Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আসুন আত্মহত্যা প্রতিরোধে একে অন্যকে ভালো রাখি


৭ আগস্ট ২০২০ ১৪:১৪

বর্তমান পৃথিবীতে মৃত্যুর যাবতীয় কারণের মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় দশ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করেন। কিশোর-কিশোরি ও যাদের বয়স ৩৫ বছরের নিচে তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ আত্মহত্যা।

আত্মহত্যা হল নিজের জীবন নিজে সমাপ্ত করার প্রক্রিয়া। ইংরেজিতে আত্মহত্যার সঙ্গে কমিট কমিট (commit) শব্দটি ব্যবহৃত হয় যার যথাযথতা সম্পর্কে এবং আত্মহত্যার সংজ্ঞা নির্ধারণ করার বিষয়ে অনেক মত পার্থক্য রয়েছে। সাধারণভাবে নিজেকে মেরে ফেলাই আত্মহত্যা। ইংরেজি suicide ও ল্যাটিন suicidear (সুই সেইডেয়ার) থেকে এসেছে আত্মহত্যা। যার শাব্দিক অর্থ নিজেকে হত্যা করা। যখন কেউ নিজেকে হত্যা করেন, মানুষ সেই প্রক্রিয়াকে আত্মহত্যা করেছে বলে প্রচার করেন। তবে আত্মহত্যাকে একসময়ে বেআইনি হিসেবে গণ্য করা হত।

বিজ্ঞাপন

প্রাচীন এথেন্সে যদি কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রের অনুমোদন ব্যতিরেকে নিজেকে হত্যা করত, তাহলে সেই লাশ সাধারণ কবরস্থানে কবর দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হত না। আত্মহত্যাকে খ্রীষ্টান-ইউরোপিয় অঞ্চলেও একটি পাপ হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল। ৪৫২ সালে Arles এর কাউন্সিলে আত্মহত্যাকে শয়তানের কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছিলো। ফ্রান্সের লুই চতুর্দশের ১৬৭০ সালে তৈরি করা ফৌজদারি অধ্যাদেশও অত্যন্ত অমানবিক ছিলো। আত্মহত্যা করা ব্যক্তির মৃতদেহ রাস্তায় টেনে আনা হত।মাথা নিচের দিকে দিয়ে আবর্জনা দিয়ে আবৃত করা হত সেই মৃতদেহ। এমনকি মৃত ব্যক্তির সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হত। এছাড়াও বিশ্বের নানা ধর্মে আত্মহত্যাকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধ থাকা স্বত্বেও মানুষ আত্মহত্যা করে।

বিজ্ঞাপন

মূলত, রেনেসাঁ বা নবজাগরণের সময় থেকে আত্মহত্যার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হতে শুরু করে। আত্মহত্যা বিষয়ে লেখা এক প্রবন্ধে ডেভিড হিউম প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, ‘কেন আমি একটি করুণ অস্তিত্বকে দীর্ঘায়িত করব যখন মানুষ কিছু অসার সুবিধা আমার কাছ থেকে গ্রহণ করতে পারে?’ একে তিনি অনেকটা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণের সঙ্গে তুলনা করেছেন যা আসলে অনৈতিক নয়। এভাবে নানা যুগে নানা দার্শনিক আত্মহত্যার পক্ষে ও বিপক্ষে মত দিয়েছেন। তবে সব যুগেই আত্মহত্যার সঙ্গে মানসিক ভারসাম্যহীনতার যোগসূত্র রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন কমবেশি। বর্তমানে সাইকিয়াট্রিক ইউনিটে ভর্তি করা রোগীদের মধ্যে পূর্ণ আত্মহত্যার ঝুঁকি ৮.৬ শতাংশ। বাইপোলার ডিসঅর্ডার আত্মহত্যার ঝুঁকি ২০ গুণ পর্যন্ত বাড়ায়। এছাড়াও সিজোফ্রেনিয়া ১৪ শতাংশ। ট্রমা পরবর্তী স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, ডিপ্রেসন, দ্বিপক্ষীয় ব্যাধি, মোটা হওয়া জনিত রোগ ইত্যাদি আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায় বলে জানা যায়।

বর্তমান এই বিশ্বে আমাদের সামাজিক বন্ধন অটুট নয় অতটা। আধুনিক পৃথিবীটা বিরাট এক গ্লোবাল ভিলেজে রূপান্তরিত হলেও মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ কমে গেছে অনেকটাই। আধুনিক প্রযুক্তি যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করায় মানুষ অনেক কাছাকাছি আসলেও এটি আসলে শুভঙ্করের ফাঁকি বই কিছু নয়। একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আমাদের হয়ত জায়গা পরিবর্তন করা লাগে না কিন্তু এভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মিক বন্ধন দৃঢ় হওয়ার পরিবর্তে আলগা হয়েছে অনেকটাই।

আমাদের সামাজিক বন্ধন এতটাই ভঙ্গুর যে আমরা কোনো জায়গায় একত্রিত হলে আর নিজেদের মধ্যে কথা বলি খুব কম। দেখা যায় প্রায় প্রতিটি মানুষই নিজেদের হাতে থাকা স্মার্ট যন্ত্রটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার সঙ্গে আছে ছবি তোলা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা শেয়ার করা। পাশের বন্ধুটির সঙ্গে হাসিমুখে সেলফি তুললেও হয়ত খবরই রাখি না সে আসলে কেমন আছে। কৃত্রিম হাসির আড়ালে সে কোন দুঃখ লুকোচ্ছে কিনা। এভাবে বেড়ে যাচ্ছে আমাদের সামাজিক ও আত্মিক যোগাযোগ।

অন্যদিকে মানুষের নিজেকে প্রকাশ করার অন্যতম জায়গা ও মাধ্যম হল প্রকৃতি। প্রাকৃতিক পরিবেশ একজনের বেড়ে ওঠায় দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের নির্মল বিনোদনের জন্য দরকার খোলামেলা পরিবেশ আর খেলার মাঠ। একে অন্যের সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমেই শিশু একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। অথচ যত আধুনিক হচ্ছি আমরা ততটাই প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।

আমরা আমাদের শহর থেকে খেলার মাঠ উঠিয়ে ফেলছি। গ্রামকে স্মল টাউন এবং কোথাও কোথাও মিনি সিটি বানানোর প্রক্রিয়া চলছে। বলছি না এসব অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন শহরে খোলা মাঠ, মানুষের নির্মল বিনোদনের ব্যবস্থা রাখা। শুধু ইন্টারনেট যোগাযোগই তো সবটা নয়। শহুরে সুযোগ-সুবিধা অবশ্য প্রয়োজন, তবে আশা রাখি দিনের শেষে মানুষ যেন মানুষই থাকে। সে যেন স্মার্ট ডিভাইসের বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোন অস্তিত্ব না হয়ে ওঠে।

দেখা যাচ্ছে আত্মহত্যার অন্যতম কারণ ডিপ্রেশন। এর জন্য অনেক কিছু দায়ি হতে পারে তবে অন্যতম কারণ হল আমাদের অনিয়ন্ত্রিত জীবনব্যবস্থা। আমরা দেখা যায় বাস্তবতার মুখোমুখি না হয়ে অনলাইনে সময় দেই বেশি। অনেকেরই অনিদ্রার অভ্যাস গড়ে ওঠে আর অনিদ্রা হলে ডিপ্রেশনসহ নানারকম শারীরিক রোগের উৎস। তাই সুস্থ ও সুন্দর জীবনের জন্য আমাদের জীবনব্যবস্থায় পরিমিতি অত্যন্ত দরকার।

আবার অনেক ক্ষেত্রেই শিশু-কিশোর ও তরুণদের সাহায্য চাওয়ার জায়গা থাকে না। এর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসিক সমস্যা ও স্বাস্থ্য নিয়ে বোঝাপোড়ার জায়গা তৈরি করতে হবে। পরিবার ও বন্ধুদের একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে দেখতে হবে। সবাই যেন সবার সঙ্গে মনের কথা বলতে পারে সেই স্পেস তৈরি করা জরুরি। কেউ বিষণ্ণতা বা অন্য কোন মানসিক সমস্যায় ভুগছে কিনা তা খেয়াল করতে হবে ও প্রয়োজনে পাশে থাকার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।

সবার শেষে বলব আমরা মানুষ, রোবট নই। সেই গুহা জীবন থেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে সমাজ তৈরি করেছি। নিজেরা নিজেদের রক্ষা করেই টিকে রয়েছি পৃথিবীতে। পৃথিবীতে চলছে এক অতিমারি। লাখো মৃত্যু আর কোটি আক্রান্তের এই সময়ে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে বলা হচ্ছে একে অন্যকে ভাইরাস থেকে সুরক্ষা দিতে। আবারও পৃথিবী স্বাভাবিক হবে আর আমাদের নিজেদের রক্ষা করে চলতে হবে। তার জন্য চর্চা করতে হবে মানসিক শান্তি অর্জনের উপায়। একে অন্যেকে দেখা রাখার ও ভালো রাখার পদ্ধতি।

তথ্যসূত্র
১. ভেভিড হিউম এর প্রবন্ধ ও লেখনি
২. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট
৩. এমআইটি ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির মেন্টাল হেল্থ বিষয়ক জার্নাল ও ওয়েবসাইট

লেখক- শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, ঢাকা কলেজ

আত্মহত্যা

বিজ্ঞাপন

বরিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:৩১

বাঘায় কৃষককে গলা কেটে হত্যা
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৬:৪৩

আরো

সম্পর্কিত খবর