বাঘের ভবিষ্যৎ মানুষের হাতেই
২৯ জুলাই ২০২০ ১৪:০৫
মাহাবুব মাসফিক
এক সময় পৃথিবী ছিল অরণ্যের। অরণ্যের অন্য প্রাণীর সঙ্গে সমভাবে টিকে থাকতো মানুষও। লড়াই করে, খাবার ভাগাভাগি করে। সময় যত গড়াল, মানুষ নামের বুদ্ধিমান প্রাণীর প্রজাতিটি আস্তে আস্তে দখল করে নিলো সব। সাগরের তলদেশের কিছু অংশ বাদে এই নীল গ্রহের প্রায় প্রতিটি কোণে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে এই মানুষ প্রজাতিটি। এই একাধিপত্যের জেরে সবুজ পৃথিবীর আদিম সকল বাসিন্দারা হয়ে পড়লো কোণঠাসা। একসময় যাদের পরাক্রমে গুহায় বসবাস করতো মানুষ প্রজাতি, রাত হলেই জ্বেলে রাখতো আগুন- সেই ‘ভয়াল’ প্রজাতিগুলোকেই আজ চিড়িয়াখানায় পুরে দেখতে যায় মানুষ! এই মানুষের আগ্রাসনে আজ প্রথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে হাজারো প্রাণীর প্রজাতি।
বাঘ- যার এক থাবায় মানুষের মাথার খুলি ডিমের খোসার মতো গুড়িয়ে যায় সেই ব্যাঘ্র প্রজাতিও আজ এই ধরীত্রিতে টিকে আছে কেবল মানুষের অনুকম্পায়। তাই এই কথা বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না যে, বাঘের ভবিষ্যৎ এখন মানুষের হাতেই! আমাদের দেশে একটা কথা বেশ প্রচলিত – ‘বাঘ বাঁচলে বাঁচবে বন, রক্ষা পাবে সুন্দরবন।’ তবে শুধু সুন্দরবনই নয়, বন্য প্রাণী বাঁচলে বাঁচবো আমরাও৷ পৃথিবীর জন্য, পরিবেশের জন্য, মানুষের জন্যও তাদের বাঁচিয়ে রাখা দরকার৷
আজ ২৯ জুলাই। বিশ্ব বাঘ দিবস। বাঘের বিচরণ আছে এমন ১৪টি দেশে একযোগে পালিত হচ্ছে দিবসটি। ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে ১৪টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনে বাঘ সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করা হয়েছিল। এরপর থেকেই প্রতিবছর ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস পালন করা হয়। যদিও গত দশ বছরে পৃথিবীর আরো একটি দেশের প্রাকৃতিক বন থেকে হারিয়ে গেছে বাঘ। দেশটির নাম কম্বোডিয়া।
বর্তমানে বাংলাদেশসহ মাত্র ১৩টি দেশে বাঘের অস্তিত্ব রয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, বার্মা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ভুটান, নেপাল, চীন ও রাশিয়ায় বাঘের অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে ভিয়েতনাম ও লাওসে বাঘ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব বাঘ দিবস। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন বেসরকারী পরিবেশবাদী সংগঠন বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করছে। এ বছরে দিবসটির প্রতিপাদ্য, ‘বাঘ বাড়াতে করি পণ, রক্ষা করি সুন্দরবন’। করোনার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে বন বিভাগ সুন্দরবনের ৪টি রেঞ্জে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
জানা গেছে, ওয়েবিনারে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। আলোচনায় অংশ নেবেন পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রীসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
চলতি বছরে বাঘ দিবসে বাংলাদেশের জন্য আছে সুখবর। বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে গত ৩ বছরে বাঘের সংখ্যা ১০৬ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৪টি। অর্থাৎ ৩ বছরে সুন্দরবনের বাঘ বেড়েছে ৮টি। দেশের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ জরিপ চালিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে বন অধিদফতরে জমা দেয় গত ১৯ মার্চ। তারই ধারাবাহিকতায় ২২ মার্চ গবেষণা প্রতিবেদনটি পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ে। বন বিভাগের তথ্য মতে, বাঘ আছে এমন দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থান এখন সপ্তম।
গত ১০০ বছরে বিশ্বের নানা বনাঞ্চল থেকে বাঘের সংখ্যা এক লাখ থেকে কমে চার হাজারেরও নিচে দাঁড়িয়েছে। একটা সময় ৯টি প্রজাতির বাঘ পাওয়া যেত। এখন সেই সংখ্যা কমতে কমতে ৬টিতে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনটি বিলুপ্ত প্রজাতি ছাড়াও সাম্প্রতিককালে দেখা মেলেনি সাউথ চায়না বাঘেরও। সারা বিশ্বে বন উজাড়, শিকারি ও পাচারকারীদের কারণে বাঘ মহাবিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বাংলাদেশে বাঘের একমাত্র আবাসস্থল সুন্দরবনে চোরা শিকারি চক্র এবং জলদস্যু-বনদস্যুদের তৎপরতার কারণে কয়েক বছর আগেও অনেকটা হুমকির মুখে ছিল বাঘ। আশার কথা হলো, বাঘকে নিরাপত্তা দিতে বন বিভাগ নানা পরিকল্পনা নিয়ে ‘বাঘ সংরক্ষণ’ নামে একটি প্রকল্প তৈরি করেছে বলে জানা গেছে। যেটি অচিরেই বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আমাদের সবারই জানা, সুন্দরবনে কিছুদিন আগেও বন্দুক যুদ্ধ ও বনের অভ্যন্তরে অপহরণের মতো নানা ঘটনা ঘটতো। বর্তমানে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সেসব কমেছে বটে কিন্তু পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। এখনো অনেক ধরনের অপরাধ সেখানে সংঘটিত হয়। কাঠ আহরণ, মধু আহরণ, গোলপাতা সংগ্রহ, মাছ ধরার জন্য বনে প্রবেশ করে মানুষ। ফলে মানুষ ও বাঘের মধ্যে সংঘর্ষ বাড়ছে। মারা যাচ্ছে বাঘ। অন্যদিকে হরিণ শিকার ও অন্য বন্যপ্রাণী হত্যার কারণে বাঘের খাবারের অভাব দেখা দিচ্ছে। ফলে খাবারের অভাবে অনেক সময় বাঘ সুন্দরবনের আশেপাশের গ্রামগুলোতে প্রবেশ করে গৃহপালিত পশুদের উপর হামলা করছে। ফলে বাড়ছে বাঘ হত্যা। গত ২০ বছরে প্রায় ৩৮টি বাঘ হত্যা করা হয়েছে।
এছাড়াও বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ায় আরেকটি কারণ হলো, বাঘের মধ্যে ইনব্রিডিং হবার সম্ভাবনা বাড়ছে। ফলে জিনগত বৈচিত্র্য কমে যাওয়ার এবং মরণজীন প্রকাশ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। ফলে বাড়বে বাঘের মৃত্যুহার। আশার কথা হলো, বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়ানোরও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাঘিনী ও বাঘের অনুপাত থাকার কথা চারের বিপরীতে এক। কিন্তু এখন তা আছে দশের বিপরীতে এক।
সংবাদমাধ্যমে পাওয়া তথ্যের সূত্রে জানা গেছে, বাঘ বাঁচাতে সুন্দরবনের ৬০ কিলোমিটার এলাকায় এবার প্রথমবারের মতো নাইলনের নেট বসাতে যাচ্ছে বন বিভাগ। এর মধ্যে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের জয়মনির ঘোল থেকে দাসের ভাড়ানি পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার এবং পশ্চিম বন বিভাগের আওতায় কইখালী থেকে কদমতলা পর্যন্ত বাকি ২০ কিলোমিটার বসানো হবে। পাশাপাশি বাঘের সংখ্যা বাড়াতে ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। বন বিভাগ জানিয়েছে, চলতি বছরের মধ্যে অনুমোদন পেলে ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ করা যাবে প্রকল্পটি।
বন বিভাগের সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে বাঘের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির হার খুবই কম। এর প্রধাণ কারণ সেখানে স্ত্রী বাঘের তুলনায় পুরুষ বাঘ খুবই কম। পশ্চিম থেকে পুরুষ বাঘ ধরে পূর্ব বন বিভাগে স্থানান্তরের জন্য একটি আধুনিক প্রযুক্তির লঞ্চ কেনা হবে।
বিশেষজ্ঞের ধারণা, বাঘের অস্তিত্ব রক্ষায় বাঘের অন্যতম প্রধান হুমকি চোরা শিকারিদের বাঘ হত্যা ও পাচার, বনের ভেতর দিয়ে লাগামহীনভাবে নৌযান চলাচল, সুন্দরবনের পাশে বৃহৎ আকার শিল্প অবকাঠামো নির্মাণ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লোকালয় সংলগ্ন খাল-নদী ভরাট ইত্যাদি।
সুন্দরবনে বাঘের শিকার প্রাণীর মধ্যে চিত্রা হরিণ, শুকর ও বানর রয়েছে। বাঘের সংখ্যা বাড়াতে হলে শিকার প্রাণীর (হরিণ) সংখ্যা বাড়াতে হবে। এখনই সবাইকে আমাদের জাতীয় প্রাণী বাঘ সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় এ বিপন্ন প্রাণীটি আমাদের দেশ থেকে অচিরেই হারিয়ে যাবে। তাই বাঘ রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই।
লেখক: সংবাদকর্মী