আল জাজিরা-জামাত-বিএনপি, আদর্শিক ও আর্থিক সংযোগে একাকার
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৭:০৭
১৯৮১ সালে আরব আমিরাত, সৌদি আরব, বাহরাইন, কাতার, কুয়েত ও ওমান—এই ৬টি দেশকে নিয়ে গঠিত হয় জিসিসি, অর্থাৎ উপসাগরীয় সহযোগী সংস্থা। এই সংস্থার দেশগুলোর একে অপরের সঙ্গে একসময় গভীর সম্পর্ক ছিল। খুব কম বিষয়েই জিসিসি’র দেশগুলোর মতের অমিল হতো। এই ৬টি দেশের সংস্কৃতি, ধর্ম, আমদানি-রফতানিসহ তাদের উৎপাদিত পণ্যও প্রায় একই জাতীয় হওয়ার ফলে আরও বেশি একাত্মতা ছিল তাদের মধ্যে। অভ্যন্তরীণ এই বন্ধন দ্রুত তাদের অর্থনীতির বাড়বাড়ন্তে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এই বন্ধনই আজকের ধনী অবস্থানে তাদেরকে নিয়ে এসেছে।
এই ৬টি দেশের মধ্যে মাত্র ১১,৫৭১ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের একটি দেশের এত পরিমাণ টাকা যে, দেশের ভেতরে অবকাঠামোগত প্রভূত উন্নয়ন ঘটানোর পরেও টাকা রাখার আর জায়গা নেই তাদের। এই ছোট্ট দেশটি হচ্ছে কাতার। শুধু জিসিসি’র ৬টি দেশের মধ্যে কাতার যে সবচেয়ে এগিয়ে তা কিন্তু নয়, পুরো বিশ্বের মধ্যেও কাতারের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো। কাতার তাই ২০০০ সালে তৈরি করল কিউআইএ, অর্থাৎ ‘কাতার ইনভেস্টিং ফান্ড’ নামের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের এক তহবিল। বিশ্বের বিভিন্ন ধনী ধনী দেশে এই নাদুসনুদুস তহবিল থেকে অর্থ বিনিয়োগ করতে শুরু করল কাতার।
কানাডা, আমেরিকা, থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের অনেক দেশে নিয়মিত বড় বড় বিনিয়োগ করা শুরু করল কাতার। যেখানে কাতারের মতো দেশে এসে ইউরোপের বিনিয়োগ করার কথা ছিল, সেখানে শুধু অঢেল তেল সম্পদের মালিক হিসেবে টাকা কামিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোতেই বরং বিনিয়োগের বন্যা বইয়ে দিতে শুরু করে প্রায় আমাদের সিলেট বিভাগের সমান ভূখণ্ডের ওই দেশটি। কিন্তু ব্যাংকে অতল টাকা থাকলেই তো শুধু আর এ কালে প্রভাবশালী হওয়া যায় না, দরকার অন্য ধরনের ক্ষমতাও। তাছাড়া বিশ্ব দরবারে দেশ হিসেবে জাতে উঠাও জরুরি। কারণ আরব জাতির মান মর্যাদা ইউরোপীয় বা দূর প্রাচ্যের মানুষের কাছে খুব একটা উচ্চপর্যায়ের নয়। আরবদের সবসময়ই ওইসব দেশগুলোর মানুষ বর্বর জ্ঞান করে থাকে। তাই নব্য ধনী কাতারের এক নতুন ফ্যাসিনেশন তৈরি হলো। সেই ফ্যাসিনেশনটা হলো—সোজা কথায়, টাকা খরচ করে জাতে উঠার এক ফ্যসিনেশন। ‘টাকার পাহাড় আছে কিন্তু আরব গোয়ার’ এই ক্যাটাগরি থেকে নিজেকে বের করে আনার জন্য সেই টাকাকেই ব্যবহার করা শুরু করল কাতার। তবে বিশ্বে দেশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানে থাকা চাই দখল। দরকার আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক, বিশেষত ইসলামিক ও ব্লক পলিটিকসে নিজেকে প্রভাবশালী করা। কিন্তু শুধু বেহুদা বেশুমার টাকা ঢাললেই তো আর এসব হয় না। তাই কাতার হাটলো অন্য পথে।
আবার আসি জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর প্রসঙ্গে। জিসিসির দেশগুলোর মধ্যে মোড়ল বলতেই আছে এক সৌদি আরব। কারণ অর্থবলে সৌদি আরব কাতারের প্রায় সমান, আর মুসলিম বিশ্বে বাকি আরব দেশগুলোর বড়ভাই। তাই সৌদির সাথেই বন্ধুত্ব করতে চায় সবাই, কাতারকে আরও পাঁচটা ধনী দেশের মতোই সবাই দেখে যার প্রচুর টাকা আছে, কিন্তু লিডারশীপে সামর্থ্য নেই। আবার আমেরিকার মতো দেশ যখন মিডিল ইস্টে বা মুসলিম বিশ্বে তার রিপ্রেজেন্টেটিভ খুঁজে, তখন সবার আগে স্বভাবতই সৌদি সে সুযোগ পায়। মিডিল ইস্টে সৌদি আরবকে দিয়েই বাকি সকল আরব দেশে নিজের নীতি বাস্তবায়ন করে আমেরিকা। অর্থাৎ, মিডিল ইস্টে আমেরিকার ডিলার বা এজেন্ট হলো সৌদি আরব। আর স্বাভাবিকভাবেই একমাত্র ডিলার হওয়ায় আমেরিকা থেকে সবচেয়ে বেশি সুযোগ সুবিধা বগলদাবা করে সৌদি। বিশ্বের শীর্ষ ধনী হয়েও আমেরিকার মুখ্য সাগরেদ না হতে পারার এই দুঃখ কাতারকে বরাবরই তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই তারা মাঠে নামল বিশ্বের বড় ইভেন্টগুলো আয়োজন করে নিজের দিকে নজর কাড়তে। আর বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইভেন্টের একটি হলো বিশ্বকাপ ফুটবল, তাই যে করেই হোক আগুন গরমের এই দেশেও নাকি বিশ্বকাপের মতো ইভেন্ট হওয়া চাই। নানা সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও কাতার নিজ দেশে বিশ্বকাপ আয়োজন করবেই বলে গো ধরল। এমন চোখ ধাঁধানো প্রজেক্ট দেখাল যে অনেকেই গরম নিয়ে আর প্রশ্ন তুললো না। কিন্তু তাতেও তো আর বিশ্বকাপের মতো ইভেন্ট নিশ্চিত হবে না। তাই দরকার বিকল্প রাস্তা। কাতার ঘুষ দিয়ে ফিফার মতো বড় অর্গানাইজেশনের মাথা নষ্ট করে দিতে সফল হলো। ফিফাকে ঘুষ দেওয়ার অসংখ্য তথ্য প্রমাণ পরে ফাঁস হয়েছে, যার ফলে ফিফার কর্মকর্তারাও শাস্তির মুখে পড়েছেন। কিন্তু কাতার এতই টাকার খেল দেখাল যে তাদের কোনো শাস্তি হলো না। এই গেল এক দিক।
এদিকে বিশ্ব রাজনীতিতে নাড়াচাড়া করার মতো এক তেল ছাড়া আর কোনো সম্পদ নেই কাতারের। নেই অস্ত্রের বিশাল মজুদ, নেই চমৎকার জিওপলিটিক্যাল এডভান্টেজ। তাই কাতার নিলো আধুনিক যুগে সবচেয়ে ক্ষমতাধর অস্ত্রের সাহায্য। সেই অস্ত্র হলো মিডিয়া। কাতার তৈরি করল আল-জাজিরা নামক এক বিগ বাজেটের বিগ মিডিয়া। বিগ বাজেট নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই কারণ পেট্রো ডলারে তহবিল ঠাই নাই ঠাই নাই করছে। আল জাজিরা কাতারের রাষ্ট্রীয় নিউজ নেটওয়ার্ক। আমাদের বিটিভির মতোই। কিন্তু পার্থক্য হলো বিটিভিতে বাজেট নেই, আল জাজিরায় অভাব নেই।
যেহেতু রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম তাই এর আচরণ থেকে কাতারের পররাষ্ট্র নীতি পড়া যায়। ১৯৯৬ সালে আল জাজিরার কার্যক্রম শুরু হলেও চ্যানেলটি জনপ্রিয়তা পায়—যখন কাতার আঞ্চলিক রাজনীতিতে নাড়াচাড়া দেওয়ার উদ্যোগ হাতে নিল। এইসব অযাচিত নাড়াচাড়ার ফলেই ২০১৭ সালে জিসিসি ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। আল জাজিরা নিউজের কারণেই কাতারের সঙ্গে ৩ বছরের জন্য সৌদি আরব কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে রেখেছিল। এই সম্পর্ক ছিন্নের যাত্রায় সামিল হয় আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশর যারা নিজেও আল জাজিরার বিভিন্ন নিউজের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৩টি দাবি রাখা হয় কাতারের সামনে যার একটি হলো আল জাজিরা নিউজ চ্যানেলটি বন্ধ করো। একটি নিউজ চ্যানেলের জন্য এই বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেল কেন এই বিষয়টি নিশ্চয়ই ভাবার আছে।
যদিও সবশেষে এই ২০২১-এ এসে কাতারের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে ওই আরব দেশগুলো, কিন্তু এর রেশ কিন্তু থেকে যাবে দীর্ঘদিন। কাতার চায় তার টাকার প্রভাবে এই অঞ্চলের নেতা হতে, কিন্তু নেতৃত্ব দেওয়ার সামর্থ্য তাদের নাই। টাকা থাকলেই যে সবাই নম নম করবে এরকম কিছু নেই। তাই কাতার সেই মোড়লের আসনে বসতে পারছে না।
আল জাজিরা দিয়ে কাতার তার অবস্থান থেকে যতটুক খেলা সম্ভব খেলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যখনই কোনো আন্দোলন হয়েছে সবার আগে এক্সক্লুসিভ নিউজ হিসেবে আল জাজিরাই আন্দোলনের ভিন্ন দিক বিশ্বকে দেখাচ্ছে বলে অনেক জিনিস সময়ে সময়ে প্রচার করেছে। ২০১৩ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে যখন শাহবাগসহ সারাদেশে আন্দোলন হলো, তখন আল জাজিরা পক্ষ নিলো যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে। এখানে আল জাজিরার পলিটিক্সটা কী? লক্ষ্য করুন। কাতার হলো ওহাবি-সালাফি রাষ্ট্র। কাতার যদি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কোনো রাষ্ট্রকে কবজা করতে চায় তবে তার দরকার সেদেশের ওহাবি-সালাফিপন্থীদের চাঙ্গা করা। আর বাংলাদেশে জামাত-ই ইসলামি হলো সেই গোষ্ঠী। জামাত-ই ইসলামি হলো জঙ্গিবাদীদের স্থানীয় এজেন্ট। আর জামাতের কবজায় বিএনপি নামক বড় একটি দল। তাই জামাত-বিএনপির এজেন্ডাই হলো এদেশে আল জাজিরার এজেন্ডা। জামাত বিএনপির দরকার যে কোনোভাবে ক্ষমতায় যাওয়া। দরকার দলের বড় বড় যুদ্ধাপরাধীদের প্রাণ বাঁচানো। এ কাজে দরকার ক্ষমতাসীন সরকারের চরিত্র হনন। কারণ জনগণের সমর্থনে আর ক্ষমতায় যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আল জাজিরা আর জামাত-বিএনপির এজেন্ডা এক হলো এসব প্রশ্নে। অর্থাৎ, যে করেই হোক দেশকে ওহাবি রাষ্ট্র বানাতে হবে। এ জন্য জামাত-বিএনপিকে রাজনীতিতে টিকে থাকতে হবে। এ জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া যাবে না। এসব বিষয় মিলে এক আদর্শিক সংযোগ তৈরি হলো আল জাজিরা ও জামাত-বিএনপি গংয়ের মধ্যে। এদিকে ক্ষমতায় যেতে ও যুদ্ধাপরাধের মতো বড় বিচার থেকে বাচতে ও দুর্নীতির সাজা থেকে বাচতে জামাত-বিএনপির টাকার কুমিররা হয়ে উঠলো মরিয়া। তারা টাকা ঢালা শুরু করল বিদেশি লবিং খাতে। কিনতে থাকলো সাংবাদিক। আর এই সাংবাদিকরাও বেছে নিল আল জাজিরার মতো প্রতিষ্ঠান। কারণ আগেই বলেছি, আল জাজিরার সঙ্গে এজেন্ডার এক আদর্শিক মিলন আছে তাদের। তাই আল জাজিরা ব্যবহার করা আরও সহজ হলো বার্গম্যানের মতো অসৎ সাংবাদিকদের। আদর্শিক ও আর্থিক স্বার্থের মিলনে আল জাজিরা-জামাত-বিএনপি সংযোগ হয়ে উঠলো শক্ত এক সরকারবিরোধী প্রপাগান্ডা মেশিন।
আল জাজিরা নিউজের বাস্তব রূপ জানতে হলে একটি হিন্দি সিনেমা দেখার পরামর্শ দেব। সিনেমাটির নাম ‘মিশন ইস্তাম্বুল’। যদিও এই ছবিতে একটি মিডিয়া হাউজ কীভাবে ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহৃত হয় তা দেখানো হয়েছে, ঘটনা তারা ঘটিয়ে তারপর নিউজও সবার আগে তারাই প্রচার করে। এর থেকেই তারা সবার থেকে আলদা হয়ে যায় এবং কাটতিও তাদের সব থেকে ভালো থাকে। আল জাজিরার স্টাইল অনেকটাই এরকম।
লেখক: শিক্ষার্থী