আল জাজিরার ডকুমেন্টারি ও কিছু প্রশ্ন
২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২২:২৬
All the Prime Minister’s Men- আগ্রহ না থাকার পরেও এক বিশেষ মহলের হৈচৈ শুনে জীবন থেকে এক ঘন্টা নষ্ট করলাম। দেখার পর আমার একমাত্র অনুভূতি, নামটা তো এমনও হতে পারতো-
All the Mohammadpur’s Men
All the Dhakaiya Men
All the Bangladeshi Men
All the Gangstar
All the Corrupted Men or,
All the Ahmed Brothers
কিংবা ডকুমেন্টারিতে আরও অনেক ব্যক্তি আছে যাদের সরাসরি আক্রমণ করে এই তথাকথিত ডকুফিল্মের নাম দেওয়া যেতো! এমনকি এসবের সাথে পুরো এক ঘন্টার ভিডিওতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নুন্যতম কোনো কানেকশন দেখাতে পারে নাই, তাও তারা নাম দিয়েছে All the Prime Minister’s Men!
কিন্তু এই ডকুমেন্টারিতে একমাত্র টার্গেট যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাই এমন উদ্ভট নাম! একমাত্র তাকে দুর্বল করতে পারলেই বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেওয়া যাবে।
ব্রিটিশ অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০৩৫ সালে বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর ২৫ তম বৃহৎ অর্থনৈতিক দেশ। পেছনে ফেলবে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ডেনমার্ক, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, নরওয়ে, আর্জেন্টিনা, ইসরায়েল, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, সুইডেন, ইরান, তাইওয়ানের মতো দেশকে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থেকে গেলে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উন্নত দেশ। এতে পরাজয় আর কারও নয়, তাদেরই যারা বাংলাদেশ চায় নি।
শেখ হাসিনার গত ১২ বছরের রাষ্ট্র পরিচালনার সময়ে রাজাকার শিরোমণি গোলাম আজমের ছেলেসহ প্রো পাকিস্তানি ও পাকিস্তানফেরত সেনা কর্মকর্তারা বিদায় নিয়েছে। গড়ে উঠেছে একটি পুরোপুরি বাংলাদেশী প্রজন্মের সেনাবাহিনী। এই সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করতে পারলে কাদের লাভ? যারা এখনও মনেপ্রাণে পাকিস্তানি আদর্শ ধারণ করে।
আল জাজিরার বাংলাদেশের প্রকাশ্য সহযোগী বিএনপি-জামায়াতের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান সমন্বয়ক, ড. কামাল হোসেনের মেয়ের জামাতা, ডেভিড বার্গম্যান। মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা, রাজাকারের তালিকাসহ জামায়াত এ পর্যন্ত যা যা মিথ্যাচার করে এসেছে সবই বার্গম্যানের লেখনীতে ফুটে উঠছে। তার একমাত্র লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে আক্রমণ করে লেখা। বার্গম্যান যেন জামায়াতে ইসলামির বিদেশি মুখপাত্র! জামায়াতে ইসলামির যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে আন্তর্জাতিক লবিস্ট নিয়োগেও ভূমিকা রেখেছিলো এই বার্গম্যান। একাত্তরে জামায়াতের যা ভূমিকা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেই একই অভিযোগে অভিযুক্ত নাৎসিদের পক্ষেও এমন অর্থলোভী নির্লজ্জ দালাল খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু জামায়াতকে অনেক ভাগ্যবান বলা যায় এমন অনুগত দালাল খুঁজে পাওয়ায়।
বার্গম্যানরা মূলত বাংলাদেশবিরোধী সব পক্ষকে নিয়ে ঐক্য করার কাজটা করে যাচ্ছেন। আমেরিকায় এসকে সিনহা, যুক্তরাজ্যে তারেক রহমান, জঙ্গিবাদের অভিযোগে বিদেশে পলাতক কয়েকজন জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা, বাংলাদেশের বিএনপি-জামায়াত, হেফাজত, মোল্লা সম্প্রদায় ও আন্তর্জাতিক প্রোপাগাণ্ডা মিডিয়া আল জাজিরাসহ সকল পক্ষকে এক জায়গায় আনতে চাইছেন বার্গম্যানরা। তাই এবার আটঘাট বেঁধেই নেমেছেন। তবে মাঠের রাজনীতিতে নয়, পেছন দরজা দিয়ে ক্ষমতা পরিবর্তনের ইচ্ছে নিয়ে।
কিছু প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আল জাজিরাকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি পারলে আবার ডকুমেন্টারি বানাক এসব যুক্তি খণ্ডন করে।
- ছবি দিয়েই যদি সব প্রমাণ করা যায় তাহলে তো অনেককিছুই নিজেদের ইচ্ছামত বর্ণনা দেওয়া যায়। একসময় জেনারেল জিয়াউর রহমানও বাংলাদেশ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুগত ছিলো। ছবিও আছে একসঙ্গে অনেক, তাই বলে জিয়া কি বঙ্গবন্ধুর একান্ত লোক ছিলো? ৭৫ থেকে ৮১ এর কর্মকাণ্ডে জিয়া বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আসলে ভেতরে ভেতরে পাকিস্তানই চাইতেন। জেনারেল আজিজ আহমেদের অন্য আরেক ভাইয়ের সাথে প্রধানমন্ত্রীর পুরোনো ছবিতেও তাই কিছু প্রমাণ করে না। পুরো ডকুমেন্টারিতে এই ছবি বারবার দেখিয়ে আল জাজিরা কি প্রমাণ করতে চাইছে?
- ডকুমেন্টারিতে আরও বলা হয়েছে জেনারেল আজিজ আহমেদ কোথাকার কোন সামিকে ইমেলেই হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু সেই হুমকির প্রমাণ কই? দেখে মনে হল নিজেরাই স্ক্রিনে এগুলো লিখেছে। নিজেরা নিজেরা স্ক্রিনে কিছু একটা লিখে দিলেই তো হবে না। ইমেইল দেখালেই তবে বিশ্বাস করবো।
- জোসেফ ইস্যু বাংলাদেশে অনেক পুরনো। এটা বারবার বললে আসলে কি প্রমাণ হয়? প্রায় দুই দশক জেল খাটার পর তাকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দিয়েছেন। জোসেফ কি শফিউল আলম প্রধানের চেয়েও বড় অপরাধী ছিলেন? জিয়াউর রহমান তো ফাঁসি থেকে ফিরিয়ে প্রধানকে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে ফিরিয়ে এনেছিলেন। আল জাজিরা সেসব নিয়ে কখনো কোনো রিপোর্ট করেছে?
- সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের নামে যে কল রেকর্ডিং চালানো হয়েছে সেটা আমার মতে ১০০ শতাংশ বানোয়াট। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন যে কারও কন্ঠ নকল করে বক্তব্য রেকর্ড করা যায়। আর আজিজ আহমেদ যদি বলেও থাকেন তার ভাইয়েরা দুঃসময়ে আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রেখেছেন, এতে অন্যায়ের কি আছে?
- ডকুমেন্টারিতে সেনাপ্রধানের ছেলের বিয়ের অনেকগুলো ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়েছে। সেখানে কিন্তু তার ভাইয়েরা অনুপস্থিত। তাহলে যেসব বিয়ের ছবি দেখানো হয়েছে তার ভাইদের উপস্থিতি দেখিয়ে, সেগুলো ফেইক ও এডিটেড হবার সম্ভাবনা শতভাগ।
- পুরো ডকুমেন্টারি যার বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে বানানো হলো, সেই হারিস আহমেদ যদি বলে তার কথায় দেশ চলে, তাহলে কি সেটাই সত্য হয়ে গেলো? এসবের প্রমাণ কই?
- হারিসের ফোনের অপরপ্রান্তে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার কথা শোনানো হয়েছে, তার নাম প্রকাশ করা হয়নি কেন? বা বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী কোন একাউন্টে কার মাধ্যমে টাকা নেয় সেটার একটা প্রমাণ তো থাকবে, সেটা কই? প্রমাণ ছাড়া কি এমন বক্তব্য প্রচার করা আইনসঙ্গত?
- মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসকে আনিস আহমেদকে সাহায্য করার জন্য দোষারোপ করা হলো, কিন্তু দূতাবাসের দায়িত্বশীলদের বক্তব্য কই? পুরো ডকুমেন্টারি শেষেও তো আজিজ আহমেদের ভাইদের ক্যামেরার সামনে ওপেন করে গোপনে ধারণ করা ভিডিও দেখিয়ে বক্তব্য নেওয়ার কথা, আল জাজিরা সেই সৎ সাহস দেখালো না কেন?
- ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো কুটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক নাই। ইসরায়েল ইস্যুর মিথ্যাচার টেনে ভিডিওতে সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মোল্লা সম্প্রদায়কে দেখানো হলো কেন? মোল্লাদের উসকে দিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ সরকারের বিরুদ্ধে ইসলামি জিহাদ করানোর জন্যই কী? আল জাজিরা অতীতেও এমনিভাবে জঙ্গিবাদ উস্কে দিয়েছে।
এসব প্রশ্নের জবাব আল জাজিরা কখনও দিতে পারবে না। কারণ, আল জাজিরাকে ইতোমধ্যে জঙ্গিবাদের মদদদাতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রশ্ন আসতে পারে সেগুলো কীভাবে? আসুন আমরা দেখে নেই আল জাজিরার বিরুদ্ধে কেন এমন অভিযোগ করা হয়।
- ওসামা বিন লাদেনের সন্ত্রাসবাদী বক্তব্য প্রচার করার একমাত্র প্লাটফর্ম আল জাজিরা।
- বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করা একমাত্র আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও আল জাজিরা।
- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখের জায়গায় ৩ থেকে ৫ লাখ বলে দাবি করে আল জাজিরা।
- ৫ মে ২০১৩ সালে শাপলা চত্ত্বরে নিহতের সংখ্যা নিয়েও গুজব ছড়ায় আল জাজিরা।
- বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের ব্লগারদের ‘নাস্তিক’ আখ্যা দেয় আল জাজিরা যা তাদের জঙ্গি সংগঠনগুলোর টার্গেটে ফেলে।
- জাতিসংঘের মতে বিশ্বব্যাপি সরাসরি সন্ত্রাসবাদে মদদদাতা, আইএস-এর আর্থিক সাহায্যকারী ও বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামির মতো উগ্র ইসলামিক মতাদর্শে বিশ্বাসী মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষে কাজ করার জন্য সৌদি আরব, বাহরাইন, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও জর্ডানের মতো মুসলিম দেশসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব মুসলিম দেশে নিষিদ্ধ আল জাজিরা।
এতো অপকর্মের বিপরীতে আল জাজিরার নুন্যতম বস্তুনিষ্ঠতাও খুঁজে পাওয়া যায় না। - আল জাজিরা কি কখনও ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত প্রো-পাকিস্তানিদের ক্ষমতা দখল, সেনাশাসন, সীমাহীন দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, সারাবিশ্বের সাথে কুটনৈতিক পরাজয়সহ বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেওয়ার মহা আয়োজন নিয়ে কখনো ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলো? উত্তর হলো ‘না’।
- আল জাজিরা কি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, খুনিদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়া, এখনো আমেরিকা, কানাডায় পালিয়ে থাকা, খুনীদের দল ফ্রিডম পার্টি নিয়ে কখনও কিছু বলেছে? উত্তর হলো, ‘না’। উলটো ফ্রিডম পার্টির নেতাদের খুন হওয়া নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছে ১ ঘন্টার ভাইরাল ভিডিওতে।
- আল জাজিরা কি ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের বিএনপি-জামায়াতের ৫ বার দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ানশিপ, জঙ্গিবাদে সরাসরি মদদ ও ব্যার্থ রাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে যাওয়া নিয়ে কিছু লিখেছে? উত্তর হলো ‘না’।
আল জাজিরা এসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের তেমন কোনো ক্ষতি না করতে পারলেও কিন্তু দেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে অপমান করেছে। আজ আল জাজিরার ১ ঘন্টার পাতানো ডকুমেন্টারিতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও গোয়েন্দাবাহিনীকে যেভাবে দুর্নীতিবাজ বলা হয়েছে ও ছোট করা হয়েছে, এরপরও যারা উল্লাসিত ও উচ্ছ্বসিত তারা কারা? তারা আসলে গোলাম আজমদের রেখে যাওয়া প্রো-পাকিস্তানি কুসন্তান।
আজ সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি এইটুকু বলতে চাই, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, যে যাই বলুক।’
আমরা তো এমন লৌহমানবী প্রধানমন্ত্রীকেই চেয়েছিলাম। ইতিহাস সাক্ষী, মোশতাক-জিয়া-এরশাদ-খালেদা গংরা ক্ষমতায় থাকার জন্য বিদেশি অপশক্তির কাছে মাথা বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু জাতির পিতা ও তার কন্যা কখনো মাথা নোয়ায় নি। তাই গর্বের সাথে বলতে চাই, We Are Prime Ministers Men. (#We_are_primeministers_men)
লেখক – কলামিস্ট, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী
সারাবাংলা/আরএফ