Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিস্মৃতপ্রায় জাফর মুন্সী আর আরিফ রায়হান দীপদের কথা


১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০২:২৬

এদেশে একদিন একজন জাফর মুন্সী ছিল। ছিল একজন আরিফ রায়হান দীপ। খুব সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন জাফর মুন্সী। বিশাল স্বপ্ন দেখা বা সিস্টেম বদলাতে চাওয়া কোনো বিপ্লবী নন, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সদা প্রতিবাদী কোনো অ্যাক্টিভিস্ট নন, লেখক-সাহিত্যিক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সাড়া জাগানো কোনো সেলেব্রেটিও নন, ৪৫ বছর বয়সী জাফর মুন্সী ছিলেন একেবারেই আমজনতার একজন। ফরিদপুর জেলার ভাঙা উপজেলার ঘারুয়া ইউনিয়নের গঙ্গাধরদী গ্রামের খোরশেদ আলীর ছেলে জাফর মুন্সী থাকতেন কমলাপুর এলাকার একটি মেসে। নিম্ন আয়ের একজন চাকুরে সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত জাফর মুন্সীর স্ত্রী আর তিন সন্তানকে নিয়ে ছিল চমৎকার এক পরিবার। খুব বেশি সচ্ছলতা ছিল না, কিন্তু শান্তি আর আনন্দ ছিল। আরও অনেকের মতোই জাফরও স্বপ্ন দেখতেন সন্তানদের নিয়ে। কোলের শিশু মেয়েটার নাম ছিল দিবা, ছেলে দুজনের নাম ছিল জিসান ও যুবরাজ। ছেলেদের পাইলট আর মেয়েকে ডাক্তার বানাবেন। অভাব আর নানা প্রতিকূলতায় জীবনে নিজে যেখানে পৌঁছাতে পারেননি, সন্তানেরা সেখানে পৌঁছবেন। মতিঝিলের অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের লিফট-ম্যানের চাকরি করতেন জাফর। পদে খুব বড় কিছু না হলেও খুব সাধারণ জাফর মুন্সী দেশপ্রেম আর নিবেদনে ছিলেন অসাধারণ। দেশকে, জন্মভূমির সম্মান আর দেশের জন্য কিছু করার প্রচণ্ড তাড়নাটা বুকের গভীরে কী তীব্রভাবে পুষতেন তিনি, তার এক অভূতপূর্ব উদাহরণ ঘটিয়েছিলেন মানুষটা ২০১৩ সালে।

বিজ্ঞাপন

জীবনযুদ্ধে প্রবল সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এগোলেও জাফর মুন্সী ছিলেন রাজনীতি সচেতন, দেশের আদর্শের জায়গায় অটল। জাতীয় শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত অগ্রণী ব্যাংক কর্মচারী সংসদের কার্যনির্বাহী সদস্য জাফর মুন্সী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ ও চেতনা সযত্নে ধারণ করতেন বুকের ভেতর। তাই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও জেনোসাইডের বিভিন্ন অপরাধে রাজাকার আলবদর কমান্ডার কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার প্রতিবাদে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যখন শাহবাগে গণজাগরণের সৃষ্টি হলো, তখন আরও অসংখ্য সাধারণ মানুষের একজন হিসেবে জাফর মুন্সীও মিশে গিয়েছিলেন সেই উত্তাল জনস্রোতে।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু একাত্তরের সেই আলবদর জল্লাদদের উত্তরসূরিরা কখনই হাল ছেড়ে দেয়নি। রাজাকার আলবদরদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে একাত্তরের জেনোসাইডার জল্লাদের দল জামায়াতে ইসলাম এবং ইসলামী ছাত্রসংঘ, অর্থাৎ ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা দেশজুড়ে ভয়াবহ নৈরাজ্য ও পুলিশ-প্রশাসন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের উপর হামলা-আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। ৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণের উত্তাল সেই সময়েও তারা বসে ছিল না। ২০১০ সাল থেকে পুলিশ-প্রশাসন-সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে নানাবিধ হামলা-সহিংসতা চালিয়ে আসা জামাত-শিবির ক্যাডারদের নতুন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় রাজাকার আলবদরদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে আন্দোলনকারীরা। বিশেষ করে ১২ ফেব্রুয়ারি শাহবাগের গণজাগরণের ডাকে সাড়া দিয়ে মতিঝিলে অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তিন মিনিট নীরবতা কর্মসূচী পালন করার পর জামায়াত এবং শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডারদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় অগ্রণী ব্যাংক। সেই কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন জাফর মুন্সী।

পরদিন ১৩ ফেব্রুয়ারি বুধবার সকালে জামাত-শিবিরের একদল সন্ত্রাসী লাঠিসোঁটা, চাপাতি ও রড নিয়ে মতিঝিলে অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে হামলা চালায়। শাহবাগ-আন্দোলনের সমর্থনে অগ্রণী ব্যাংকের কর্মচারী-কর্মকর্তা কর্তৃক লাগানো ব্যানার “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই” ছিঁড়ে ফেলতে উদ্যত হয় তারা। নাম প্রকাশ না করে জাফর মুন্সীর সহকর্মী এবং স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী হামলার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, বুধবার সকালে শিবির ক্যাডাররা দলবদ্ধ হয়ে অগ্রণী ব্যাংকের সামনে আসে। তারা ব্যাংকের সামনে টানানো ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই’ সংবলিত ব্যানারটি ছিঁড়তে টান দেয়। এ সময় ব্যাংকের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর মতো জাফর মুন্সীও ছুটে আসেন। শিবির ক্যাডারদের হাতে হাতে লোহার রড আর দেশি অস্ত্র দেখে অন্য কর্মকর্তারা প্রাণভয়ে চলে গেলেও নড়লেন না মুন্সী। দেশপ্রেমের প্রবল শক্তিতে অসমসাহসে রুখে দাঁড়ান স্বল্পশিক্ষিত, অভিজাত সমাজের চোখে নীচুতলার এই মানুষটা। জান যায় যাক, কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে ব্যানার ছিঁড়তে দেবেন না খুনি জল্লাদদের উত্তরসূরিদের, ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে কর্মকর্তা কর্মচারীদের উপর হামলা চালাতে দেবেন না । একাই তাড়া করেন মুন্সী শিবিরের ক্যাডার বাহিনীকে। প্রায় একশ’ গজ দূরে পূবালী ব্যাংকের এটিএম বুথের ডান কোণায় তাড়া করে নিয়ে যাওয়ার পর শিবির ক্যাডাররা হঠাৎ ঘিরে ফেলে মুন্সীকে।

ফলাফলটা হয়েছিল ভয়াবহ। লোহার রড দিয়ে মারতে মারতে জাফর মুন্সীর মাথা থেঁতলে দিয়েছিল ওরা, তারপর চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ফেলে রেখে গিয়েছিল পূবালী ব্যাংকের এটিএম বুথের সামনে। মারার সময় এই ছাত্রসংঘের কর্মীরা যেন সেই একাত্তরের জল্লাদদের মতই দম্ভভরে পাশবিক উক্তি করেছিল, “মুক্তিবাহিনীর রক্ত চাই। জাগরণ মঞ্চে সংহতি জানানোর পরিণতি কী, দেখ এবার।”

না, ওরা একাত্তরের ছাত্রসংঘ নয়। স্রেফ নামটা বদলানো ২০১৩ সালের ছাত্রসংঘ। যাদের সবাই ভদ্র-সভ্য-অমায়িক ছাত্রশিবির হিসেবে চেনে। সেদিন শুধু মতিঝিল নয়, রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে একযোগে তাণ্ডব চালায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী আলবদরের দল জামাত-শিবির। তাদের নৃশংসতায় গুরুতর আহত জাফর মুন্সীকে প্রথমে ঢাকা মেডিক্যালে এবং পরে ধানমণ্ডির গ্রিন লাইফ হাসপাতালে নেওয়া হয়। মাথা ও ঘাড়ে গুরুতর আঘাতের ফলে সেখানেই ১৪ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার সকাল দশটার দিকে মুন্সীর মৃত্যু হয়। জামাত-শিবিরের নারকীয় সহিংসতায় মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় আরও একটি নাম। একজন ব্যাংকের লিফটম্যান বা দারোয়ান কারো প্রয়োজন ছিল না ওই পোস্টার নিয়ে মাথা ঘামানোর। কিন্তু শিবিরের হামলা ঠেকাতে জীবন দিয়ে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসীর দাবীতে লাগানো সেই ব্যানার-পোস্টার রক্ষা করে গিয়েছিলেন জাফর মুন্সী। অক্ষতই ছিল সেগুলো, তার অসমসাহসিকতায় সেদিন শিবিরের ক্যাডারেরা ব্যাংকের ভেতর ঢুকে হামলা চালাতে পারেনি।

তার স্ত্রীর নাম রিনা। তার স্ত্রী-তিন সন্তান সেদিন হারিয়েছিল তাদের সবচেয়ে আপনজনকে। এই মানুষগুলো আজও বিচার পায়নি। তার বিচার দাবী করতে হলে আগে তাকে চিনতে হবে, জানতে হবে, মনে রাখতে হবে। জাফর মুন্সীকে বেশিরভাগ মানুষই চেনে না, জানে না যে তিনি তার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন জল্লাদের উত্তরসূরি ছাত্রশিবিরের ক্যাডারদের হাতে। যারা তাকে চেনে না, নামও জানেনি কোনদিন, তাদের যারা জানাতে পারতেন, খুব সহজেই তারা ভুলে গেছেন শহীদ জাফর মুন্সীর কথা। এমনকি শ্রমিক লীগের কর্মী হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগও তাকে ভুলে গেছে নিদারুণ অবহেলায়। সবাই জাফর মুন্সীকে এমনভাবেই ভুলেছেন যে, বছরে এই একটা দিনেও তাকে নিয়ে তেমন কথা হয় না, গুগলে খুঁজে তার ভালো কোনো ছবি, বিস্তারিত কোন লেখা, কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না।

‘এই পথে আজ জীবন দেবো, রক্তের বদলে ফাঁসি নেবো’। আরিফ রায়হান দিপ। প্ল্যাকার্ডে এই কথাগুলো নিজের হাতে লিখে সেটা নিয়ে গলার রগ ফুলিয়ে রাজাকারের ফাঁসীর দাবিতে ৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণের সেই উত্তাল জোয়ারে নেমে এসেছিলেন মানুষটা। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক দিপ কাজী নজরুল ইসলাম হলে থাকতেন। ৯ এপ্রিল সেই হলেরই এক শিক্ষার্থী হেফাজতে ইসলামের এক কর্মী ৪র্থ বর্ষের মেজবাহ আরিফ রায়হান দিপকে উপুর্যপরি চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে পালিয়ে যায়। আহত দিপকে হাসপাতালে নেওয়ার পর থেকেই তিনি অচেতন অবস্থায় আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। দিপের জ্ঞান আর ফেরেনি। ২ জুলাই তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করেন ডাক্তাররা।

দিপকে আমরা মনে রাখিনি। এই প্রজন্মের সন্তানদের কাছে দিপ প্রায় হারিয়ে যাওয়া একটা নাম। দেশকে ৪২ বছরের পুরনো কলঙ্ক মুক্ত করতে দিপ নেমেছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে। ঘাতকের চাপাতি তাকে থামিয়ে দিয়েছে। আলবদরদের ফাঁসী দেখতে দেয়নি। স্বজাতির রক্তের বদলায় রাজাকার নরপিশাচদের ফাঁসী হওয়ার পথটা তৈরি করতে দিপ নিজের অমূল্য জীবনটা পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলেন, তিনি তার কথা রেখেছেন। দিপ নিজের জীবনটা দিয়ে গেছে।

কিন্তু যে দিপ, জাফর মুন্সীদের রক্তের বিনিময়ে অবশেষে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলাম, তাদের কী অবলীলায় ভুলে গেলাম! সেই পুরনো আলবদরদের উত্তরসূরি ঘাতকের দল তো কখনো থামেনি, দিপ-জাফর মুন্সীর পথ ধরে রাজীব হায়দার শোভন-অভিজিৎ রায়-ওয়াশিকুর বাবু- অনন্ত বিজয় দাশ-নীলয় নীল-ফয়সাল আরেফিন দীপন-নাজিমুদ্দিন সামাদসহ আরও অসংখ্য নাম। এদের সবাইকেই নানা কারণ দেখিয়ে নানা অজুহাতে কুপিয়ে মারা হয়েছে, মৃত্যুকে জায়েজও করে ফেলা হয়েছে নানা উপায়ে। কিন্তু তাদের সুপরকল্পিতভাবে মেরে ফেলার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল তারা প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করতেন, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে গণজাগরণের অংশ ছিলেন তারা। এটাই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ, সম্ভবত একমাত্র অপরাধ। জাফর মুন্সী-দিপেরা তাদের দায়িত্ব সর্বোচ্চ আত্মত্যাগে পালন করে গেছেন, নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের কথা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কি আদৌ পালন করছি আমরা?

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর