আল জাজিরার প্রতিবেদন ও আমার ভাবনা
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:৫৪
ওরা সবাই প্রধানমন্ত্রীর লোক
‘ওরা সবাই প্রধানমন্ত্রীর লোক’ নামে কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা একটি থ্রিলারধর্মী নাটক বানিয়েছে। যেটিকে তারা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বলে দাবি করেছে। ৬৪ মিনিটের প্রতিবেদনটিতে চমৎকার ছবি, গ্রাফিকস, শব্দ ও ক্যামেরার কাজ দেখেছি আমরা। ড্রোন শটগুলোও খুবই ভালো ছিল। পৃথিবীর চারটি শহরে শুটিং হয়েছে। বেশ দামি এই প্রোডাকশন। কিন্তু পুরাতন জানা তথ্যে ঠাসা ছিল তাদের কথিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি। জানা জিনিস জানানো নিশ্চয়ই অনুসন্ধান নয়। যাইহোক, এত বড় মাপের চ্যানেল ও সাংবাদিকদের কাজের সমালোচনা করা আমার মুখে মানায় না। তবুও কিছু বিষয় খটকা লাগলে বলতেই হবে। আমি পুরোটা সময় টান টান উত্তেজনা নিয়ে দেখেছি সিনেমাটি।
এটি প্রকাশ হওয়ার আগেই দেশে বিদেশে বিএনপি ও জামাতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অনেকই জানতো যে, আল জাজিরা এমন একটি জিনিস তৈরি করেছে। তাই তারা ছিল উত্তেজিত। এটি কিভাবে সম্ভব হলো জানি না!
বহু কিছুর মতো সিনেমাটি নিয়ে পরিষ্কার দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে দেশের মানুষ। কারো কারো মতে, এটি কিছুই হয়নি। আবার অনেকের মতে অসাধারণ সত্য তুলে ধরেছে; মুখোশ খুলে দিয়েছে; তাদের ঘরে যেনো ইদের আনন্দ এনে দিয়েছে এই উত্তেজনাপূর্ণ প্রতিবেদন।
আমি এক মাঝামাঝি জায়গায় আছি। কিছুই হয়নি, নতুন কিছু নেই, পুরোটাই মিথ্যা, বানোয়াট, অপপ্রচার এটা আমি বলতে চাই না। তবে পুরোটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এটা নিশ্চিত। দেশে বিদেশে আওয়ামী বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের ইন্ধন ও অর্থের যোগান যে আছে তা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়। নয়তো প্রকাশের দিনই কীভাবে তারা বলে যে, বাংলায় ডাবিং ভার্সনও আসছে! কারণ আল জাজিরা তো তাদের সব সিনেমা বাংলায় ডাবিং করে দেয় না।
শেখ হাসিনার বডিগার্ড ছিল না
এটি যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ভরা একটি থ্রিলার সেটার প্রমাণ পাই আমরা প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জড়ানোর মধ্য দিয়ে। সেনাবাহিনী প্রধানের ভাইদের সঙ্গে শেখ হাসিনাকে যে সুতার বাঁধনে বাঁধা হয়েছে সেটি ভীষণভাবে নড়বড়ে। তবে কিছু বিষয়ে তুলে এনেছে যেটার সঠিক উত্তর জানা প্রয়োজন। তাই এক কথায় সিনেমাটিকে ফু দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আল জাজিরা বলছে, এখনকার চিফ অফ আর্মি স্টাফ জেনারেল আজিজ আহমেদের দুই ভাই এক সময় শেখ হাসিনার বডিগার্ড ছিল। এটি নির্জলা মিথ্যাচার। ওই সময় শেখ হাসিনার কোনো বডিগার্ড ছিল না। মোহাম্মদপুরের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে স্থানীয় নেতা হিসেবে পেছনে দাঁড়িয়েছিল হারিস ও আনিস। এখনো সব দলেই কেন্দ্রীয় নেতারা কোনো অনুষ্ঠানে গেলে সেখানকার স্থানীয় নেতারা পেছনে দাঁড়ায়। ওখানেও তাই হয়েছিল। তারা কেউ কোনোকালে বডিগার্ড ছিল না।
মোহাম্মদপুরের রাজনীতি ও খুন
যে খুনের ঘটনা ঘটেছিল সেটা ছিল এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। আমরা যতটুকু জানি, টিপুকে মারার পর ফ্রিডম পার্টির মোস্তাফিজুর রহমানকে খুন করে ভাই হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিল জোসেফ। অন্য দুই ভাইকেও রাজনৈতিক কারণে আসামী করা হয়। মোস্তাফিজুরের স্ত্রী হারিস ও আনিসের নামে মামলা দেয়নি। পুলিশ তাদের আসামী করে চার্জশিট দেয়।
সেই মামলায় জোসেফ গ্রেফতার হলেও অন্য দুই ভাই ছিল পলাতক। টানা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। তার ভাই সেনাপ্রধান হলো; তাদের নামে রেড এ্যালার্ট ঝুলছে ইন্টারপোলে। শেখ হাসিনা তার নিজের মানুষের জন্য এই সামান্য কাজটুকু করবে না? যেনো তারা মুক্ত মানুষ হয়ে যেতে পারে! আমি তো বলবো, আইনের শাসনের ঘাটতির অনেক উদাহরণ থাকলেও এখানে আইনের শাসন পুরোপুরি কাজ করেছে। তাদেরকে ছাড়া হয়নি। তাই ইন্টারপোলের নোটিশটিও ঝুলে আছে।
ট্রাম্প ১৪৩ জনের সাজা মওকুফ করেছে
সিনেমাটিতে উচ্চ আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া জোসেফ ২০ বছর সাজা খাটার পর রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ক্ষমা করে দেওয়ার বিষয়টিকে বড় করে দেখানো হয়েছে। এটাতো অন্যয় বা অবৈধ কিছু নয়, এটা রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। এটা আইনত বৈধ। তিনি এটা করতে পারেন। বিএনপির রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ ছাত্রদলের ক্যাডার ঝিন্টুর ফাঁসির আদেশ মওকুফ করেছিল। আর মারা যাওয়ার পর তাতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। আমরাতো সেই ঘটনা ভুলিনি।
এইতো কিছুদিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ ছেড়ে যাওয়ার দুই ঘণ্টা আগে ১৪৩ জনকে ক্ষমা ঘোষণা করেন। সবমিলিয়ে ৭৩ জনকে সম্পূর্ণ ক্ষমা করা হয়; ৭০ জনের সাজা কমিয়ে দেওয়া হয়। দুর্নীতি, অস্ত্র, চাঁদাবাজি, ঘুষ নেওয়াসহ নানা অপরাধে ২৮ বছরের কারাদণ্ড প্রাপ্ত আসামীকেও ক্ষমা ঘোষণা করেন ট্রাম্প। তাতে কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়ায় তেমন হইচই শুনি না। দোষ শুধু আমাদের রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনে!
নতুন বোতলে পুরনো মদ
রাষ্ট্রপতির অনুকম্পায় মুক্তি পাওয়ার পর একজন মুক্ত মানুষ যে কারো সঙ্গে দেখা করতে পারেন। তখন আর তিনি আইনের চোখে অপরাধী থাকেন না। পুলিশ প্রধান জোসেফের সঙ্গে দেখা করে আইনত কোনো অন্যয় করেননি। আল জাজিরা এ ব্যাপারটিকে অপরাধ হিসেবে দেখিয়েছে। এই ছবি ও সেনাপ্রধানের টেলিফোন রেকর্ড আল জাজিরা অনুসন্ধান করে বের করেনি। আমরা৷ আগেই দেখেছি এবং শুনেছি। সেনাপ্রধানের এক ব্যাচম্যাট সাবেক কর্নেলের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, সেটা ওই সাবেক কর্নেল নিজে রের্কড করে ছেড়ে দিয়েছেন। এমন অনেক কিছু, যেমন গ্রাফিকসের করে বানানো টিপু ও মোস্তাফিজুর রহমানের হত্যার বিষয়টি পুলিশ ও মামলার বিবরণে এমনকি পত্রিকাতেও আছে। শব্দ আর গ্রাফিকসের জৌলসে উপভোগ্য এক ড্রামা হয়েছে। অন্য অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত ও ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত বিষয় আবার দেখানো হয়েছে। সে জন্য আল জাজিরার ধুন্ধুমার সিনেমাটিকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বলতে দ্বিধা করছি।
রোহিঙ্গারাও পাসপোর্ট বানাতে পারে; সেনাপ্রধানের ভাই হওয়ার দরকার কী
মিস্টার হারিস ওরফে মোহাম্মদ হাসানের পাসপোর্টের নাম পরিবর্তন করা নিয়ে সেনাপ্রধানকে জড়ানো হয়েছে। তিনি নিজের অফিসের অধীনস্থ সহকর্মীদের ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ দেগেছে আল জাজিরা। সেখানে জন্ম-সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টে একটাই নাম দেখানো হয়েছে, সেটা হলো মোহাম্মদ হাসান। হারিস নামে কোনো ডকুমেন্ট দেখায়নি। হারিস নামটি এলো পুলিশের কাগজে, তাইতো? ইন্টারপুলের নোটিশে। আমি যদি বলি তার ডাক নাম হারিস ছিল, কিন্তু সার্টিফিকেটের নাম মোহাম্মদ হাসান। যে নামে সব ডকুমেন্ট আছে। বিএনপি জামায়াত সরকারের পুলিশ ভুল করেছিল, সার্টিফিকেটের আসল নাম খুঁজে পায়নি। আমাদের বহু সাংবাদিক আছেন যাদের সার্টিফিকেটে একটি নাম আর নিজেদের টিভিতে পরিচয় দেন আরেক নামে। আবার অনেক মানুষ আছেন যাদের পরিবারের মানুষ এক নামে চেনে আর সারা দুনিয়ার মানুষ আরেক নামে চেনে। হারিস বা মোহাম্মদ হাসানের ক্ষেত্রে তো এটিও হতে পারে?
আপনাদের কথাই ধরে নিলাম ইন্টারপোলকে ফাঁকি দিতে নাম পরিবর্তন করেছে। যে দেশে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দিতে নির্বাচন কমিশনের কর্মচারীরা কমিশনের ল্যাপটপ চুরি করে, জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারের দখল নিয়ে নেয়, সেই দেশে পাসপোর্ট পেতে সেনাপ্রধানের ভাই হওয়ার দরকার নাই। কাজটি রোহিঙ্গা হলেও করা যায়। অবশ্যই কাজটি বেআইনি। কিন্তু এটি করার জন্য সেনাপ্রধানের ভাই হওয়া জরুরি নয়। তাই এখানে চার তারকার জেনারেলকে জড়ানো যৌক্তিক নয়।
সামি ও সাইকোপ্যাথ হারিস বা হাসান
এবার আসি সামির কথায়। যিনি হারিস বা মোহাম্মদ হাসানকে সাইকোপ্যাথ বলে বর্ণনা করেছেন, তার মিলিটারি একাডেমির বন্ধুরা; একাডেমি থেকে অসততা ও মাদক নেওয়ার দায়ে বের করে দেওয়া হয় সামিকে। এ নিয়ে বেশি কিছু লেখার কিছু নেই। তবে সামির মাধ্যমে একটা শিক্ষা সবাই নিতে পারেন, সেটা হলো, শত্রু অতো ক্ষতি করতে পারে না, যতটা পারে আপনি যাকে বিশ্বাস করেন, বন্ধু মনে করেন সে।
এবার আসি সাইকোপ্যাথ বা মানসিক অস্থিরতা ব্যাধিতে আক্রান্ত মোহাম্মদ হাসানের কথায়। যার কথার উপর ভিত্তি করে পুরো সিনেমাটিকে শক্তিশালী ভিত্তি দিয়েছে আল জাজিরা। যাকে বলতে শোনা যায়, মন্ত্রীরা তার কথায় নাচে, পুলিশ, র্যাব, সব তার হাতে, পুলিশ র্যাব-ই গুণ্ডা, গুণ্ডা পালার দরকার কী; পোস্টিং পদোন্নতি সব তিনি করিয়ে দিতে পারেন টাকার বিনিময়ে।
বাংলাদেশে কী এমন পাগলের কোনো অভাব পড়বে বা প্রতারকের অভাব আছে, যারা টাকার বিনিময়ে আপনাকে সব কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেবে না? যদি একটা কাজও করতে পারতো, বা তার কথায় হয়ে গেছে প্রমাণ হতো তাহলে আমরা বুঝে নিতাম, হ্যাঁ তিনিই দেশ চালাচ্ছেন।
টেলিফোনে ডিজিএফআই কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন বলে দাবি করলেন হাসান। আমরা জানি না টেলিফোনের অপর প্রান্তে কে ছিল? আদৌ ফোন করেছিলেন কি-না? তবুও বলতে শুনি হাঙ্গেরিতে কাজ থাকলে বলবেন? এর মানে কী? যিনি দেশ চালাবেন তিনি তো সরাসরি সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বলবেন। ডিজিএফআই কর্মকর্তা কেন? তারপর কাজ চাইবেন? কী আশ্চর্য!
