সাক্ষরতা বৃদ্ধিতে কাজ করি সকলে
৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৬:২৭
মাঝে মাঝে ভাবতে অবাক লাগে যে, বইয়ের পাতায় আমরা যা পড়ি আমাদের অনেকের মা-বাবা অথবা দাদা-দাদী তা পড়তে পারে না। বিষয়টি নিয়ে আমার খুব কৌতূহল জাগত যে, তারা এটাকে কি আকৃতি হিসেবে মনে করে? তাদের কাছে কি সেটা ছবি, না না বোঝা একটি কলমের আঁচড় ? খুব আপসোসও হয় যদি আজকের বাংলাদেশ তারা পেত তাহলে কতই না তাদের চলায়-বলায় স্বাচ্ছন্দ্য থাকত। আজও অনেক বাবা-মা আছে তাদের সন্তানের খোঁজ নিতে মোবাইলটি অন্যের কাছে নিয়ে যেতে হয়। অনেককে বেড়ানোর জন্য বাইরে পাঠালে খোঁজ নিতে কষ্ট হয়। তারা কারো মুখে না শুনলে জানতে পারে না যানবাহনটি কোন স্থান অতিক্রম করছে। সেদিক বিবেচনায় আগামীর প্রজন্মের ভাবনায় সাক্ষরতা আন্দোলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৮ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। ব্যক্তি, সম্প্রদায় ও সমাজে সাক্ষরতার গুরুত্ব তুলে ধরতে ১৯৬৫ সালে ইউনেস্কো ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৬৬ সাল থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দিবসটি উদযাপিত হয়ে আসছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে প্রথম সাক্ষরতা দিবস পালন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে প্রতিবছর এই দিবসটি পালিত হচ্ছে। প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলাদেশে গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি উদযাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে‘কোভিড-১৯ সংকট: সাক্ষরতা শিক্ষায় পরিবর্তনশীল শিখন-শেখানো কৌশল এবং শিক্ষাবিদদের ভূমিকা’।
‘সাক্ষরতা অর্জন করি, দক্ষ হয়ে জীবন গড়ি।’ বহুভাষায় সাক্ষরতা, উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা’ ইত্যাদি ইত্যাদি প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে দিবসটি পালিত হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেন, আগামী ৮ সেপ্টেম্বর সারা দেশে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালন করা হবে। দেশে সাক্ষরতার হার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে এ হার ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এটিকে বৃদ্ধি করতে নানা ধরনের পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়েছে। ৬ সেপ্টেম্বর রোববার আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস-২০২০ উদযাপন উপলক্ষে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ইউনেস্কোর উদ্যোগে ১৯৯১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালন করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো এ দিবস উদযাপন করেন। এর ধারাবাহিকতায় সরকার প্রতি বছর আন্তর্জাতিক দিবস পালন করে আসছে। তবে প্রতিবছর দিবসটি পালিত হলেও অনুন্নত দেশ থেকে আমরা সাক্ষরতার হারে পিছিয়েই আছি। যদি প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে তাকাই দেখব, ভারতে সাক্ষরতার হার ৭৪.৪ শতাংশ, নেপালে ৬৬ শতাংশ, ভুটানে ৬৪.৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৯৮.১ শতাংশ, আমাদের পেছনে আছে পাকিস্তান ৫৫ শতাংশ ও আফগানিস্তান ২৪ শতাংশ। আমাদের আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারের সাক্ষরতার হার ৮৯ শতাংশ।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৯৭১ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ ভাগ। ১৯৯১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ দশমিক ৩। অর্থাৎ বিগত বিশ বছরে সাক্ষরতার হার বেড়েছিল ১৮.২৩। আর ২০০১ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ৪৭ দশমিক ৯। অর্থাৎ বিগত বিশ বছরে সাক্ষরতার হার বেড়েছিল ১১.৭৯। ২০০৮ সালে ৪৮ দশমিক ৮ ভাগ আর ২০০৯ সালের হিসাবে ৫৩ ভাগ। ২০০১ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সাক্ষরতার হার বেড়েছিল ৫.১। ২০০৯ থেকে ২০২০ এই ১১ বছরে শিক্ষার হার বেড়েছে ২১.৭ শতাংশ। দেশে একজন মানুষকেও নিরক্ষর রাখতে চায় না সরকার। তাই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার গ্রহণ করেছে বিভিন্ন প্রকল্প। তবে প্রকল্প অনুযায়ী স্বাক্ষরতার গতি বাড়েনি। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় নানা কর্মসূচির মাধ্যমে ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষকে সাক্ষরতার আওতায় আনা হয়েছে। বর্তমানে বেশ কয়েকটি প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষকে সাক্ষরতার আওতায় আনা হচ্ছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, সরকার এসডিজি এবং জাতীয় অঙ্গীকারের ৭ম পাঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের চতুর্থ লক্ষ্যে সাক্ষরতা বিস্তার, দক্ষতা উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির জন্য ৭ম পাঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টিতে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণের প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নকালে নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত সময়ের মধ্যে শতভাগ সাক্ষরতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তখন দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি বিভিন্ন কারণে। নিরক্ষরতা দূরের নামে ১৯৯১ সাল থেকে নেওয়া ৭টি প্রকল্পের ব্যাপারেই আছে নানা অভিযোগ। বাংলাদেশে বয়স্ক শিক্ষায় নেওয়া কোনো প্রকল্পে সফলতার ইতিহাস নেই। বেশিরভাগ প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে। তিন লক্ষাধিক মানুষকে বয়স্ক শিক্ষার আওতায় আনতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প চালুর পরিকল্পনা নেয় সরকার। তবে দাতা সংস্থার অভাবে পরবর্তী সময়ে সেটিও মুখ থুবড়ে পড়ে। সাক্ষরতার হার বাড়ানো নিয়ে পূর্বাপর সরকার একের পর এক প্রকল্প নিয়েছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে। কিন্তু সেসব প্রকল্প যে খুব বেশি সফল হয়েছে বলে মনে হয় না। ২০১৯ সালের শেষার্ধে এসে নীতিনির্ধারকেরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের পাঠকক্ষে ধরে রাখতে দুপুরের খাবার ও পোশাক দেওয়ার কথা ভাবছে। কয়েকটি এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রকল্প চালুও আছে। উদ্যোগটি ভালো। কিন্তু এটিকে সফল করতে পারেনি।
দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করতে প্রয়োজন একটি বাস্তবমুখী, টেকসই ও সমন্বিত পদক্ষেপ এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলে দেশ নিরক্ষরমুক্ত করতে হবে। কিন্তু সেই লক্ষ্য থেকে অনেকটাই পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গত এক বছরে সাক্ষরতার হার বেড়েছে মাত্র ০.৮০ শতাংশ। সাক্ষরতার হার নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি তথ্যে এখনো বড় ফারাক। এমনকি সাক্ষরতার আন্তর্জাতিক সংজ্ঞার সঙ্গেও আমাদের সাক্ষরতা কার্যক্রমের মিল নেই। ফলে গতিহীন সাক্ষরতা কার্যক্রমে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করার পরিকল্পনা দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
সাক্ষরতা একটি দেশের উন্নয়নের অতি পূর্বশর্ত। আমরা যতই বলি দেশের উন্নতি হচ্ছে নিরক্ষর ব্যক্তি কিন্তু সেটা উপভোগ করতে পারছেন না। ফলে তার কাছে সেই উন্নয়ন চোখে পড়ছে না। পৃথিবীতে এমন একটি দেশও নেই যে শতভাগ সাক্ষর হয়েও গরীব। প্রতিটি দেশই আগে শতভাগ বা তার কাছাকাছি সাক্ষর হয়েছে, তারপর উন্নতি করেছে। আমাদের দেশের ২৬ শতাংশ মানুষকে নিরক্ষর রেখে কি সামনে এগোতে পারব? সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ করার কথা বলছে। কিন্তু সেটি কি বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিরক্ষর রেখে সম্ভব? নিরক্ষর রেখে সরকার যেমন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে পারবেন না ঠিক তেমনি সরকার বড় বড় প্রকল্প দিয়েও সাক্ষরতার হার বাড়াতে পারবেন না আমরা যদি সৎ ও দায়িত্বশীল না হয়। তাই দেশের উন্নয়নের জন্য দেশের সাক্ষরতার হার বাড়ানো দরকার। আর এই সাক্ষরতার হার বাড়াতে সকলের প্রচেষ্টার দরকার। সকলে যদি নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সৎ ও স্বচ্ছ থাকি দায়িত্ববান হই তাহলেই বাংলাদেশ বদলে যাবে। তাই আমি বলি, “সাক্ষরতা বৃদ্ধিতে কাজ করি সকলে”।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামলেখক।