বাংলাদেশের ক্রিকেটের টেস্ট দুর্বলতা
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৮:৫৮
সময়টা বাংলাদেশের হতে পারতো। করোনা মহামারিতে বন্ধ হওয়ার পর নতুন করে শুরু হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ আরও ভালো করতে পারতো। টার্গেটও বেশি ছিল না। ক্যারাবীয়দের দেওয়া ২৩১ রানের টার্গেট নিজেদের মাটিতে। জয় আশা করতেই পারি। বাংলাদেশ টিমও জয় করেছিল। কিন্তু আশা করার সাথে সাথে কাজটা ঠিক মতো করতে পারেনি তারা। ফলে পরাজয় নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয়েছে। আশা করেছিলাম টেস্টে খেলাগুলো অন্তত প্রতিদ্বদ্বিতাপূর্ণ হবে। কিন্তু হয়নি। দলীয় পাফরম্যান্স বলতে যা বোঝায় তা দেখতে পাইনি। অথচ খেলাটাই দলীয়। কোনো কোনো দিন হয়তো কোনো একজনের জন্য দলের সাফল্য আসে কিন্তু সে আশা সবক্ষেত্রে করাটা বোকামি। অন্তত সর্বাধিক খেলোয়াড়ের একত্র শক্তি দিয়ে ম্যাচ বের করতে হয়।
টেস্ট ক্রিকেটটা ধৈর্য্যের। সেই ধৈর্য্যের পরিচয় পাইনি। ওয়ানডে স্টাইলে খেলে টেস্টে যে খুব বেশি কাজ হয় না তার প্রমাণ পেয়েছি। ক্রিকেটের মূল খেলা হলো টেস্ট খেলা। নিজেদের মাঠে আমরা আরো ভালো কিছু আশা করেছিলাম। বাংলাদেশের দর্শক হিসেবে এটা চাইতেই পারি। মেহেদী হাসান মিরাজ এর মধ্যেও তার দক্ষতা দেখিয়েছেন। কিন্তু ক্রিকেট হলো টিমের খেলা। একা টেনে নেওয়া অত্যন্ত কষ্টের। আমরা দর্শক হিসেবে এটুকুই বুঝি, টেস্ট ফরম্যাটে সফলতা পেতে টেস্ট ক্রিকেটে খেলার আরও দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় জনপ্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো ক্রিকেট। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের ক্রিকেটের উত্থানের প্রতিটি অধ্যায় এদেশের মানুষের মনে দাগ কেটে আছে। প্রতিটি বিশ্ব শক্তির বিরুদ্ধে জয়ের এক একটা ইতিহাস আমাদের মনে আছে। ফুটবলের আলো এদেশে বহুবছর ধরে ম্রিয়মাণ। তবে ক্রিকেটটা গত কয়েক বছর ধরেই অধিক উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। বাঘা বাঘা সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধরাশায়ী করেছে আমাদের টাইগাররা। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, বাংলাদেশের মানুষের আনন্দের একটি বড় উৎস হলো ক্রিকেট। আমরা ক্রিকেট নিয়ে চিন্তা করি, ক্রিকেটারদের নিয়ে ভাবি, ক্রিকেট নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখি। সেই স্বপ্নের কথা আজ না বলি। ক্রিকেট আমাদের কাছে আবেগ। আর ক্রিকেটের অগ্রভাগে থেকে যে লড়াকু সৈনিকরা ক্রিকেটকে আজকের অবস্থায় এনেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মোস্তাফিজ, লিটন, সৌম্য। আরো অনেকে আছেন। তাদের জন্যই আমাদের আজকের ক্রিকেট বিশ্বে প্রতিযোগিতায় সগর্বে অবস্থান করছে। আজ বাংলাদেশ ক্রিকেটের যে অর্জন তা গোটা বিশ্ব দেখছে। সমন্বিত নৈপুণ্যে বাংলাদেশ দল আজ কোথায় পৌঁছে যাচ্ছে তা যেন কোনো সীমায় বাধা যায় না। বিগত দুই বিশ্বকাপেই আমাদের দেশ ভালো খেলেছে। আমরা সেই খেলা দেখে আনন্দিত হয়েছি। বিশ্বকাপ আমাদের কাছে একটি স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের বিশ্বকাপ একদিন বাংলার সোনার ছেলেরা এই দেশের মাটিতে নিয়ে আসবে এ আমাদের বিশ্বাস। এই বিশ্বাস থেকেই আমরা সবসময় আমাদের ক্রিকেটারদের পাশে থাকি, তাদের উৎসাহ দেই, অনুপ্রেরণা দেই।
আজকের বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যে অবস্থায় দাড়িয়ে, সেখানে বিভিন্ন সময়ের ক্রিকেটাররা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। দলীয় প্রচেষ্টা ছাড়া বিজয় অর্জন করা যায় না। তবে মাশরাফির নেতৃত্বে অন্য এক বাংলাদেশের উত্থান ঘটেছে। বর্তমান ক্রিকেট দল আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের যে কোনো সময়ের চেয়ে সেরা পারফরম্যান্স করা একটি দল। এই দল একটি ভারসাম্যপূর্ণ একটি দল। যেখানে নিখাদ ব্যাটসম্যান, বোলার এবং অলরাউন্ডারের সমন্বয় রয়েছে। দল হারলে আমাদের চোখেও জল আসে। আমরা ব্যথিত হই। এটা আমরা করি কারণ আমরা যেমন ক্রিকেটকে ভালোবাসি তেমনি ক্রিকেটারদেরও ভালোবাসি। সামর্থ্যরে বেশিও হয়তো মাঝে মাঝে আমরা আশা করি। এটাও ভালোবাসার দাবি থেকেই। তাই সেই আশা যখন অনেক বেশি অপূরণ থাকে তখন খারাপ লাগাটাও স্বাভাবিক। টি-টুয়েন্টি সিরিজে যে দাপট দিয়ে বাংলাদেশ দল শুরু করেছিল তাতে আমাদের দেশের মানুষকে আশায় ভাসিয়েছে। ভারতের মাটিতে এত বড় একটি বিজয় সত্যিকার অর্থেই ছিল অভূতপূর্ব। পরের দু’টি ম্যাচে জয় না এলেও খারাপ স্কোর হয়নি।
কী হতে পারতো তা নিয়ে চিন্তা না করে বরং যা হয়েছে তা নিয়েই ভাবতে হবে। আমাদের ভাবিয়েছে, আমাদের মনে বিষাদের ছায়া এনেছে টেস্ট সিরিজ। তবে আমি জয়ের কথা বলছি না। বলছি লড়াই করার কথা। জয়টা মুখ্য হলেও ক্ষেত্রবিশেষে ভালো লড়াই বা সম্মানজনক অবস্থাও অনেকটা প্রাপ্তি হতে পারে। যদি খেলাটা পঞ্চম দিনে গড়াতো, যদি হারটা ইনিংস ব্যবধানে না হতো, তাহলে এই অনুভূতি একটু ভিন্ন হতে পারাতো। দল জিতলে আমরা উল্লাস করি। আমাদের ভালবাসা প্রকাশ করি। কারণ সেই আবেগ। ক্রিকেটটা আমাদের কাছে আবেগের নাম। মাঠে আমাদের দর্শকরা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বলে চিৎকার করে। আমরা এভাবেই আমাদের ক্রিকেট দলকে নিয়ে চিৎকার করতে চাই। আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে চাই, তাকিয়ে দেখ আমরা ক্রিকেট জগতে রাজত্ব করতে এসেছি। ওয়ানডে, টি-টুয়েন্টি বা টেস্ট যে কোনো ফরম্যাটেই আমাদের লড়াই করার ক্ষমতা রয়েছে। আমরা জিততে পারি। তবে টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের আরও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। উইকেটে টিকে থাকার মানসিক শক্তি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের দেশের ক্রিকেট অনেক উন্নতি করেছে। সারা বিশ্বই বাংলাদেশকে সমীহের চোখে দেখে। জয় পরাজয় একটি খেলার জাতগত বিষয় হলেও আমরা এমন অবস্থানে পৌঁছেছি যখন খেলোয়াড়রা বিশ্বমানের। আমরা জানি, এই পরাজয়ের পর খেলোয়াড় এবং ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা ভুল ভ্রান্তিগুলো বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের জন্য দলকে প্রস্তুত করবেন। কোথায় সমস্যা তা খুঁজে বের করতে হবে। যাই হোক না কেন, আমাদের দেশের ক্রিকেট এবং খেলোয়াড়দের ওপর আমাদের আস্থা ছিল এবং তা ভবিষ্যতেও থাকবে।
লেখক: সাংবাদিক