একটা চিঠি দেখি হাসানের বে অফ বেঙ্গল নামের প্রতিষ্ঠান বিজিবির জন্য দ্বিতল খাট কেনার কাজটি চায়। মোহাম্মদ হাসানের প্রতিষ্ঠান কাজটি পেয়েছে সেই প্রমাণ দেখি না সিনেমাতে। তাতে কি প্রমাণ হলো সব কাজ হাসানের প্রতিষ্ঠান বাগিয়ে নিচ্ছে? পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বুলেট হাঙ্গেরির। সেটা কেনার কাজ পেতে চায় হাসান। কিন্তু সরাসরি নিজে সামনে না গিয়ে সামিকে সামনে যেতে বলে। এই হলো বিদেশ থেকে কাজ পাওয়ার ও পাইয়ে দেওয়ার নমুনা! বুলেট কেনার কাজটি যে পেলো সেই প্রমাণ কোথায়? তবুও এটাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মর্যাদা পাচ্ছে কারো কারো কাছে। সামি যেহেতু পেছনে লেগে থেকে সব রের্কড করেছে; তাই অস্থিরতায় ভোগা মোহাম্মদ হাসানকে উস্কে দিয়ে এসব কথা বলিয়ে নিয়েছে। কেউ কেউ বিষয়টি এভাবে দেখবে না?
হোটেল কেনা এবং বিনিয়োগে ২০ শতাংশ দিতে হবে
হোটেল কিনতে যাওয়া এবং আরেকটি হোটেল বাংলাদেশে করবে একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। এই দুইটাই আল জাজিরার ইশারায় সামির পাতা ফাঁদ। চলেন ভাই একটা হোটেল বিক্রি হবে, দেখে আসি, এই বলে সামি নিয়ে গিয়েছিল। কারণ সামি দেখাতে চায় হারিস বা হাসানের কাছে অনেক টাকা আছে। হাঙ্গেরিতে হোটেল পর্যন্ত কিনতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হোটেলটি কিনতে দেখি না। মানে হলো পুরোটাই বিকারগ্রস্ত মানুষের কল্পনা বিলাস।
হোটেলের বিনিয়োগে ২০ শতাংশ দিতে হবে, তাহলে সব কাজ হয়ে যাবে। সামিই লন্ডনে আল জাজিরার সাংবাদিকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈঠকে বসিয়ে দিয়েছে হারিসকে। আর দুই প্রান্ত থেকে কথাবার্তা রেকর্ড করেছে। মানসিক ভারসাম্যহীন হাসান নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণের জন্য যা খুশি তাই বলে দিয়েছে। সেরা অনুসন্ধানী রিপোর্টের দুর্নীতির প্রমাণ হলো এই পাগলের কথাবার্তা। যিনি নিজেই বলে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছে, ‘হাসান যা করতে চায় করুক’। তার এই কথা হলো প্রমাণ সে প্রধানমন্ত্রীর লোক। যদি প্রধানমন্ত্রীর লোকই হতো তাহলে রেড এলার্ট জারি থাকত?
আমরা মেনে নিতাম যদি হাসানের কথা মতো যুক্তরাজ্যে দূতাবাসের কর্মকর্তারাও তাদের সঙ্গে বিনিয়োগ নিয়ে কথা বলছে প্রমাণ পেতাম। দেশে একটি হোটেল নির্মাণের বিনিয়োগ প্রস্তাব এসে গেছে দেখতাম। যে বিনিয়োগটির জায়গা নির্ধারণের জন্য স্বয়ং সেনাপ্রধান দৌড়ঝাঁপ করছেন। তখন বুঝতাম ডাল মে ক্যুছ কালা হে। এক ব্যক্তি; যিনি দেশ থেকে পলাতক; ইন্টারপোলের নোটিশ ঝুলছে যার উপর, যাকে সাইকোপ্যাথ বলে পরিচয় করিয়ে দিলো পার্টনার সামি, তার কথা অনুযায়ী কোনো কাজ হচ্ছে, এমন কোনো কোনো প্রমাণ দিলো না আল জাজিরা। তারপরও বুদাপেস্ট থেকে দেশ চালাচ্ছে মাফিয়া হারিস বা হাসান। এটাই আমাদের মেনে নিতে হবে!
এত কাগজ গ্রাফিকস করে দেখাতে পারল, সেনাপ্রধানের ইমেইলের হুমকির স্ক্রিনশট দেখাল না কোন? এতে কি প্রমাণ হয় না যে তাদের দাবি মিথ্যা।
গোয়েন্দা নজরদারি যন্ত্রাংশ ও ধর্মীয় দাঙ্গার উস্কানি
হেফাজত আন্দোলনে মৃতদের লাশ দাফনের প্রমাণ হিসেবে বাক-প্রতিবন্ধীর বক্তব্য প্রচার করে আল জাজিরা। যেখানে রানা প্লাজায় মৃত নারী গার্মেন্টস কর্মীদের দাফন করা হয়েছিল ডিএনএ পরীক্ষার পর। সেটাকে পুরুষ হেফাজত কর্মীদের কবর বলে চালিয়ে দেয় বোবা কিশোরের বক্তব্য দিয়ে। যার মা বলে তাদের বোবা সন্তান সব কিছুতে সায় দেয়! যে যা বলে। এই হলো উদ্দেশ্যমূলক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নমুনা!
ইন্টারনেটে নজরদারি বাড়াতে অতিক্ষমতাধর যন্ত্রাংশ কেনা হয়েছে এই ঘোষণা সরকারই দিয়েছিল। মানে হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার বা অন্য যোগাযোগ মাধ্যমে কী ম্যাসেজ আদান প্রদান হয় সেটিও পড়তে পারবে গোয়েন্দারা। কাগজে কলমে আল জাজিরা দেখাল হাঙ্গেরির তৈরি। ধরেই নিলাম ইসরাইলের যন্ত্র। ইহুদীদের বানানে ফেসবুক বন্ধ করে দিলে সরকার পতনের ডাক চলে আসবে। ইসরাইল তথা ইহুদীদের তথ্য ও প্রযুক্তি পণ্য ছাড়া দেশ এবং দুনিয়া অচল। এটা বালির ভেতর মাথা গুঁজে থাকা মানুষেরা না জানলেও আমরা জানি।
এই নজরদারি যন্ত্রাংশ না আনলে এত দিন আরও কত হলি আর্টিজান হতো কে জানে! অবশ্যই দেশের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন মনে করলে ইসরাইল থেকে পণ্য কিনবে সরকার। আর এ জাতীয় পণ্য কোথা থেকে আনা হয় সেই ঘোষণা দেওয়া হয় না। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উস্কানি দিতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বললো, এখন ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে হইহুদীদের যন্ত্র দিয়ে পরবর্তী সরকার বিরোধী আন্দোলন ঠেকানো হবে। ধর্মীয় উস্কানি নয়! আমি মনে করি এই উস্কানি দিতেই পুরো নাটকটি বানানো হয়েছে।
ইহুদী বার্গম্যান ও তাসনিম খলিল
মুসলমানের দেশে ইহুদী পণ্যে নিয়ে হা হুতাশ করলেও আল জাজিরা বিশেষজ্ঞ মতামতের জন্য ভরসা রেখেছে একজন ইহুদীর উপর। তিনি ডেভিড বার্গম্যান। নিউএজ অফিসে একটি কাজে গিয়ে দূর থেকে দেখেছিলাম তাকে। যিনি বাংলাদেশের বিখ্যাত আইনজীবী ডক্টর কামাল হোসেনের মেয়ে সারা হোসেনের স্বামী।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে তিনি বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে নেমে পড়েন। সরকার মনে করে, কোটি কোটি টাকা খরচ করে স্বাধীনতা বিরোধীরা যে লবিস্ট নিয়োগ করেছিল, বার্গম্যান তাদের একজন। মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃত শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক তোলায় তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত সাজাও দিয়েছিল।
আরেকজন তাসনিম খলিল। ডেইলি স্টার পত্রিকার সাবেক সাংবাদিক। যিনি মানবাধিকার, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার, জঙ্গিবাদ এবং বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখালিখি করতেন। তার ব্লগ ও ডেইলি স্টারে লেখা খবরে তিনি জানিয়েছিলেন, বগুড়ার রাজপুত্র তারেক রহমানের নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে ইসলামী জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে বাংলাদেশে। তার লেখা তখন আওয়ামী লীগকে সুবিধা দিয়েছিল। পশ্চিমা কূটনৈতিকদের বিশ্বাস যোগাতে সহায়তা করেছিল তার খবর। ২০০৭ সালে সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমরা যারা মাঠে ছিলাম সাংবাদিক হিসেবে; নিউজ কভার করতে বাইরে গিয়ে হকি স্টিক, ধাওয়া এবং গালিগালাজ খেয়েছি তারা জানি; তাসনিম খলিল ৪৮ ঘণ্টা কী ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। ডেইলি স্টারের ফোরাম ম্যাগাজিনে একটি লেখায় ব্যাপক আপত্তি ছিল তখনকার সরকার পরিচালনায় থাকা নেপথ্য কারিগরদের।
ডেইলি স্টার আর বিদেশীদের তৎপরতায় সপরিবারে সুইডেনে আশ্রয় পেয়েছিলেন তিনি। তাই সেনাবাহিনী নিয়ে তাসনিম খলিলের ব্যক্তিগত ক্ষোভ রয়েছে। বিদেশ থেকে তিনি দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সম্মান নষ্টের চেষ্টা করছেন, এটাই স্বাভাবিক বলে অনেকে মনে করে। তাই চিহ্নিত সরকার তথা দেশ বিরোধীদের বক্তব্য দিয়ে তথাকথিত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার দুর্বলতা বলে মনে করা হচ্ছে। এসব খবর প্রচার করে এখন বিএনপি মাইলেজ পেলেও এক সময় এই তাসনিম খলিলই প্রকাশ করবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের তারেক রহমানের লন্ডনে রাজকীয় জীবন-যাপনের পেছনের গল্প।
নমিনেশন বিক্রির কত টাকা কীভাবে লন্ডনে গেল? বাংলাদেশ এবং ইউরোপের কর্মীরা চাঁদা তুলে কত টাকা পাঠাল কিংবা ওহাবিজমের নামে জঙ্গিবাদ লালনের জন্য আইএসআই কত টাকা প্রতি মাসে পাঠায় সেই তথ্যেও জানাবে। ১০ ট্রাক অস্ত্র, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এবং ইসলামী জঙ্গিবাদের মদদদাতা তারেক রহমানের বিষয়ে ২০০৬-০৭ সালের মতো আবারও লিখবেন তাসনিম খলিল।
টার্গেটে শেখ হাসিনা এবং সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ কেন
রাজনীতি শুরুর পর থেকেই স্বাধীনতাবিরোধী এবং মৌলবাদীদের টার্গেটে শেখ হাসিনা। হয়ত অকালে মরে যাওয়া ভাইদের কিছু আয়ু তাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। ২১ বার তাকে হত্যা চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আল জাজিরার সিনেমাতে যে সব তথ্যে তাকে সব অনিয়মের সঙ্গে জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে তা মোটেও শক্তপোক্ত কিছু নয়। বালির বাঁধ দিয়ে নিশানা করা হয়েছে।
২০১৪ আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব, সাংবিধানিকভাবে যেটি তার উপর বর্তায়, তা পালন করেছিলেন সেনাপ্রধান। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল। তখন র্যাব-এর প্রধানের দায়িত্বে থাকা এখনকার আইজিপি বেনজির আহমেদকেও একই কারণে টার্গেটে আনা হয়েছে।
আর একজন দেশত্যাগী সাবেক কর্নেল; যিনি ব্যবসার লেনদেনে সরকারে গুরুত্বপূর্ণ একজনের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়েছেন এবং একজন সাবেক জেনারেল যিনি সেনাপ্রধান না হতে পারার কষ্টে সরকারের বিরুদ্ধে ঘোষণা দিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের হাত এই ডকুড্রামা নির্মাণে ছিল বলে ধারণা করা যায়। আর সরকারের বিরুদ্ধে যায় এমন সব কিছুতে বিএনপি জামাত এগিয়ে যাবে এবং এখানেও তারা আছে, ওই পন্থী সাংবাদিকদের ইদের খুশি এবং ফেসবুক প্রচারণা দেখলেই বুঝা যায়।
সবই কি ভুয়া
এই প্রশ্নের জবাবে আমি বলব না, কিছু বিষয় নিশ্চয়ই অনুসন্ধানের দাবি রাখে। একটি হলো ওয়ান্টেড আসামী কিভাবে দেশে পাসপোর্ট করতে পারলো? কত ভাবে সম্ভব সেটা ওপরের অংশে লেখা আছে। তবুও যেহেতু সামনে এসেছে বিষয়টি তাই তদন্ত হতে পারে। পাসপোর্ট বাতিল করা যেতে পারে।
বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত দেখানো হয়েছে হারিস এবং আনিসকে। বিয়ের ভিডিওতে এমন সেনসেশন করে উপস্থাপন করা হয়েছে যে গোপন কিছু হয়ে গেছে। হোটেল লা মেরিডিয়ান বা রেডিসন ব্লুতে হলেও বুঝতাম বিরাট কিছু। কিন্তু সেনাকুঞ্জে অনেক সাধারণ মানুষের বিয়ের অনুষ্ঠানও হয়। বিহারীদের বিয়েতে যে পরিমাণ নাচা-গানা আর আতশবাজি ফুটানো হয় সে তুলনায় গরিবি হালেই বিয়ে হয়েছে সেনাপ্রধানের ছেলের। কিন্তু সিনেমাতে দেখাল কি জানি কি!
নাচ-গানের ভিডিও ফুটেজ থাকলেও হারিস এবং আনিসের স্টিল ছবি দেখানো হয়েছে। নানা সময়ে মিথ্যা ও ভুয়া স্বার্থে খবর প্রচার করা আল জাজিরা এখানে এডিট করে তাদের মাথা বসিয়ে দিয়েছে কিনা সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ ফুটেজ দেখে বুঝাই যাচ্ছে রাষ্ট্রপতি আর তার ভাইরা একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলে না। তবুও রেড এ্যার্লাট জারি থাকা ব্যক্তিরা কীভাবে দেশে এলো এটাও তদন্ত হতে পারে। যদিও মোহাম্মদ হাসান বা হারিসের পাসপোর্টের ছবি দেখালেও তিনি দেশে এসেছিলেন সেই সিল ছাপ্পড় কিন্তু দেখায়নি আল জাজিরা। দেশে এসে বিয়েতে যোগ দেওয়ার দাবিটি ভুয়া এবং এডিট করা ছবি বসিয়েছে বলেই মনে হয়। তবুও বিষয়টি তদন্ত করে দেখা উচিত।
এত প্রতিক্রিয়ার প্রয়োজন ছিল না
আল জাজারিরা ১ ঘণ্টার সিনেমাটি প্রচারের পর যে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে আমি মনে করি এর কোনো দরকার ছিল না। চার জন মন্ত্রী কথা বলেছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সেনা সদর থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। পরের দিন পাবনাসহ বিভিন্ন জায়গায় মিছিল হয়েছে, ঢাকায় বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে। এতটা মনে হয় ডিজার্ভ করে না এই নাটক। কোনো একটি জায়গা থেকে প্রতিটি পয়েন্ট ধরে জবাব দিলেই ভালো হতো। বহু দেশেই আল জাজিরা নিষিদ্ধ। বাংলাদেশে সেটা করা হয়নি সেটাকেই আমি সাধুবাদ জানাই।
লেখক: সাংবাদিক, একাত্তর টেলিভিশন