ঈদের সময় টাকা লেনদেনে সাবধান
২৯ জুলাই ২০২০ ১৫:১৪
আসছে পবিত্র ঈদ-উল-আজহা। ঈদের আগে সাধারণভাবেই ব্যাংকে গ্রাহকদের ভিড় বেড়ে যায়। অনেকের নগদ টাকার প্রয়োজন হয়। অনেকেই আবার হাতে থাকা অতিরিক্ত টাকা ব্যাংকে জমা দিতে যান। এই ভিড়ের মধ্যেই অনেক সময় সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র লুকিয়ে থাকে। এদের থেকে অবশ্যই আপনাকে সাবধান থাকতে হবে। না হলে আপনার কষ্টের টাকা প্রতারক চক্রের হাতে চলে যাবে।
প্রতারণার একটি নমুনা আপনাদের কাছে তুলে ধরছি। ঘটনাটি ভুক্তভোগীর কাছ থেকে জানা। গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পর ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই একটি ব্যাংকে গিয়েছিলাম। শাখা ব্যবস্থাপক পূর্ব পরিচিত। তার চেম্বারে বসার কিছু সময় পরে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক (বয়স সত্তরের ওপরে হবে) আসলেন। জানালেন, তার টাকা একজন চালাকি করে নিয়ে গেছে। ঘটনাটি জানার আগ্রহ হলো। কিভাবে নিয়ে গেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গতকাল দুপুরে আমি ব্যাংক থেকে ১ লাখ টাকা উঠিয়ে পাশের চায়ের দোকানে গেলাম। সেখানে এক কোণায় টাকাগুলো গুনছিলাম। তখন এক লোক আমার কাছে এসে বললো, চাচা আপনার কাছে তো সব ১০০০ টাকার নোট। আমি ঢাকা যাবো, আমার কাছে ৫০০ টাকার নোট আছে। আপনি যদি বড় নোট দিয়ে ছোট নোট নেন, তবে আমার অনেক উপকার হবে। আমি ব্যাংক থেকে তোলা টাকাটা ঐ লোককে দিয়ে ৫০০ টাকার নোটের দুইটি বান্ডেলে এক লাখ টাকা তার কাছ থেকে নিলাম। লোকটি আমাকে চা-বিস্কুট খাওয়ালো। আমার সঙ্গে দশ বছরের নাতি ছিল। তাকেও চিপস কিনে দিল।’
ম্যানেজার: আপনি সেই টাকা গুনে নেননি?
ভদ্রলোক: আমি তো গুনি নাই। সেই লোক আমার সামনে তার সেই টাকা গুনে দিয়েছিল।
ম্যানেজার: তাহলে সমস্যা কোথায়?
ভদ্রলোক: গতকাল রাতে যখন টিনের দোকানে টিনের দাম দিতে যাবো, তখন মেয়েকে বললাম তিরিশ হাজার টাকা দাও। মেয়ে টাকা গুনতে গিয়ে দেখে, ৫০০ টাকার মধ্যে ১০০ টাকার নোট ঢুকানো।
ম্যানেজার: কি বলেন! তারপর?
ভদ্রলোক: একটি বান্ডেলে ৪০ টা ১০০ টাকার নোট ঢুকানো ছিল। আর অন্য বান্ডেলেও ৪০ টা ১০০ টাকা নোট ছিল।
ম্যানেজার: তার মানে ৮০ টা ৫০০ টাকার নোটের জায়গায় ১০০ টাকা ছিল। আপনার তো ৩২,০০০ টাকা ক্ষতি হয়ে গেল।
ভদ্রলোক: ছেলেটার এত কষ্টের টাকা!
ম্যানেজার: সব ঘটনা তো ব্যাংকের বাইরে ঘটেছে। চায়ের দোকানও একটু দূরে। এখন আমি কি করতে পারি বলেন?
ভদ্রলোক: আমি যখন ব্যাংকে ছিলাম, তখন ঐ লোককে আমি ব্যাংকের ভেতর দেখেছিলাম। আপনি একটু ক্যামেরায় দেখে দেন।
ম্যানেজার: আপনি বসেন। আমি দেখাচ্ছি।
পুরো ঘটনাটি শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। তবে এরকম ঘটনা আমাদের চারপাশেই ঘটছে। হরদম ঘটছে। হয়ত প্রেক্ষাপট ভিন্ন। প্রতারণার ধরণে তারতম্য থাকে। কিন্তু প্রতারণা তো প্রতারণাই। সারারণ, নিরীহ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রতারণা বিভিন্ন রকম হতে পারে। তবে উপরের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কিছু প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি।
– ব্যাংক থেকে টাকা তোলার সময় আপন কাউকে সঙ্গে রাখার চেষ্টা করুন। বয়স্ক মানুষ অবশ্যই সাথে আত্মীয়স্বজন বা বিশ্বস্ত কাউকে রাখবেন। তবে সাথে কাউকে রাখতে গিয়ে ৭/৮ বছরের নাতি/নাতনি’কে নিয়ে যদি ব্যাংকে যান, তবে সাথে না নেওয়াই ভালো। কারণ তখন আপনাকে আপনার সেই অবুঝ নাতি/নাতনির দিকে বেশি খেয়াল রাখতে হবে।
– ক্যাশ কাউন্টার থেকে টাকা নেওয়ার পর প্রয়োজনে কাউন্টারের সামনেই টাকা গুনে নিন। একই টাকা বিভিন্ন জায়গায় বসে গোনার দরকার নেই। এতে আপনার নোটের সংখ্যা বাড়বে কিংবা কমবে না। ক্যাশ কর্মকর্তারা আপনার সামনেই সাধারণত একবার হাতে টাকা গুনে দেখার পর কাউন্টার মেশিন দিয়ে টাকা চেক করে দেন।
– অনেকে টাকা গুনে দেখার পর আবার কাউন্টারে গিয়ে ১০০০ টাকার নোট খুচরা করে নেন। এই নোট পরিবর্তন করে দেন, জাল টাকা কিনা পরীক্ষা করে দেন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সমস্যা নিয়ে কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। টাকা ভাঙিয়ে নেবার পর কিংবা অন্যান্য সমস্যা সমাধানের পর আবার টাকা সব টাকা গণনা শুরু করেন। এতে আপনি প্রতারক চক্রের চোখে পড়ে যেতে পারেন। কারণ এ ধরনের প্রতারক দ্বিধাগ্রস্ত কিংবা বয়স্ক মানুষকে বেশি টার্গেট করে।
– ভিড় এড়িয়ে চলুন। আপনাকে কেউ খেয়াল করছে কিনা কিংবা নিজে থেকে কেউ এসে পরিচিত হতে চাচ্ছে কিনা, লক্ষ রাখুন। ঠিকমত কথার উত্তর না দিলে কে কি মনে করবে, সঙ্গে টাকা থাকলে নিরাপত্তার খাতিরেই এসব পাত্তা দেবেন না।
– ব্যাংকের ভেতর বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে ওঠা থেকে বিরত থাকুন। এই বাতিক কিছু মানুষের মধ্যে দেখা যায়।
– টাকা-পয়সা নিয়ে ব্যাংকের ভেতরে থাকলে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় থাকার চেষ্টা করুন। এতে আপনার ওপর যারা নজর রাখছে কিংবা ব্যাংকের ভেতর আপনার সঙ্গে যারা কথা বলেছে, তাদের মধ্যে কেউ অপরাধী হলে পরবর্তী সময়ে শনাক্ত করা সহজ হবে।
– ব্যাংক থেকে টাকা তোলার পর কিভাবে বাসায় বা নির্দিষ্ট স্থানে যাবেন, তার জন্য আগে থেকেই নিরাপদ পরিবহনের ব্যবস্থা করে রাখতে পারেন।
– ব্যাংক থেকে টাকা তোলার পর আশেপোশে চা-বিস্কুট, নাস্তা খাওয়া, ঘোরাঘুরি থেকে বিরত থাকুন। সোজা নিজের গন্তব্যে চলে যান। এতে করে প্রতারক চক্র সহজে আপনাকে টার্গেট করতে পারবে না।
– টাকার পরিমাণ বেশি হলে পুলিশি সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
প্রতারণার যে কত রকমফের হতে পারে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এই লেখায় শুধুমাত্র একটি বিষয় নিয়েই আলোচনা করেছি। ঘটনা ঘটে যাওযার পর আমরা বুঝতে পারি, প্রতারণার শিকার হলাম। কিন্তু আগে থেকে সচেতন হলে এসব দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। এ জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রত্যেকেই কষ্ট করে ভবিষ্যতের কথা ভেবে টাকা সঞ্চয় করেন। ছদ্মবেশি প্রতারক এসে সেই ঘাম-শ্রমের টাকা প্রতারণা করে নিয়ে যাবে, সেটা কখনো হওয়া উচিত না।
সাধারণত সহজ সরল মানুষগুলোই বিপদে পড়েন বেশি। কারণ তারা সাবধান থাকেন না। একটা মানিব্যাগ ছিনতাইয়ের জন্য একজন অন্যজনকে খুন-জখম করছে। এমন ঘটনা তো হামেশাই ঘটছে। একটা মানিব্যাগে সর্বোচ্চ কত টাকা থাকতে পারে? ৩, ৫ কিংবা ১০ হাজার টাকা। সামান্য এই টাকার জন্য ছিনতাইকারী যখন আহত কিংবা হত্যা করে, তখন ব্যাংক থেকে ১ লাখ বা ৫ লাখ টাকা নিয়ে যখন আপনি বের হবেন, তখন আরও বেশি সাবধানতা অবলম্বন জরুরি। কারণ, ক্ষতি হলে আপনারই হবে। অন্য কারও কিছু যাবে আসবে না। সাবধান থাকুন, নিরাপদ থাকুন। সতর্ক হলে আখেরে আপনিই ক্ষতি এড়াতে পারবেন।
লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এবং যুগ্ম-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক