Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আত্মহত্যার অনুমতি ও এক বৃদ্ধের অসহায়ত্ব!


১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৭:৫০

খবরটি মর্মান্তিক। সবগুলো বুকের পাঁজর মড়মড় করে ওঠার মতো সংবাদ। হ্যাঁ, সত্যি বলছি। ৭০ বছরের বৃদ্ধ তিনি। রাষ্ট্রের সিনিয়র সিটিজেন। অসহায় এই বয়সে সন্তানসহ পরিবারের লোকজনই তার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হওয়ার কথা। এই বাবাও তো একদিন সবাইকে নিরাপদে আগলে রেখে বড় করেছেন। চেষ্টা করেছেন কোনো রকম কষ্ট যেন কাউকে স্পর্শ না করে। সবার অজান্তে সংসারের চাকা সচল রাখতে অনেক যন্ত্রণা আর অপমানের ঘটনা হয়ত নিজের মধ্যেই এখনও চেপে রেখেছেন।

বিজ্ঞাপন

সবকিছু ছাপিয়ে বয়স মানুষকে অসহায় করে তুলে। আশ্রয়ে বাঁচতে হয়। কিন্তু আশ্রয়ের সময় তার প্রতি সন্তান বা কাছের মানুষ যখন অবিচার করে, সামান্য সম্পদের জন্য তিনি যদি নির্মমতার শিকার হন, তবে সেটি কেমন? এরচেয়ে কষ্ট বা যন্ত্রণা হয়ত আর কিছু হতে পারে না। যা পৃথিবীর সব মানবিক হৃদয়ে আঁচড় দিয়ে যাওয়ার কথা।

বলছি মেহেরপুরের বৃদ্ধ মুসা করিমের কথা। সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের কাছে ৭০ বছর বয়সে লাঞ্ছনার শিকার হয়ে তিনি হাতে বিষের বোতল নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিকার চাইতে গিয়েছিলেন। অথচ এমন হওয়ার তো কথা ছিল না। শীতের সময়ে এই বাবাটি তো গরম কাপড়ে আবদ্ধ ঘরে সযত্নে মোড়ানো থাকার কথা। কোনো কারণে তিনি বাইরে যেতে চাইলে সবাই বাধা হয়ে দাঁড়ানোর কথা। সবার আদর আর ভালোবাসার মধ্যে থাকার কথা। কিন্তু এমন কী ঘটল? নিজ হাতে বিষের বোতল নিয়ে প্রশাসনের কাছে যেতে হয়েছে তার।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ‘আমি জহর খাই-ই মরবো। খুব কষ্ট কইরি ঘর কইরিলাম। ৭০ বছর ধইরি সেখানে বাস কইরিচি। এখন আমার সেই ঘরে থেকে বের করে দিছে। আমার জমি আমারে ফিরিয়ে দেন, নয়তো আমাকে বিষ পানের অনুমতি দেন। জেলা প্রশাসকের অফিসে গিয়ে এভাবেই মিনতি জানান বৃদ্ধ মুসা করিম।

এ সময় তিনি বিষপানের অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে একটি লিখিত আবেদনও করেছেন। তবে জেলা প্রশাসক ড. মুনসুর আলম খান দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিয়ে আত্মহত্যার পথে না গিয়ে যতদিন বেঁচে থাকবেন স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করার আহ্বান জানান। মঙ্গলবার (৯ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টার দিকে মুসা করিম তার নাতি আকাশকে (৮) সঙ্গে নিয়ে মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে গিয়ে এ আবেদন জানান। বৃদ্ধ মুসা করিমের বাড়ি মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার মহাজনপুর ইউনিয়নের কোমরপুর গ্রামে।

বিজ্ঞাপন

খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে জড়ো হয় স্থানীয় সাংবাদিকরা। ঘটনার বিবরণে মুসা করিম বলেন, ‘আমার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলে লাল চাঁদের দুই স্ত্রী। তার প্রথম স্ত্রী শরীফা খাতুনের ছেলে আকাশ। শরীফাকে ভরণপোষণ না দেওয়ায় সে তার মা-বাবার বাড়িতে থাকে। লাল চাঁদের দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে এখন সংসার করছে’। তিনি বলেন, ‘আমার যে জমি জায়গা ছিল সেগুলো সবার নামে সমবণ্টন করে দিয়েছি। অবশিষ্ট ৪ কাঠা জমির ওপর বাড়ির জায়গাটি আমার অসহায় নাতি আকাশের নামে লিখে দিয়েছি। বিষয়টি জানতে পেরে আমার বড় ছেলে লাল চাঁদের দ্বিতীয় স্ত্রী আসমা খাতুন আমাকে ও আমার নাতি আকাশকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। পরে আমি আমার ছোট ছেলে আমির হোসেনের বাড়িতে বর্তমানে রয়েছি। কিন্তু সেখানেও তাদের সমস্যা’।

ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে অসহায় এই বৃদ্ধ আরও বলেন, ‘অনেক জায়গায় ঘুরেছি কিন্তু কেউ আমাকে বাড়িতে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেনি, যে কারণে বাধ্য হয়ে বিষের বোতল হাতে করে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন জানাতে এসেছি’।

স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন মানব উন্নয়ন কেন্দ্রের (মউক) নির্বাহী পরিচালক আসাদুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়ভাবে অনেকবার মীমাংসার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তার অপর নাতি (লাল চাঁদের ছেলে) রিপন হোসেন ও ফারুক হোসেন তাদের দাদা মুসা করিম সৎ ভাই আকাশকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। একপর্যায়ে বৃদ্ধ মুসাকে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করার পরামর্শ দিয়েছি’।

ঘটনার প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক ড. মুনসুর আলম খান বলেছেন, ‘জমি ও ঘর উনার (মুসার) নিজের। উনি যাকে ইচ্ছে দিতে পারেন। তাতে অন্যের কী বলার আছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেখা হবে’। শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ মুসা করিম জেলা প্রশাসকের আশ্বাস পেয়ে বাড়িতে ফিরে যান।

কথা হলো পিতা-মাতার সেবা করা সন্তানের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু সমাজের নানা রকম নির্মম বাস্তবতা আমরা দেখছি। বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মা নানা রকম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সন্তানের হাতে বাবার নির্যাতনের খবর এ নতুন কিছু নয়, যা গণমাধ্যমে নিয়মিতই আসছে। এই পরিস্থিতিতে অনেক অসহায় পিতা মাতার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে বৃদ্ধাশ্রম। এমন অনেক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর সংসদে পাস হয় পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, যা পরবর্তী সময়ে বাধ্যতামূলক করা হয়।

ষাটোর্ধদের সিনিয়র সিটিজেন বলা হয়। ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর বিশ্ব প্রবীণ দিবসে দেশের ১ কোটি ৩০ লাখ প্রবীণ নাগরিককে সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। আইনের ২ ধারা অনুযায়ী, জন্মদাতা পিতা ও মাতা এই আইনের আওতাভুক্ত হবেন। পিতা মাতা ভরণপোষণের বিষয়ে ওই আইনের ৩ ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণের বিষয় সন্তান নিশ্চিত করবে এবং একাধিক সন্তান থাকলে আলাপ-আলোচনা করে নিশ্চিত করবে’।

আইন অমান্যে রয়েছে শাস্তি। কেউ যদি এই আইন অমান্য করে, তবে তাকে এক লাখ টাকার অর্থদণ্ড, অনাদায়ে তিন মাসের জেলের বিধান করা হয়েছে। তবে অসহায় বয়স্করা এই পরিস্থিতির শিকার হলেও প্রতিকারে তেমন কোনো ব্যবস্থা মনে রাখার মতো নজির নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো—নির্যাতিত অসহায় মানুষের পাশে আপনজন ছাড়া কে থাকবে? আর আপনজনই যদি শত্রু হয় তবে তার পরিণতি এমন হওয়ায় স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। যখন আমরা একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীতে নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছি তখন সমাজের এমন সব রকমের অমানবিক কাজ যে কোন মূল্যে ঠেকাতে হবেই। কঠোরভাবে কার্যকর করতে হবে আইন। দৃষ্টান্তই প্রতিরোধের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে। পরিবারের সদস্যদের নির্যাতনের মুখে আর কোনো বৃদ্ধ বাবা-মাকে যেন বিষের বোতল নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আশ্রয় নিতে না হয়। আমরা একটি মানবিক রাষ্ট্র ও মানবিক সমাজ বিনির্মাণের পথে আরও দ্রুত এগিয়ে যেতে চাই। যে সমাজে বৃদ্ধ বয়সে কোনো পিতা মাতাকে বিচারের জন্য, ভাতের জন্য, অধিকারের জন্য রাস্তায় রাস্তায় ছুটতে হবে না। এজন্য আমাদের প্রজন্মকে আরও সচেতন করে গড়ে তোলার দায়িত্ব সকলের।

লেখক: সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর