Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গায়েবানা জানাজার অপরাধে গণহত্যা


৩১ জুলাই ২০২০ ২২:২৩

পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরীর পারের দূর্গাপুরের অধিবাসীদের অপরাধ ছিল, তারা পাকিস্তানী সেনাদের নির্মম নির্যাতনে নিহত একজন মুক্তিকামী শিক্ষকের গায়েবানা জানাজায় শরীক হয়েছিল। ফলে তাদের শিকার হতে হয়েছিল এক পৈশাচিক গণহত্যার।

একাত্তরের আগস্ট। মুক্তিযোদ্ধা রুহুল পাকিস্তানীদের অবস্থানের চারপাশে ‘রেকি’ শেষ করে এসে আবদুল হান্নান ঠাকুরকে জানালেন যে নেত্রকোনা কলেজের প্রভাষক আরজ আলীকে পাকিস্তানী সেনারা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেছে। আবদুল হান্নান আরজ আলীর খুব কাছের বন্ধু ছিলেন, রুহুল অনুরোধ করলো,’আমি বিস্তারিত জানতে পারিনি, আরজ স্যারের একটু খোঁজ নিন স্যার’।

বিজ্ঞাপন

একহারা গড়নের হাসিখুশি আরজ আলী দূর্গাপুর থেকে তিন মাইল দক্ষিণের দুর্গম গ্রাম নোয়াপাড়ার অধিবাসী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে অনার্স করা আরজ ছিলেন বিখ্যাত অধ্যাপক জি.সি.দেবের ছাত্র। ব্যক্তিজীবনেও আরজ তার মতোই উদার, অসাম্প্রদায়িক এবং সহজ-সরল দর্শনের মানুষ ছিলেন, ছিলেন বুকভরা সাহস আর দেশপ্রেমে বলীয়ান। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যত অত্যাচার আর নিপীড়নই চালাক না কেন পাকিস্তানীরা, একদিন না একদিন দেশ শত্রুমুক্ত হবেই। সেই আরজকে পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে গেছে শুনে আবদুল হান্নান তখনি বেরিয়ে পড়লেন খোঁজ নেওয়ার জন্য।

পরদিন নেত্রকোনা কলেজে গিয়ে অবশ্য হান্নান এক বিচিত্র চমকের মুখোমুখি হন। স্টেশনের এক চা বিক্রেতা বালক নিমাইয়ের মাধ্যমে জানতে পারেন, পাকিস্তানীরা আরজকে সন্ধ্যার আগেই ছেড়ে দিয়েছে। স্টেশনের পেছনেই কলেজ ছাত্রদের ছাত্রাবাস লাগোয়া প্রফেসর হোস্টেলের এলো সাইজের বিল্ডিং। নিমাই জানালো আরজ সেখানে আছেন। নেত্রকোনা কলেজের সামনের বড় রাস্তায় অস্ত্র-গোলাবারুদে সজ্জিত মিলিটারি ট্রাকের চোখ ফাঁকি দিয়ে সাবধানে আরজের রুমে পৌঁছে প্রিয় বন্ধুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন হান্নান। প্রায় এক বছর পর দেখা দু’জনের। বন্ধুর সঙ্গে আবার দেখা হবে হান্নান কেন যেন সে আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন

আরজের কাছ থেকে হান্নান জানতে পারলেন, আগের দিন কলেজের প্রিন্সিপাল তসদ্দক আহমেদ তাকে ডেকে বলেছিলেন, পাকিস্তানী কর্নেল মিলিটারি ক্যাম্পে যেতে বলেছে তাকে, কথা বলতে চায়। কোনো ক্ষতি হবে না বলে আশ্বস্তও করেছিলেন। ক্যাম্পে যাওয়ার পর কর্নেল ইংরেজিতে তার নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করার পর সরাসরি চার্জ করল এই বলে যে, আরজের নোয়াপাড়ার বাড়িতে অস্ত্র-গোলাবারুদসহ মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প করেছে। তাদের পরিচয় কী, কোন পথে তারা যাওয়া আসা করে? আরজ জবাবে এ ব্যাপারে কিছু বলতে অস্বীকার করলে কর্নেল হিংস্র হায়েনার মত ক্ষেপে গিয়ে বলল আরজ যে শুধু ক্যাম্প করতে সহায়তা করেছে, তা নয়, রীতিমত খাওয়া-দাওয়াসহ সকল সুবিধা নিশ্চিত করেছেন। আরজ এবারও অস্বীকার করলে কর্নেল ক্ষিপ্ত হয়ে চেয়ার ধাক্কা দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

কিছুক্ষণ পর ঠাণ্ডা কণ্ঠে কর্নেল তাকে বলল, ভেবে দেখুন , এখনো সময় আছে। সত্যটা স্বীকার করলে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না, ছেড়ে দেবো। উত্তরে আরজ একঘেয়ে সুরে একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন, বললেন, এসব ব্যাপারে তার বিন্দু-বিসর্গও জানা নেই। এবার কর্নেল তাকে বললো, “ঠিক আছে, আপনাকে আরও সাত দিন সময় দেওয়া হলো। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করলেই কেবল আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তবে এই সাত দিন কোনো অবস্থাতেই আপনি কলেজ ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন না। প্রিন্সিপাল তসদ্দেকের সঙ্গে আমার এ ব্যাপারে কথা হয়েছে, তিনি আপনাকে বিস্তারিত জানাবেন।

ক্যাম্প থেকে ফিরে আরজ প্রিন্সিপাল তসদ্দেকের কাছে গেলেন। তসদ্দেক তাকে জানালেন, আপনি আপাতত হোস্টেলেই থাকুন, কোনকিছু জানতে পারলে আপনাকে জানানো হবে।

আরজ আরও জানালেন, তিনি ধারণা করছেন পাকিস্তানীদের কাছে তার সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে দূর্গাপুরের কুখ্যাত পাকিস্তানী দালাল কিতাব আলী তালুকদার এবং তার সহযোগী আরেক বদমায়েশ হামিদ মেম্বার। উল্লেখ্য, দুর্গাপুরের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল কিতাব আলী তালুকদার এবং হামিদ মেম্বার ছিল শান্তি কমিটির সদস্য। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের সাথে কিতাবের বেশ দহরম মহরম ছিল। তাদের চক্রান্তেই পাকিস্তানী সেনারা আরজের ব্যাপারে জেনেছে। হান্নান তখন আরজকে বললেন, তুমি আমার সাথে মেঘালয়ে চলো। কিন্তু আরজ কোনভাবেই রাজি হলেন না, বললেন, তিনি মেঘালয়ে চলে গেলে পাকিস্তানীরা তাকে না পেয়ে প্রিন্সিপাল তসদ্দেককে ধরে নিয়ে যাবে,হয়তো মেরে ফেলবে, তার ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেবে, বাড়ীতে থাকা বড় ভাই ও মাকে মেরে ফেলবে। এদের সবাইকে তিনি বিপদের মুখে ফেলতে পারবেন না।

তবুও হান্নান হাল ছাড়লেন না। পরদিন আরজের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চা-স্টলের বালক নিমাইয়ের বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন এবং পাকিস্তানীদের গতিবিধির উপর নজর রাখতে শুরু করলেন। এতো করেও শেষ রক্ষা হলো না, ১৩ই আগস্ট সন্ধ্যায় নিমাই এসে খবর দিল, আরজকে মিলিটারি আবার ধরে নিয়ে গেছে।

দ্রুত মিলিটারি ক্যাম্প সংশ্লিষ্ট প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের হোস্টেলে গিয়ে ক্যাম্পের এক কক্ষে আরজকে নির্মম নির্যাতন করতে দেখলেন হান্নান। পা দুটো বেঁধে উপরে ছাদের রিং-এর সাথে ঝুলিয়ে রাখা, নিম্নাঙ্গের অন্তর্বাস ছাড়া আর কোন কাপড় নেই গায়ে, পাকিস্তানী সেনারা চাবুক মারছে, প্রতিবার চাবুকের আঘাতের সাথে সাথে চামড়া কেটে মাংসে বসে যাচ্ছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর। কিছুক্ষণের মধ্যে আর্ত-চিৎকার করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন আরজ, অবশ দেহটা নামিয়ে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনলো জল্লাদেরা। এরপর আবারো পৈশাচিক আনন্দে নির্যাতন শুরু হলো, এবার বুট দিয়ে রীতিমত পিষতে থাকলো পাকিস্তানীরা আরজের পুরো শরীর। অকল্পনীয় যন্ত্রণায় দেহটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে থাকা আরজের সামনে এসে কর্নেল ইংরেজিতে আবারো সেই একই প্রশ্ন করলো, এখনো সময় আছে, সত্য কথা বলো, ছেড়ে দেওয়া হবে তোমাকে। আরজ চিৎকার করে জবাব দিলেন, আমি কিছুই জানি না, এটাই সত্য। কর্নেল গম্ভীর মুখে চলে গেল।

পরদিন বেলা বারোটার দিকে আরজকে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে জিপে তোলা হলো, স্টেশনে এনে সেনা ভর্তি ট্রেনের বগিতে তোলা হলো। বোঝা গেল আরজকে দুর্গাপুর মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। খবরটা চারদিকে বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়লো। পূর্বধলা স্টেশন থেকে আবার আরজকে ট্রেন থেকে নামিয়ে জিপে তোলা হলো। খবর পেয়ে হান্নান দ্রুত আরজদের বাড়ির দিকে আসছিলেন। রাস্তায় দেখলেন জিপ আরজদের গ্রামের বাড়ির পাশ দিয়ে গেল কিন্তু আরজ চোখ বাঁধা থাকায় সেটা টেরও পেলেন না। দ্রুত বাড়িতে এসে হান্নান আরজের বড় ভাই ও মাকে নিরাপদে সরে যেতে তাগাদা দিতে থাকলেন। উঠোনে আরজের বড় ভাই নির্বাক হয়ে বসে আছেন, ভেতরের ঘরে মা হাউমাউ করে বিলাপ করছেন আরজের জন্য। বহুকষ্টে দুজনকে বাড়ি থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনটা মিলিটারি জিপ এসে থামল আরজদের বাড়ির সামনে। একটায় বসে ছিল শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান কিতাব আলী তালুকদার, সঙ্গে তার দোসর হামিদ মেম্বার। অর্থাৎ আরজের অনুমানই ঠিক ছিল, এরাই পাকিস্তানীদের কাছে চিনিয়ে দিয়েছিল আরজকে।

হান্নান বন্ধুর পরিবারকে নিরাপদে রেখে দ্রুত দূর্গাপুর বাজারে মিলিটারি ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছালেন। বিপিন নামে আরেক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিতে জানতে পারলেন কর্নেল এসে পৌঁছেছে, সেদিন রাতেই আরজকে মেরে ফেলা হবে। সেদিন রাতে তেমন কিছু না হলেও পরদিন ১৬ই আগস্ট সকালে ক্যাম্প থেকে মিলিশিয়ারা কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে আরজকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে আসে। বীভৎস চেহারা, দেহটা প্রায় অসাড়। চারপাশে ভিড় জমে যায়, সেই ভিড়ে হান্নানও ছিলেন, মূলত সবাইকে হত্যার ভয়াবহতা দেখিয়ে ভয় পাওয়ানোই উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানীদের। সোমেশ্বরীর তীরে পানির ভেতর দাঁড় করিয়ে কর্নেল শেষবারের মত জিজ্ঞেস করে আরজকে, মুক্তিদের তোমার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছ কিনা, তাদের পরিচয় ও যাওয়া আসার পথটা কী কী। এখনো সত্য উত্তর দিলে তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। বহুকষ্টে আরজ দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিল, শোনো কর্নেল, আমি জি. সি. দেবের ছাত্র ও ভক্ত। আমি কখনো মিথ্যা বলতে পারব না।

কদাকার হয়ে উঠলো কর্নেলের চেহারা, আদেশ পেয়ে গর্জে উঠলো মেশিনগান। ঝাঁজরা হয়ে গেল আরজের বুক। লাশটা উল্টে পানিতে পড়ার পর দুজন পাকিস্তানী সেনা হাত পা ধরে লাশটা ছুঁড়ে ফেলে দিল নদীর খরস্রোতে।

এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখে শোকের ছায়া নেমে আসে দূর্গাপুরবাসীর মধ্যে। তাদের সদাহাস্যজ্জ্বল সন্তান আরজকে তারা মাটিও দিতে পারলেন না। শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাই জোহরের নামাজের পর এলাকাবাসী সোমেশ্বরীর তীরে সমবেত হলেন। এক গায়েবানা জানাজার মাধ্যমে তারা আরজের আত্মার শান্তি কামনা করলেন।

ঘুণাক্ষরেও কেউ কল্পনা করতে পারেনি এই জানাজাই সূচনা করবে এক ভয়াবহ বিভীষিকার। গায়েবানা জানাজার খবর ক্যাম্পে পৌঁছাতেই কর্নেল এবং পাকিস্তানী সেনারা হায়েনার মত হিংস্র হয়ে উঠলো। ক্যাম্প থেকে ঘোষণা করা হলো যারা যারা গায়েবানা জানাজায় অংশ নিয়েছে, তাদের সবাইকে ধরে নিয়ে আসা হবে। সঙ্গে সঙ্গে শান্তি কমিটির সদস্য এবং পাকিস্তানী সেনারা নিরীহ, নিরপরাধ গ্রামবাসীদের ধরে নিয়ে এলো ক্যাম্পে। তাদের অপরাধ তারা আরজ আলীর আত্মার শান্তি কামনা করে গায়েবানা জানাজায় অংশ নিয়েছিল।

হান্নান কোনভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন, বন্ধু জয়নাল আবেদিনের বাড়িতে লুকিয়ে থেকে নিজের চোখেই দেখেছিলেন সেদিনের গণহত্যা। মানুষগুলোর হাত পেছনে বাঁধা, চোখ বাঁধা। রশিতে এক লাইনে শক্ত করে বেঁধে সোমেশ্বরীর পারে পানির ভেতর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। তারপর শুরু হলো নির্বিচারে ব্রাশফায়ার। একটানা মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেল নিরপরাধ মানুষগুলোর দেহ। প্রত্যেকের লাশ একইভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হলো সোমেশ্বরীর বুকে, নদীর জল ধারণ করলো টকটকে লাল বর্ণ।

১৯৭১ সালের ১৬ই আগস্ট দূর্গাপুরবাসী নির্বিচার গণহত্যার শিকার হয়েছিল স্রেফ তাদের আপনজনের গায়েবানা জানাজায় অংশ নেওয়ার অপরাধে, ভাবতে কি অবিশ্বাস্য লাগে না?

চাক্ষুষ প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষাৎকার প্রদান: আবদুল হান্নান ঠাকুর
প্রাবন্ধিক, সাবেক সহকারী পরিচালক, বাংলা একাডেমী, ঢাকা

গ্রন্থ কৃতজ্ঞতা: 
১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, রশীদ হায়দার 

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর