আল জাজিরার তথ্য সন্ত্রাস ও কিছু জানা অজানা কথা
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:০৫
২ ফেব্রুয়ারি কাতারভিত্তিক সংবাদসংস্থা আল জাজিরা প্রকাশিত “অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টার’স ম্যান” শীর্ষক প্রতিবেদন নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এক ঘণ্টার এই প্রতিবেদনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে মিথ্যা প্রোগাপান্ডা ছড়ানো হয়েছে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয় আওয়ামী সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও তার সহোদরেরা এবং পুলিশের বর্তমান আইজিপি বেনজির আহমেদ মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং তারা নানা রকম আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত— যা অসত্য , বিভ্রান্তিকর এবং মানহানিকর ছাড়া কিছু নয় ।
প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন নানান সময়ে সমালোচিত, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত করতে অপপ্রচারকারী ,আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালকে অবমাননার দায়ে সাজা খাটা ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, ‘নেত্র নিউজ’ নামক ভুঁইফোড় অনলাইন পোর্টালের কর্ণধার সুইডেন প্রবাসী তাসনিম খলিল এবং হাঙ্গেরি প্রবাসী সেনাবাহিনী থেকে বিতাড়িত ক্যাডেট জুলকারনাইন শের খান। প্রতিবেদনটি সাজানো হয়েছে জেনারেল আজিজের ভাই হারিস আহমেদের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে। হারিস আহমেদ একজন পলাতক আসামী, বর্তমানে হাঙ্গেরিতে বসবাস করছেন তিনি। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, হারিস আহমেদ নব্বইয়ের দশক থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করতেন। প্রতিবেদনটির দাবি, এসবের সূত্র ধরেই তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে সুবিধা পাচ্ছেন। তিনি ১৯৯৬ সালের একটি হত্যা মামলার ফেরারি আসামী হিসেবে বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। হারিস আহমেদ ও তার অপর তিন ভাই আনিস, টিপু ও জোসেফ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনিদের গড়া রাজনৈতিক দল ফ্রিডম পার্টি নেতা মোস্তফা হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত। মোস্তফা হত্যার কথা বললেও, এই মোস্তফা ১৯৮৮ সালে শেখ হাসিনাকে হত্যা প্রচেষ্টায় ধানমণ্ডি ৩২-এর বাসভবনে গ্রেনেড ও গুলি ছুড়ে মারার অন্যতম আসামী তা প্রতিবেদনে একবারও বলা হয়নি। ১৯৯৮ সালে হারিস আহমেদের আরেক ভাই টিপুকে হত্যার কথাও এড়িয়ে যায়। প্রতিবেদনের শুরুতেই হারিস আহমেদকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ মানসিক ভারসাম্যহীন একজনের কথার ভিত্তিতেই প্রতিবেদন দেখানো হয়, যেখানে কোনো কিছুরই তথ্য প্রমাণ হাজির করতে পারেনি আল জাজিরা।
হারিস আহমেদের দাবি করা মন্ত্রীরা তার কথায় নাচেন, র্যাব পুলিশ তার কথায় গুণ্ডামি করেন, তিনি অর্থের বিনিময়ে পুলিশের বদলি বাণিজ্য করেন যার ভাগ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি সবাই পান। যার কোনো কিছুরই প্রমাণ, নথিপত্র দেখাতে পারেনি আল জাজিরা। আল জাজিরা দাবি করে, হারিস আহমেদ নাম পরিবর্তন করে হাঙ্গেরিতে গিয়েছেন এবং তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছেন জেনারেল আজিজ। আরও দাবি করে হাঙ্গেরিতে হারিস আহমেদ ‘বে অব বেঙ্গল’ নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন কালো টাকা সাদা করতে। অথচ কীভাবে অর্থ লগ্নী করেছেন তারও কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি। আরও দাবি করা হয়, হাঙ্গেরির ভুয়া পাসপোর্টে তিনি ফ্রান্সে রেস্তোরা ব্যবসা শুরু করেছেন। কিন্তু তারও যথোপযুক্ত প্রমাণ হাজির করতে পারেনি এবং ফ্রান্স কিংবা হাঙ্গেরির কোনো অফিসিয়াল নথিপত্র দেখাতে পারেনি।
হারিসের বক্তব্য অনুযায়ী হাঙ্গেরি থেকে সেনাবাহিনীর জন্য গুলি কিনতে তিনি মিডলম্যান হিসেবে কাজ করেন। এমনকি এই প্রতিবেদনে দাবি করা হয় , বাংলাদেশের জনগণের ওপর ডিজিটাল মাধ্যমে নজরদারি করতে আইরিশ এক লোকের মধ্যস্থতায় ইসরাইলের তৈরি স্পাইওয়্যার কিনেছেন হাঙ্গেরি থেকে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দাবি করে, “জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সেনাবাহিনীর একটি কন্টিজেনের জন্য হাঙ্গেরি থেকে সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়েছিল।” আল জাজিরার প্রতিবেদনে আরও দেখানো হয় রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে সেনাপ্রধানের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে ফেরারি আসামী হারিস আহমেদ ও তার আরেক ভাই আনিস আহমেদের একই ফ্রেমের ছবি। বিয়ের ভিডিও দেখালেও সেখানে আনিস ও হারিস কাউকে দেখা যায়নি। যা ডকুমেন্টারিটির স্বেচ্ছাচারিতা ও মিথ্যাচারের সন্দেহ উদ্রেক করে। আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতির ও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে ফ্রিডম মোস্তফার আরেক ভাই ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পাগলা মিজানকে গ্রেফতার করেছে নাকি হারিস আহমেদের কথায় সে কথাও বলা হয় প্রতিবেদনটিতে।
প্রতিবেদনটির কথক সামির ভাষ্যমতে, মি. আজিজ আহমেদ তার সঙ্গে তার ভাই হারিস আহমেদের পরিচয় করিয়ে দেন এবং তার ভাইকে হাঙ্গেরিতে ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলেন। তিনি দাবি করেন, যখন তিনি জানতে পারেন হারিস আহমেদ পলাতক আসামী তখন তিনি হারিস আহমেদকে সহযোগিতা না করতে চাইলে সেনাপ্রধান তাকে হুমকি দেন। তদসংশ্লিষ্ট কয়েকটা মেইলের উদ্ধৃতি দিলেও তিনি মেইলের কোন ছবি, স্ক্রিনশট দেখাতে পারেননি।
আল জাজিরার ধারাবাহিক তথ্য সন্ত্রাস, ধর্মীয় মৌলবাদ ও গণতন্ত্রের বিপক্ষে উস্কানির ধারাবাহিক ঘটনার একটি অংশ এই প্রতিবেদন। অতীতে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ট্রাইব্যুনাল, ২০১৩ সালে হেফাজতের শাপলা চত্বর ঘেরাও নিয়ে অনেক মিথ্যাচার করেছে আল জাজিরা, যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে। প্রসঙ্গত, প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ও বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা বললেও তারা মুক্তিযুদ্ধে আলবদর, জামাত ইসলামীর সংশ্লিষ্টতা এবং বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যায় দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা সতর্কভাবে এড়িয়ে যায়।
আল জাজিরার তথ্য সন্ত্রাস এবং উগ্রপন্থীদের উত্থানে সাহায্য করার প্রমাণ পেয়ে আরবের পাঁচটা দেশে তাদের সম্প্রচার নিষিদ্ধ করেছে। আমাদের দেশেও এহেন দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী, গণতন্ত্র ও উন্নয়নে বাধাদানকারী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাতকারী আল জাজিরাকে নিষিদ্ধের সময় এসেছে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়