বান, করোনায় ভাসছে ঈদ আনন্দ
৩১ জুলাই ২০২০ ১৮:৩৪
একেই বলে মরার উপর খাড়ার ঘা। করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামাল দিতে যখন আমরা হিমশিম খাচ্ছি তখন বানের পানিতে ভাসছে দেশ। আর এমন সময় এলো কোরবানির ঈদ। এই তিন ধাক্কা সামাল দিতে জনগণের ত্রাহি মধুসুধন অবস্থা।
যারা চাকরিজীবী তাদের অনেকেই আজ করোনার কারনে চাকরী হারিয়ে ঘরে আছেন। হাতে সংসার চালানোর অর্থ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যেও চরম সংকট চলছে। এই সংকট কিছুটা যখন কাটতে শুরু করেছে ঠিক তখনই বন্যার পানিতে দেশ ভাসছে। অনেক জেলাতেই এখন বানের পানি। নানা সংকটের পাশাপাশি বন্যা এবং করোনা ভাইরাসজনিত মৃত্যু বাড়ছে। এমন কষ্টের দিনেই আনন্দের ঈদ এসে হাজির। ঈদ যে কেবল আনন্দের তা কিন্তু নয়। গরিব মানুষের জন্য ঈদটা কখনো কখনো অনেক কষ্টের বটে। সন্তান, স্বজন আর পিতা মাতাকে নতুন কাপড় না দেওয়ার কষ্ট; ভালো খাবার দিতে না পারার কষ্ট থেকেই যায়।
করোনায় বিধ্বস্ত মানুষগুলোকে বানের পানিতে যখন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন ঈদ কতটা আনন্দের তাতো বেশ টের পাচ্ছি আমরা। রোজার ঈদের মতো এবারের ঈদটা আমাদের জন্য খুব একটা আনন্দ বয়ে আনছে তা বলা যাবে না। যারা ধনী শ্রেণীর তাদের কথা ভিন্ন, তবে সবার সুখের সাথে সাথেই তো ঈদেও আনন্দের সম্পর্ক।
সবাই মিলে আনন্দ করতে না পারলে সে আনন্দ পূর্ণতা পায় না। ঈদের কোরবানির হাঁট আর ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে রয়েছে ঝুঁকি। এই ঝুঁকি করোনার প্রকোপ বাড়া এবং মৃত্যুর শঙ্কা তৈরি করেছে। সব মিলিয়ে আমরা যে বর্তমানে মহা সংকটে আছি একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
করোনাভাইরাস প্রকোপের মধ্যেই দেশে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে যে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে এজন্য আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু? দেশের বিভিন্ন জেলায় ইতিমধ্যে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে গেছে অনেক এলাকা। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, এবারের বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। কারণ বন্যার প্রকোপটা এখনই বেশি দেখা দিচ্ছে। সামনে আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরও বন্যা হওয়ার শঙ্কা আছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বন্যা মোকাবিলা করার জন্য সরকার যথেষ্ট প্রস্তুত। বন্যা মোকাবিলার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আমরা আশ্বস্ত হতে পারি। আমাদের মতো দরিদ্র দেশের একর পর এক সংকট মোকাবিলা করা একটু দুরূহই বটে।
তবে এ পর্যন্ত সরকারের ত্রাণ সফলতায় আমরা খুশী হতে পারি। এ বিষয়টিতে সরকারের নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। বন্যা কবলিত এলাকায় আরও বেশি সহায়তা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে আমরা আশা করি।
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বন্যার খবর জোরেশোরে প্রকাশ হচ্ছে। খবরের কাগজে বন্যায় আক্রান্ত মানুষের দুঃখকষ্টের কথা তুলে ধরা হচ্ছে এবং ত্রাণ কার্যক্রম ততটা পর্যাপ্ত নয়, ইত্যাদি লেখা হচ্ছে। ত্রাণ যতই দেওয়া হোক ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌছবে এবং মানুষের চাহিদা শতভাগ পূরণ হবে তা ভাবা হয়তো ভুল হবে।
বন্যা বাংলাদেশের জন্য একটি বার্ষিক ঘটনা। প্রতি বছরই আমরা বন্যার কবলে পড়ি। কোনো বছর বেশি মাত্রায়, কোনো বছর কিছুটা কম। কোনো বছর কিছুটা আগে, কোনো বছর কিছুটা দেরীতে আসে। এটা নিয়ে আমাদের পূর্বপ্রস্তুতি থাকা বাঞ্ছনীয়। এবারও বোধ করি সরকারের প্রস্তুত রয়েছে। তবে করোনার কারণে সারা দেশে ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে এখন শতভাগ সফলতা ত্রাণ কার্যক্রমে মিলবে কিনা কেউ কেউ সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। দেশের বহু জায়গায় পানি বেড়ে তা মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়েছে, এটা অত্যন্ত সত্যি কথা। এমন পরিস্থিতির জন্য আমরা কোনো পূর্বাভাস পেয়েছিলাম কিনা? তা হলে হয়তো পানি উঠে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে এবং ক্ষয়ক্ষতি নিরসনে কী করা উচিত, তা নিয়ে নতুনভাবে ভাবার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারতো। সংশ্লিষ্টরা এমন আভাস একেবারে শেষ মূহুর্তেই দিয়ে থাকেন যার কারণে আমাদেরও আর করার কিছু থাকে না।
একথা সত্য যে করোনা ও বন্যার কারণে এবারের ঈদটা বিবর্ণই হবে। করোনার পর বন্যার প্রকোপ। এই দুইয়ের প্রভাবে ঈদের খুশি এবার ম্লান। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ঈদের আনন্দেও প্রাক প্রস্তুতি একেবারেই আলাদা। করোনা ও বন্যার সাঁড়াশিতে এবার সবই অন্ধকার। চারপাশে মৃত্যুর হাহাকার। বানভাসি ক্ষুদার্থ মানুষ। এর মধ্যে উৎসব পালনের মানসিকতাই নেই। কোরবানির হাঁটে আগের সেই জৌলুশ নেই। আগের মতো গরু কেনার হিড়িক কমেছে। ইসলাম ধর্মে কোরবানি ওয়াজিব তাই যাদের সামর্থ্য আছে তারা কোরবানি দিচ্ছেন। করোনার কারণে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। ব্যবসায় লোকসান গুনে পথে বসেছেন অনেকে। এ অবস্থায় কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য হারিয়েছেন দেশের অনেক মানুষ। তাই এবারের ঈদটা অনেকটা ফিকেই হবে মনে হচ্ছে।
মন ভালো না থাকলে উৎসবের অর্থ থাকে না। গত রোজার ঈদটাও অনেকটা আনন্দহীন ভয়ভীতির মধ্যে ঘরেই কেটেছে। এবার কোরবানির ঈদটাও ঘরেই কেটে যাবে। শুধু করোনাভাইরাসই নয়, এবার বিপদের উপর আরেক বিপদ হয়ে এসেছে বন্যা। যেভাবে পানি বাড়ছে তাতে ৮৮ কিংবা ৯৮ এর রূপ নিতে পারে বন্যা। বন্যা-দীর্ঘস্থায়ী হলে মহা সংকটে পড়বে দেশের মানুষ।
এমন আরও নানা ধরনের সংকটে আছে মানুষ। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে জামাকাপড়ের ব্যবসায়। দোকানপাট খুললেও কেনাবেচা নেই। সবার কাজকর্ম বন্ধ। মানুষের হাতে টাকা নেই। কোরবানিই দিতে পারবে না আবার কাপড় তাতো প্রশ্নই ওঠে না।
ঈদের পর কী হবে? অর্থনীতির কী অবস্থা? অনেকেই এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। দেশে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বিকল্প আমদানি-রফতানির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের নতুন বাজারের সুযোগ খোঁজা অব্যাহত রেখে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং দেশে তাদের জন্য স্বল্পমেয়াদী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের এখন প্রকৃতি এবং মানুষবান্ধব টেকসই মানব-কল্যাণমূলক স্বনির্ভর অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যেতে হবে- দক্ষতার সাথে যার নেতৃত্ব দেবেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
একমাত্র তিনিই পারবেন ১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো এ দেশের ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণকে একত্র করে আর একটি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। যে যুদ্ধ হবে ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’। এ যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতেই হবে।
বাংলাদেশে এখনো ২২ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। সংখ্যার হিসাবে প্রায় চার কোটি। মৌলিক চাহিদার অনেক কিছুই তাদের অপূর্ণ থেকে যায়। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে কোনোরকমে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকে। করোনা সংকট তাদের রোজগারের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার যে পরিমাণ
ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে, তাতে চাহিদার ২৫ শতাংশও মিটবে না। ৭৫ শতাংশ বঞ্চিত থেকে যাবে।
এ অবস্থায় কী করবে সরকার? অবিলম্বে সরকারের ত্রাণ পরিকল্পনায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। যত দিন করোনা সংকট থাকবে, তত দিন কাজ হারানো সব অভাবী মানুষের কাছে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলো পৌঁছাতে হবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি প্রত্যেক মানুষকে ছয় মাস বিনা পয়সায় চাল দিতে পারে, আমরা কেন পারব না? করোনা যেমন সবাইকে আঘাত করেছে, তেমনি নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে বন্যা ও করোনা পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে।
বৈশ্বিক যে কোনো মহামারিকে পরাভূত করতে হলে প্রয়োজন দেশপ্রেমিক দক্ষ নেতৃত্ব, বুদ্ধিবৃত্তিক শাসনতন্ত্র ও সঠিক কর্মকৌশল প্রণয়ন। করোনা সংক্রমণরোধ ও মহামারির পরে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় ঠেকাতে আমাদেরকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্যঘাটতি মোকাবিলায় কৃষি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হওয়া দরকার। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ও অধিকতর উৎপাদনশীল কৃষিতে আমাদের মনোযোগ বেড়েছে । একই সঙ্গে চাহিদা অনুসারে কৃষি পণ্যের আমদানি না বাড়িয়ে দেশীয় উৎপাদনে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন।
সর্বশেষ এটাই বলবো, আমরা যোদ্ধার দেশ। দেশের জন্য যুদ্ধ করে দেশ পেয়েছি। কলেরা-ডায়রিয়া মহামারি মোকাবিলা করে সফল হয়েছি। করোনা, বন্যকেও আমদের জয় করতে হবে। সব ভয়কেই দুরে সরিয়ে নির্ভয়ের বাংলাদেশ গড়তেই হবে আমাদের।
বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ হলেও সব দুর্যোগ, মহামারি উৎরে সফলতার মুখ দেখেছে। উন্নত দেশের স্বাদ পাচ্ছি আমরা। সকল ভয়কে কাটিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবেই।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক