Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্মরণীয় ও বরণীয় চিত্তরঞ্জন দত্ত


২৬ আগস্ট ২০২০ ১৩:১৪

২৫ আগস্ট, মঙ্গলবার সকাল দশটা। টেলিভিশনে চোখ রাখতেই ব্রেকিং নিউজ, সি আর দত্ত নেই। মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৯টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ও বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, থেকে শুরু করে দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা।  সি আর দত্তের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান রাষ্ট্রপতি। শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অনন্য অবদান দেশ ও জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞ চিত্তে সঙ্গে স্মরণ করবে। আর ফেসবুক খুলতেই শোক আর শ্রদ্ধার স্ট্যাটাস। করোনায় বিষণ্ণ মনে আরেকটি বেদনা।

বিজ্ঞাপন

সি আর দত্ত’র পূর্ণনাম চিত্তরঞ্জন দত্ত। ছোটবেলায় যখন পড়তাম সি আর দত্ত রোড মনে করতাম এই মানুষটি বোধহয় অনেক আগেকার। কিন্তু যেদিন থেকে সমসাময়িক চিন্তা করতে থাকি তখন থেকেই জানতে পারি এই মানুষটি এখনও আলো ছড়াচ্ছেন সেদিন থেকেই নামটি ও নামের পেছনের পটভূমিটি ভাল লাগে। গর্ব হয়। গর্ব হয় এই কারণেই যে, মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার চারটি বীরত্বসূচক উপাধী দিয়েছেন। বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক। বীরশ্রেষ্ঠদের কেউ বেঁচে নেই। বেঁচে থাকা গুরুত্বপূর্ণ বাঙালী সাহসী সন্তানের উপাধী বীরউত্তম তার নামের সাথে জড়িয়ে আছে। যেখানে দেশে থাকা দুষ্কর হয়ে গিয়েছিল, যেখানে সংখ্যালঘু হিসেবে অনেকেই পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছিল, যখন লোভ-লালসায় জন্মভূমি ছেড়ে অনেকে পাকিস্তানকে সমর্থন করে হত্যাযজ্ঞে মেতেছিল সেখানে সি আর দত্ত নিঃসন্দেহে একটি বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

পাকিস্তান ব্যুরোর জরিপে জানা যায়, জনসংখ্যার ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু। এরপর ১৯৭০ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সেই হার নেমে এসে দাঁড়ায় ২১ থেকে ২২ শতাংশে। অর্থাৎ ৭ শতাংশ ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হারিয়ে গেল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ২৪ বছরে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হত্যা করতে হবে বা তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে হবে। একই সঙ্গে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে হবে। এই অভিপ্রায়ে তারা সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে গণহত্যা চালিয়েছিল। এটা পরিষ্কার যে একাত্তরের পরাজিত শক্তি সংখ্যালঘু হ্রাসকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশে একটি গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বের সংকট তৈরি করতে চায়। কারণ, তারা ভাবছে, যদি সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র করাও সহজতর হবে। সেই দৃষ্টিতে সি আর দত্ত তৎকালীন সিদ্ধান্ত ও অবদান নিঃসন্দেহে সাহসী ছিল। তিনি নিজে শুধু মুক্তিযুদ্ধে অবদানই রাখেননি আমার বিশ্বাস তার কারণেই সংখ্যালঘুরা স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রেরণা পেয়েছিল। দেশের জন্য কাজ করতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছিল।

চিত্তরঞ্জন দত্ত ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন । তার পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। তার বাবার নাম উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত এবং মায়ের নাম লাবণ্য প্রভা দত্ত।

শিলংয়ের লাবান গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। পরে তার বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে হবিগঞ্জে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে তিনি মাধ্যমিক পাস করেন। পরে কলকাতার আশুতোষ কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়ে ছাত্রাবাসে থাকা শুরু করেন তিনি। এরপর খুলনার দৌলতপুর কলেজের বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন। পরে এই কলেজ থেকেই বিএসসি পাস করেন।

শিক্ষাজীবনে চৌকস চিত্ত রঞ্জন ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। কিছুদিন পর সেকেন্ড লেফটেনেন্ট পদে কমিশ পান তিনি। ১৯৬৫ সালে সৈনিক জীবনে প্রথম যুদ্ধে লড়েন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে আসালংয়ে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন। ওই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে পুরস্কৃত করে।

বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন সি আর দত্ত। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি হেড কোয়ার্টার চিফ অব লজিস্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৯ সালে বিআরটিসি’র চেয়ারম্যান হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। এর পর ১৯৮২ সালে তিনি পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল খোয়াই শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন বাদে পূর্ব ও উত্তরদিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় ৪ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরে কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন সি আর দত্ত। দায়িত্ব নিয়েই প্রথমে সিলেটের রশিদপুরে ক্যাম্প তৈরি করেন সি আর দত্ত। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চা বাগান থাকার সুবাদে আড়াল থেকে শত্রুদের ঘায়েল করেন দ্রুত সময়ে। পরে তিনি রশিদপুর ছেড়ে মৌলভীবাজার ক্যাম্প স্থাপন করেন। তার অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীরউত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধে তার এমন অবদান অবশ্যই তাকে স্মরণীয় বলা যায়।

ঢাকার কাঁটাবন থেকে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কটি ‘বীরউত্তম সি আর দত্ত’ সড়ক নামে নামকরণ করা হয়। কর্মই মানব জীবনের সফলতার গল্প নির্মাণ করে। কর্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। কর্মের কারণেই যুগে যুগে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। প্রতিষ্ঠান স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকে। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয় কথাটি সত্য। সি আর দত্তের ইচ্ছে ছিল তাই জীবনের মায়া আর পরিবারের ভালবাসা ছিন্ন করে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তার অবদান জাতি কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে। তার জীবনী ও অবদান যুগে যুগে দেশপ্রেমে অনুপ্রেরণা যোগাবে। তার আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তার আদর্শে অসংখ্য চিত্ত রঞ্জন জন্ম হোক, দেশের জন্য মানুষের জন্য কাজ করবে সেই প্রত্যাশায় রইলাম।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সি আর দত্ত