মায়ের সাথে এমন করেনা।

একটি মা বিড়ালের গল্প শুনুন। দুষ্টু ছেলেরা ঐ বিড়ালটির তিনটি বাচ্চা চুরি করে কয়েক মাইল দূরে ফেলে দিয়ে আসে। বিড়ালটি অন্ততঃ ১৫ দিন কেঁদে কেঁদে দিন-রাত পার করেছে। খাবার দিলে খেতে এসেছে, কিন্তু যখনই দেখেছে বাচ্চারা খেতে আসেনি; সে দৌড়ে আবার চলে যেত ঘরের পিছনে, দূরের রাস্তায়, সর্বত্র   কাঁদতে  কাঁদতে বাচ্চাদের খুঁজত। ভুলে যেত খাবারের কথা। তিন-চারমাস পরেও বিড়ালটি ওই বাচ্চাদের   ভুলতে পারেনি। পরে চারমাস পর দেখা গেল একে একে ঐ তিনটি বাচ্চাই ফিরে এসেছে, ওরা বড় হয়ে গেলেও সবাই সবাইকে চিনতে পারলো; কি যে আনন্দ! সেই আনন্দ ভাইরাসের মতো ছড়ালো আমার ভিতরে। এই হলো মা ও সন্তানের স্বাভাবিক ভালোবাসার গল্প। এটা সব প্রাণীদের ক্ষেত্রেই এক, সার্বজনীন। আমরা বাস্তবতার দোহাই দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের আবরণে এই স্বাভাবিক ভালোবাসার উপলব্ধিকে এড়াতে গিয়ে  পক্ষান্তরে স্বাভাবিক জীবনকেই এড়িয়ে চলি।

২০০৭ সালের ১০ জুলাই বাবা যখন মারা যান আমি তখন লন্ডনে। আমার পড়াশুনার ক্ষতি হবে ভেবে আমাকে মৃত্যু সংবাদ দেয়া হয় পাঁচদিন পর। বাবার মৃত্যু না দেখে আমার অবশ্য একটা লাভ হয়েছে, আমি একটুও কাঁদিনি, আসলে কাঁদতে হয়নি। কারণ, আমি ভেবে নিয়েছি বাবা মারা যায়নি। এখনো ভাবি, আছে বাড়িতেই; হয়তো বাজারে, মসজিদে বা অন্য কোথাও। বাবার মৃত্যুর পর আমার দুই ভাই পর পর মারা গেছেন। আমি দুবারই দেশে এসেছি। শেষের জন পিঠাপিঠি ভাই ক্রীমরুল (কামরুল)। ওর অসুস্থতার কথা শুনা মাত্রই চলে এসেছি। মৃত্যু অবধি পাশেই ছিলাম।  দিল্লি থেকে এম্বুল্যান্সযোগে আসার পথে কানপুরে হলো মৃত্যু, তখনও পাশে ছিলেন মা। কানপুরের সবুজ বনানী আমার মায়ের দুঃখ দেখে কেঁদেছে। হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি মৃত্যু কি জিনিস! সর্বশেষে চতুর্থ যাত্রী হয়ে চলে গেলেন মা। মা চলে যাওয়ার  প্রথম তিন-চারমাস শুধু স্মৃতি আর স্মৃতি। স্মৃতি মানেইতো ওই সময়টাকে পেতে চাওয়া। কিন্তু যখন ভাবনায় আসতো নেই, তখনি বুক আড়ষ্ট হয়ে আসতো কান্না। তবে ছয়মাস পর আমার একটা অনুভূতি এসেছে;  হতে পারে তা আধ্যাত্মিক বা কি বলা যায় জানিনা। আমার মানসিক শক্তি বেড়ে গেছে। আমার মনে হতে থাকে উপড়ে আমার কোন শক্তি আছে, যা আমার উপর নিয়ত ছায়া হয়ে আছে।  সনাতন ধর্মানুসারীরা কি এজন্যই মা সরস্বতী, মা লক্ষীসহ সব দেবীদেরকে মা বলে ডাকেন? মনে হয়।

বয়স যখন চার-পাঁচ তখন পূর্ণিমা এলে আমি আর ঘরে থাকতাম না। উঠোনে হেঁটে চাঁদের দিকে চেয়ে চেয়ে ছড়া মুখস্ত করতাম। দেখতাম চাঁদটা কিভাবে আমার সাথে সাথে হাঁটে। একদিন আমি ঘরে গিয়ে ব্যস্ত মাকে টেনে নিয়ে উঠোনের উপর দিয়ে দৌড়ে বড় রাস্তা পর্যন্ত চলে গেলাম। মা প্রথমে না বুঝে রাগ হলেন। পরে  দুই পুকুরের মাঝে গাছগাছালি ঘেরা আল দিয়ে দৌড়ানোর সময় গাছের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদটা দেখিয়ে বললাম মা , মা, ঐ যে, ঐ যে চাঁদটা কিভাবে আমার সাথে দৌড়াচ্ছে! মা হাসলেন। বড় রাস্তায় গিয়ে মা আমাকে  ধপ করে কোলে তোলে বললেন, কই আমার সাথে তো দৌড়ায়না বাবা, তুমিতো চাঁদ তাই চাঁদটাও চাঁদের সাথে  দৌড়ায়। আমি মিটিমিটিয়ে হাসলাম।

ঐসব স্মৃতি হাতড়াতে গেলে এখন আর কান্না আসেনা, কারণ আমি সহাস্যে উপস্থিত হতে পারি সেই শৈশবে।  এখন মা আছেন এক অবাক করা সৌন্দর্যের দেশে, অশেষ সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্যে। শুভ্র সকালের একঘণ্টা বয়সী সূর্য যখন পৃথিবী জুড়ে স্বাপ্নিক আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়, কালো মেঘ ঝড়ে গেলে ছড়িয়ে থাকা সাদা মেঘেরা যখন দুপুরের প্রশান্ত ধোয়া আকাশকে সৈকতের সাজে সাজায়  এবং ত্রয়োদশী, চতুর্দশী কিংবা পঞ্চদশী চাঁদ যখন রাতের আকাশকে স্বর্গোদ্যান বানায় তখন আমি দেখতে পাই চলন্ত আনন্দ জাহাজ , ‘শীপ অব পিস’। ঐ আনন্দ জাহাজে বসে হাত নেড়ে নেড়ে মা আমাকে ডাকেন, কথা বলে্ন, আমার খোঁজ খবর নেন।

লেখক: প্রধান নির্বাহী – ফুল-পাখি-চাঁদ-নদী রিসার্চ এন্ড অ্যাডভোকেসি ফোরাম

রাশেদ রাফি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর