Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রকৃতিকে ভালোবাসুন


২৮ জুলাই ২০২০ ১১:২২

ইমরান হুসাইন

আজ ২৮ জুলাই, “বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস” বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ দিবসটি খুবই গুরুত্বপূর্ন। প্রকৃতি হলো সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। আর তাই প্রকৃতি সংরক্ষণ হলো ইবাদতের সামিল। শুধু তাই নয়, সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত স্বাভাবিক ও নৈসর্গিক বস্তুকে সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

প্রকৃতির অনুকূল পরিবেশ মানুষের জীবন ও অস্তিত্বের পক্ষে সহায়ক। নির্মল বাতাস, বিশুদ্ধ পানি ও পর্যাপ্ত খাদ্য সুস্থ ও সুন্দরভাবে মানুষকে বাঁচাতে সহায়তা করে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে ও মানুষের লাগামহীন দূষণমূলক কর্মের ফলে প্রতিনিয়তই ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি। যেই পরিবেশ মানুষকে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে নিজের সবটুকু দিয়ে লালন পালন করছে এই সমাজের মানুষকে, অন্যদিকে সেই মানুষগুলোই নির্মমভাবে, নির্বিচারে ধ্বংস করছে প্রকৃতি। ফলে প্রকৃতি দিন দিন ব্যাপক ভয়ানক রুপ ধারণ করছে।

বাতাসে ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে লাগামহীনভাবে। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীর জলহাওয়া। শুধু তাই নয়, পরিবেশ দূষণের ফলে জলজ প্রাণীদের জলে থাকতে কষ্ট হয় কারণ তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পায় না। উদ্ভিদরা সতেজ থাকতে পারছে না। বন জঙ্গল অবাধে উজাড় হচ্ছে ফলে বাসস্থান সংকটে পড়ছে বন্য প্রানীসমুহ। আর পরিমন্ডলের এই সমস্ত কিছু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ।

এভাবে চলতে থাকলে প্রাণীজগত একদিন প্রায় শেষের পথে চলে যাবে বলে বিজ্ঞানীদের সতর্কতা। তাই সর্বস্তরে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার সচেতনা বৃদ্ধির লক্ষেই বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয়ে থাকে সকল দেশগুলোতে সরকারী ও বেসরকারি উদ্যোগে।

বিজ্ঞাপন

পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাবে অনেক বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, দাবানল, সুনামি, খরা প্রভৃতির মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগের হার বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বেড়েই চলেছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা যে কারণে তলিয়ে যাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো।

এ বিষয়ে ২০০৭ সালে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেলে বলা হয়েছিল, ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গপোসাগরের পানির উচ্চতা ১ মিটার পর্যন্ত বাড়বে। ফলাফল- মালদ্বীপ নামক দেশটা পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের উপকূলের ১৭ শতাংশ ভূমি চলে যাবে সমুদ্র গর্ভে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে বাড়ছে লবনাক্ততা ও বাড়ছে বন্যা। মাটির গভীরে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির সংকট। ঋতু বৈচিত্র‍্যের ওপর পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে মারাত্মক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে সাম্প্রতিক কালে।

পরিবেশ দূষণের হাত থেকে বিশ্বকে বাঁচিয়ে পরিবেশকে সংরক্ষণ করার অঙ্গীকার নিয়ে জনসচেতনতার মাধ্যমে প্রকৃতি সংরক্ষণের সচেতনতার লক্ষ্যে প্রতিবছর ২৮ জুলাই দিবসটি বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। আজকের এই দিনটি কোনো আনন্দের বা উৎসবের দিন নয়। আজকের এই দিনে উপলব্ধি করতে হবে বিশ্ব পরিবেশ সম্পর্কে ও পরিবেশের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে। আজ সবচেয়ে জরুরি বিশ্বের সকল মানুষকে বিশ্ব পরিবেশ ও পরিবেশের গুরুত্ব সম্পর্কে জানানো। আজকের এই দিনটি শুধুমাত্র নিছক কিছু কর্মসূচির জন্য নয়। সবাইকে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে তোলাই মূল লক্ষ্য। তাহলে দিনটি আরো তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবছর নানা রকম প্রাকৃতিক দূর্যোগের কবলে পড়ে নানা রকম ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাদের। ঝড়, বৃষ্টি, অগ্নুৎপাত, বন্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছে আমাদের। পরিবেশে নেমে আসছে বিপর্যয়। এসব বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমাদের কিছুটা রক্ষা করতে পারে বনভূমি কিন্তু দিনের পর দিন আমরা নির্বিচারে তাও নষ্ট করে ফেলছি। যা আমাদের জন্য ভয়ংকর বার্তা বয়ে আনতে পারে। বর্তমান সময়ে লক্ষ্য করা যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বন্যায় কবলিত। যা প্রকৃতির উপর অত্যাচার, অবিচার ও যথাযথভাবে সংরক্ষণ বা ব্যবস্থা না নেওয়ার ফল।

প্রকৃতিকে সতেজ বা সংরক্ষণ করতে হলে প্রয়োজন বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা। যে পরিকল্পনার মাধ্যমে সবাইকে প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে সবাইকে সচেতন করে গড়ে তুলতে পারে। যদি আমাদের সমাজ তথা দেশের মানুষ এ সম্পর্কে সচেতন না হয় তাহলে এসব কর্মসূচি অবশ্যই বৃথা। এখনও বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে পরিবেশ রক্ষায় স্পষ্ট কোন ধারণা না আসায় পরিবেশ রক্ষায় দ্বায়িত্বপালনে তারা উদাসীন। এখনও বন-জঙ্গল নাশে উৎসাহী মানুষ। যার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়তই। পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অরণ্য ধ্বংস না করা, ভূমিক্ষয় রোধ করা।

একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রোধ করার জন্য প্রয়োজন মোট ভূমির শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে মোট ভূমির মাত্র প্রায় ১৬ ভাগ বনভূমি আছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।তবে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৯ ভাগ এবং ওয়াল্ড রিচার্স ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী ৫ ভাগ এবং দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ৩.৫ ভাগ। ফলে পরিবেশে দেখা দিয়েছে বিরুপ প্রভাব। সময়মতো বৃষ্টি নেই, রোদ নেই।অনিয়নে চলছে ঘূর্ণিঝড়, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তান্ডবে এলোমেলো হয়ে গেছে সারাদেশ। যার শক্তি হ্রাস পেতে থাকে বনভূমির কারনে। এ কথা সত্য যে, বনভূমির পরিমান কমার কারনে ক্রমেই প্রবল আকার ধারণ করছে প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো।

আমাদের চির পরিচিত সংজ্ঞা যে, আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে সবকিছু নিয়েই আমাদের পরিবেশ। অর্থ্যাৎ গাছপালা, নদী-সাগর, মাটি, পানি, বায়ু সবকিছুই পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত। আর পরিবেশের স্বাভাবিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে পরিবেশ দূষণ বলে। পরিবেশ দূষণের ফলে আমাদের জীবনযাত্রা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন, কারখানার কালো ধোয়া বায়ু দূষণ করছে। বায়ুদূষণের ফলে দূষিত বায়ু প্রবেশ করে শ্বাসনালীকে বিষাক্ত করছে। ফলে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধী তৈরি হচ্ছে। পরিবেশ সংরক্ষণ করতে হলে কলকারাখানার কালো ধোয়া নির্গত বন্ধ করতে হবে। মুলত পরিবেশের এই উপাদানগুলোর সুষম ব্যবহারই পারে পরিবেশকে দুষণ মুক্ত রাখতে আর পরিবেশ দুষণ রোধ হলেই প্রকৃতি আবার তার সতেজ রুপ ফিরে পাবে।

পরিবেশকে দুষণ মুক্ত বা সব ধরণের ধ্বংসাত্মক থেকে সুরক্ষা রাখতে বিভিন্ন রকম প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তাহলেই পরিবেশকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল ও সুরক্ষিত রাখতে সবাই সচেতন হবে। এছাড়া কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করা অপরিহার্য; যেমন, বনভূমি ধ্বংস কঠোরভাবে রোধ করতে হবে। ব্যাপকভাবে বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে।

বর্তমান জ্বালানী পরিবর্তন করে বাতাস, সৌর ও পানি বিদ্যুৎ এর মতো পূনঃব্যবহার যোগ্য জ্বালানির প্রচলন করতে হবে। শিল্প কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ পরিশোধনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে হবে। কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক সারের ব্যবহার কমাতে হবে এবং পরিবেশ দূষণ রোধের কাজকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে।

সর্বপরি একটাই কথা, প্রকৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব কেবল সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো সংস্থার একার নয়। এ দায়িত্ব প্রতিটি ব্যক্তির বা প্রতিটা নাগরিকের। কেননা বাংলাদেশের সংবিধানে ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, “রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ জীববৈচিত্র, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবে।”

সংবিধান রক্ষার অঙ্গীকার সবার মধ্যে থাকতে হবে। তাই সবাই সচেতন হই, প্রকৃতিকে রক্ষা করি।

“প্রকৃতিকে ভালোবাসুন, প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করুন” অন্তত এটা মনে রাখুন যে, আমরাই প্রকৃতি আর প্রকৃতির মাঝেই আমাদের বসবাস। বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবসে এটাই হোক সবার প্রত্যয়।

লেখক: শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস