চাকরিতে আবেদনের ফি এবং বেকারদের দুঃখগাথা
২৩ জানুয়ারি ২০২১ ১৯:১৯
বেকারত্ব একটি দুর্দশা ও হতাশার নাম। বাংলার আকাশে প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হচ্ছে হাজার হাজার বেকারের আকাশ ভাঙা আর্তনাদ। আমরা সবাই জানি প্রতি বছর হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়। কিন্তু সমস্যা হলো—যে পরিমাণ গ্র্যাজুয়েট গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে বের হয় তাদের অধিকাংশই চাকরিতে যোগদান করতে পারে না, কারণ চাকরিপ্রার্থীর তুলনায় ফাঁকা পদ সংখ্যা খুবই নগণ্য। যেহেতু পদ সংখ্যা খুবই নগণ্য তাই অধিকাংশ চাকরিপ্রার্থী যে কোনো সার্কুলার হলেই আবেদনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন।
ঠিক এই যে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঝোঁক এটাকেই কাজে লাগান সরকারের বিভিন্ন চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি চাকরিতে আবেদনের জন্য লাগে হাজার হাজার টাকা, কিন্তু পদ সংখ্যা খুবই কম। করোনাকালে চাকরির বিজ্ঞপ্তি সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিল, তাইতো করোনার প্রকোপ যখন একটু কমে এসেছে ঠিক তখনই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান চাকরির বিজ্ঞপ্তি দিতে শুরু করেছে, তবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন ফি আকাশচুম্বী। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কথা বলা যেতে পারে যেমন সম্প্রতি প্রকাশিত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে নবম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব পদের জন্য আবেদন ফি ধরা হয়েছে ১১২০ টাকা। দশম গ্রেড বা সমমানের পদের জন্য আবেদন ফি ধরা হয়েছে ৭৮৪ টাকা এবং দশম গ্রেডের নিচের পদগুলোতে আবেদন ফি ধরা হয়েছে ৫৬০ টাকা। এছাড়া ৪৩তম বিসিএস পরীক্ষায় আবেদনের জন্য ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০০ টাকা। এনএসআই-এর আবেদনের জন্য ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০০ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদনের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২০০ টাকা। এভাবে প্রত্যেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বেকারদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
একজন বেকার যখন চাকরির জন্য হাহাকার করছেন ঠিক তখন সরকারি নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান চাকরি ফি আদায়ের নামে বেকার তরুণদেরকে হতাশায় নিমজ্জিত করছে। এমনিভাবে বেকারত্ব যখন একজন তরুণকে ঘিরে ধরে তখন সেই তরুণ হতাশার সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করে। আর এভাবে তাদের কাছ থেকে চাকরির পরীক্ষার ফি আদায়ের নামে কোটি কোটি টাকা আদায় করা যেন নিষ্ঠুর মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। অনেকেই আছেন টিউশনি করে বা মাঠে কাজ করে সেই টাকা দিয়ে চাকরিতে আবেদন করছেন। আবার এমন চাকরিপ্রার্থী আছেন যার ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই কিন্তু শুধুমাত্র চাকরিতে আবেদনের জন্য তাকে গুনতে হচ্ছে হাজার হাজার টাকা।
দেশের অধিকাংশ বেকার তরুণ-তরুণী চাকরির জন্য আবেদন ফি জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন, হারিয়ে ফেলছেন একটি সরকারি চাকরিতে যোগদানের স্বপ্ন। এভাবে ঝরে পড়ছে হাজার হাজার বেকারের সারাজীবনের লালিত স্বপ্ন। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো—সম্প্রতি একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্কুলারে শুধুমাত্র চাকরির যোগ্যতা সম্পর্কে জানার জন্য ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে এবং অনলাইনের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। এই মনোভাব দেখলেই বোঝা যায় বেকাররা আসলে কতটা অসহায় চাকরিদাতাদের কাছে। চাকরিদাতারা বেকারদেরকে ফুটবল মনে করে এবং তারা মনে করে এদেরকে যেদিকেই লাথি দেওয়া হবে, যেভাবেই লাথি দেওয়া হবে, ঠিক সেভাবেই গড়িয়ে পড়বে এরা।
পুরো বিশ্ব যখন করোনা মহামারিতে থমকে গেছে, লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, কোটি কোটি মানুষ যখন তাদের চাকরি হারিয়েছে, ঠিক তখন আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরির আবেদন ফি না কমিয়ে বরং আরও বেশি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা। চাকরিপ্রার্থী অধিকাংশ বেকার তরুণ-তরুণী পড়াশোনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা সদ্য পড়াশোনা শেষ করেছেন, তাই তাদের হাতে টাকা পয়সা থাকে না বললেই চলে। একদিকে পড়াশোনার খরচ জোগাড় করা অন্যদিকে চাকরিতে আবেদনের ফি ও চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় বারবার যাতায়াত করা, থাকা খাওয়া সব মিলিয়ে খুবই করুণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় একজন চাকরিপ্রত্যাশী বেকারের জীবনে। আর তাইতো আমরা পত্রিকার পাতা খুললেই দেখতে পাই চাকরি না পেয়ে অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা। দিনদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস শিক্ষার্থীর সংখ্যাও সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, শুধু বাড়ছে না চাকরির ক্ষেত্র। ফলে অদম্য স্বপ্নগুলো হারিয়ে যাচ্ছে কালের অতল গহ্বরে। স্বপ্নগুলো ঢাকা পড়ছে সময়ের নিষ্ঠুর পরিক্রমায়।
যে দেশে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু হয় গণরুমে জীবন যাপনের মাধ্যমে, সে দেশে অতিরিক্ত চাকরির ফি আদায় করা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এমনকি বেকারদের উপর এটি একটি মানসিক অত্যাচারও বটে। চাকরিদাতাদের কারোরই এদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। কারণ তারা চাকরি প্রত্যাশীদেরকে তো মানুষই মনে করেন না।
চাকরিদাতাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক এবং চাকরিপ্রার্থীদের সুবিধার্থে চাকরির পরীক্ষার ফি নামমাত্র নির্ধারণ করা হোক এই প্রত্যাশা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে। তরুণরাই গড়বে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ, মুজিববর্ষে এই হোক আমাদের এগিয়ে চলার হাতিয়ার।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়