Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শেখ কামাল, অকালে হারিয়ে ফেলা শ্রেষ্ঠ প্রতিভা


৫ আগস্ট ২০২০ ১৫:৫৮

নিজের দেশের খেলোয়াড়দের নানা সিরিজ জয়ের ট্রফি, এশিয়া কাপ, বিশ্বকাপ ইত্যাদির ট্রফি হাতে দেখা আমাদের এক বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন। আজকালে ক্রীড়াঙ্গন সবার কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ হলেও কোনো না কোনো এক সময় ছিলো যখন পুরো উপমহাদেশ কল্পনাও করতে পারতো না বিদেশি কোনো স্যুটেড ব্যুটেড কোচ থাকবে জাতীয় দলের। তবে সেই সময়েও এক অদম্য সাহসী যোদ্ধা, স্বপ্নদ্রষ্টা শুধু চিন্তাই করেন নি। সেটির বাস্তবায়ন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন পুরো উপমহাদেশকে।

বিজ্ঞাপন

১৯৭৪ সালে আবাহনী যখন কলকাতায় ঐতিহ্যবাহী “এফ এ শিল্ড” খেলতে যায় পশ্চিমা বেশভূষার কোচে সবাই যেমন অবাক হয়েছিল তেমনি মাটি কামড়ে পড়ে থাকা ছোট ছোট পাসে কমল বসুসহ আকাশবাণীর প্রথিতযশা ধারাভাষ্যকাররা বাধ্য হয়েছিলেন আবাহনীর ভূয়সী প্রশংসা করতে। আবাহনীর কোচ তখন “কোচ বিল হার্ট” আর “হার্ট” কে এনে ক্রীড়াঙ্গনে বাঙলার হয়ে বিপ্লব আনা সেই স্বপ্নদ্রষ্টা ও নেতৃত্বের নাম শেখ কামাল।

হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল। খেলার মাঠের শেখ কামাল, ছায়ানটের শেখ কামাল, আবাহনী আর ঢাকা থিয়েটারের শেখ কামাল। মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, দেশপ্রেমিক শেখ কামাল। এতো পরিচয় এতো বিশেষণ সব কিছু নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হবে লিখতে গেলেই। ছোটবেলা থেকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বড় হওয়া। আমার জন্মই আগা থেকে গোঁড়া পুরোপুরি রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক ধাঁচে গড়া এক পরিবারে। স্কুল থেকেই রাজনীতি করা আমি রাজনীতির জন্য পড়াশোনা ও পরিবার থেকেই শেখ কামালকে খুব গভীরভাবে জানবার সুযোগ পেয়েছি। শেখ কামালকে আমি যতটুকু পড়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি জীবনকে উপলব্ধি করে তার থেকে নেওয়া প্রতিটি আবেগ, প্রতিটি শিক্ষাকে আমি আমার ভেতর গেঁথে নিয়েছি। তাই খুব তাড়াতাড়ি বুঝে গিয়েছিলাম রাজনীতি, সংস্কৃতি, ক্রীড়াঙ্গন সবকিছু একি সুতোয় গাঁথা। খুব কাঠখোট্টা রাজনীতির মানুষ হয়ে যতবার নাটকের মঞ্চে দাঁড়িয়েছি ধারণ করেছি আমার সংস্কৃতির সত্ত্বাকে, যতবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিকেট খেলতে কিপিং করতে দাঁড়িয়েছি ধারণ করেছি আমার ভেতরের খেলোয়াড় সত্ত্বাকে আবার যতবার মাইক নিয়ে রাজনৈতিক জায়গায় বক্তব্য দিয়েছি ধারণ করেছি আমার রাজনৈতিক শিক্ষা আর আদর্শকে। আর প্রতিবার আমার প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছেন শেখ কামাল। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি কেবল আমি নয়, যে জীবন ছিলো শেখ কামালের মাত্র ২৬ বছর বয়সে যদি সে জীবন থমকে না যেতো সেই জীবন আমার মত কত তরুণ আর যুবকের প্রেরণার উৎস হতো ?

বিজ্ঞাপন

১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম তার। ছোটবেলা থেকেই ত্যাগের শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠছিলেন। অতটুকুন বয়সে বাবাকে চিনতে না পারা আর “হাসু আপা তোমার আব্বাকে একটু আব্বা বলে ডাকি” প্রমাণ করে পিতার দেশপ্রেমের জন্য যে ত্যাগ সেই ত্যাগে নিজের পিতার থেকে প্রাপ্ত যে স্নেহের অধিকারী ছিলেন শেখ কামাল তা তাকে ত্যাগ করতে হয়েছে। ঢাকার শাহীন স্কুল, ঢাকা কলেজ আর সবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ। শাহীন স্কুলে থাকাকালীন ছিলেন প্রতিটি খেলার অপরিহার্য অংশ। ক্রিকেটে যদিও তার আগ্রহ ছিলো সবচেয়ে বেশি। আজাদ বয়েজ ক্লাবে খেলেছেন প্রথম বিভাগের ক্রিকেট। অন্যতম পেসার হলেও শেখ কামাল বাঙ্গালী আর শেখ মুজিবের সন্তান হওয়ার জন্য সেখানে অবহেলিতই হয়েছিলেন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বাস্কেট বল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন। ফুটবল নিয়ে তার আকাশছোঁয়া স্বপ্ন আর তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা প্রথমেই বলেছি। কেবল খেলাধুলা নিয়েই বলে গেলে বলা শেষ হবেনা। শিল্প-সাহিত্যের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন শেখ কামাল। সেতারবাদক হিসেবেই বলি আর সু-অভিনেতা হিসেবেই বলি শেখ কামাল যেনো শেখ কামালেরই একমাত্র প্রতিযোগী। উগ্র পাকিস্তানিরা যখন রবীন্দ্রসংগীত বন্ধ করে দিলো সেই উত্তাল ঊনসত্তরের সাহস নিয়ে যেখানেই সুযোগ পেতেন রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। রাজনৈতিক দৃঢ়তা প্রদর্শনে এমনি ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। সেই প্রতিযোগিতা আরও দীর্ঘ হতে পারতো কিন্তু আমরা এতোই হতভাগা সে প্রতিযোগিতা দীর্ঘ হতে দিইনি।

শেখ কামাল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র জন্মের পেছনে যার অবদান এই বাংলার শেষ ধূলিকণা অবধি স্মরণ করবে তার সন্তান হয়ে পিতা জেলবন্দী থাকা অবস্থায় অংশগ্রহণ করেন মুক্তিযুদ্ধে। জেনারেল ওসমানীর এডিসি ছিলেন। তার মুক্তিযুদ্ধের জীবন প্রমাণ করে পিতার মত সাহস, দেশপ্রেম আর সততা তিনিও ধারণ করেছেন তার প্রতিটি রক্তবিন্দুতে। এই মুক্তিযোদ্ধা, এই অসম সাহসী স্বপ্নদ্রষ্টাকে যারা কোনোদিন বাংলাদেশ চায়নি, যারা কোনোদিন চায় না বাংলাদেশ জিতুক, বাংলাদেশ ভালো থাকুক তারা তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বারবার। শেখ কামালের মতন অমন বিশালদেহী বিশাল ব্যক্তিত্বের মানুষের চরিত্রে দাগ দেয়ার চেষ্টা তারা বারবার করে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী ব্লু সুলতানা কামাল। আজকালকার সময়ে অনেকেই ক্ষমতার দম্ভে যা করে থাকে তেমনই রাষ্ট্রপতির সন্তান হিসেবে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে কোনো নারীকে অর্জনের চিন্তা তিনি করতেই পারতেন। । কিন্তু শেখ কামাল জনপ্রিয় অভিনেত্রী ডলি জহুরকে দিয়ে প্রেমিক মনের প্রেমের আকুতি জানানোর চেষ্টা করেছিলেন সুলতানা কামালকে। নিজে থেকে কথা না বলবার মত অতখানি লাজুক ছিলেন তিনি। সুলতানা কামাল যখন জানালেন “এতই যখন পছন্দ তখন বাড়িতে কথা বললেই হয়” তখন আর প্রেসিডেন্টের ছেলে বলে পিছিয়ে যাননি। একটি দেশের প্রেসিডেন্টের ছেলে সেই উন্নত মানসিকতা নিয়েই অতি সাধারণ পরিবারের তবে দেশ সেরা রত্ন মেয়েটিকে নিজের ঘরের বউ করে আনেন। শেখ কামালের নানান গুণের মাঝে প্রেমিক গুণটিকে হারিয়ে ফেললে চলবে না। সেই প্রেমিক, সেই নারীর প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিকে পাকিস্তানের দোসররা চেনাতে চায় মেজর ডালিমের স্ত্রীর অপহরণকারী হিসেবে। যেখানে মেজর ডালিমের নিজের লেখা বইতে তার ব্যাপার কোনো কিছু উল্লেখ নেই। উল্লেখ করা আছে ভিন্ন কিছু, ভিন্ন প্রেক্ষাপট, ভিন্ন ঘটনা।

জনপ্রিয় অভিনেত্রী ডলি জহুর তার স্মৃতিচারণে জানিয়েছিলেন, মাঝে মাঝে রিহার্সাল শেষে প্রেসিডেন্টের ছেলে হয়ে তার কাছে রিকশা ভাড়া না থাকার মতো খুবই স্বাভাবিক জীবনযাপনের ঘটনা। অথচ তাকে শুনতে হয়েছে ব্যাংক ডাকাতের মতো বড় মিথ্যা অপবাদ। সেই প্রোপাগান্ডার সবচেয়ে বড় সাক্ষী ছিলেন তৎকালীন পুলিশ সুপার মাহাবুব আলাম (বীরবিক্রম), সেই সময়কার দৈনিক মর্নিং নিউজের সম্পাদক এবিএম মুসা, বিএনপি নেতা ইকবাল হাছান টুকু, মূলত তারই জিপে করে শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাতির খবর পেয়ে ব্যাংক ডাকাতদের ধরতে বের হয়ে যান। জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ যিনি সেই সময়ে ওই জিপেই ছিলেন।

লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের তৎকালীন সাংবাদিক পিটাল হেজেল হার্স্টকে এই নিরেট মিথ্যে বানানো গল্প খাওয়ানোর চেষ্টা করা হলে তিনি বলেছিলেন ” একজন প্রধানমন্ত্রীর ছেলের ব্যাংক ডাকাতির প্রয়োজন কি? টাকা চাইলে তো ব্যাংক ম্যানেজাররাই তাকে টাকা এনে দেবে”। খুবই সহজ একটি যুক্তিতে এই বানানো গল্পকে, এই প্রোপাগান্ডাকে ভেঙ্গে দেওয়ার সুযোগ থাকলেও বছরের পর বছর ধরে মানুষ এসকল মিথ্যে অভিযোগকে গ্রহণ করেছে। আমরা এতোটাই অকৃতজ্ঞ জাতি।

একজন তরুণ হিসেবে শেখ কামালের সহজ সাদামাটা জীবন কাটানো, নিজেকে বহুরকমভাবে আবিষ্কার করা, প্রত্যেকটি প্রতিভাকে কাজে লাগানো আর স্বপ্নবাজের মত একের পর এক কাজ নিরলসভাবে করে যাওয়া অনুধাবন করতে পারা বিশাল অনুপ্রেরণার। আজকের তরুণদের কাছে যিনি জীবন্ত কিংবদন্তি হতে পারতেন তিনি মাত্র ছাব্বিশেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, আসলে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো জোর করেই। আজ আমাদের সাকিব আল হাসান আছে, আমাদের আছে মাশরাফি বিন মর্তুজা, আকবর আলী কিংবা ফুটবলের জামাল ভূইয়া। তাদের আছে অর্জন, প্রচেষ্টা। সেই প্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে হয়তো আমরা আরও অনেক কিছু পেতাম দেশের জন্য। আমাদের ক্রীড়াঙ্গন, সংস্কৃতির পরিবেশ পাল্টেছে কিন্তু যিনি প্রাণ দিয়ে এসমস্ত কিছু পাল্টাতে চেয়েছেন তিনি আমাদের সাথে নাই।

আজ শেখ কামাল বেঁচে থাকলে কী হতেন? রাজনীতিবিদ? সংস্কৃতিকর্মী? ক্রীড়াবিদ? সেতারবাদক নাকি এক লাজুক প্রেমিক? হয়তো সবকিছুই। ক্রীড়া আর সংস্কৃতি যার ভিতরে বাসা বেধে তিনি আর যাই হোক হেরে যাবার মানুষ নন। শেখ কামালকে গভীরভাবে ভালোবাসলে বোঝা যায় তার পুরো সত্ত্বা এক বিশাল সমুদ্রের মতো। সেখান থেকে মাত্র একটি গুণ সামনে আনলে, একটি বৈশিষ্ট্য সামনে আনলে বাকি সবকিছু নিচে পড়ে থাকে। তাই তাকে মাত্র একটি বিশেষণে বর্ণনা করা অসম্ভব ঠিক যেমন একফোঁটা পানি নিয়ে পুরো সমুদ্রকে।

নতুন প্রজন্মের জন্য যেই প্রাণ জাগাতে পারে অদম্য তরুণ হওয়ার প্রেরণা তার জন্মদিনে তার মতো অদম্য মানব সন্তান আর অসীম সাহসী হবার প্রার্থনা করি। প্রার্থনা করি তার আত্মার শান্তির। শুভ জন্মদিন শেখ কামাল।

লেখক: সাবেক সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ

শেখ কামাল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর