বাংলা ভাষার গাঁথুনি শক্ত হোক
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৪:০২
একটি দেশের ভাষা সেদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাও আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আধার। বাংলা ভাষা আমাদের ইতিহাসের অংশ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রেরণা। রক্তের বিনিময়ে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত এই বাংলা ভাষা। এই ভাষার নামেই আমাদের দেশ।
ভাষা হলো শক্তি, ভাষা হলো সেতু। ভাবের মাধ্যম ভাষা। শুদ্ধ বা প্রমিত ভাষা— ভাষার সৌন্দর্য। আঞ্চলিক ভাষা— ভাষার ঐশ্বর্য। প্রযুক্তিগত বিপ্লবের কারণে আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে অনেকেই আমরা নিজের ভাষার সৌন্দর্য নষ্ট করছি, অমর্যাদা করছি।
ভাষাচর্চার অন্যতম উপায় হলো সাহিত্যচর্চা। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে বর্তমানে সাহিত্যচর্চায় বা পাঠে বেশিরভাগেরই তেমন আগ্রহ নেই। কারণ সাহিত্যচর্চা বা বই পড়ার জন্য যে সময় সেটি তাদের কাছে খুব কম। সবকিছু খুব সহজে পেয়ে যাওয়ার কারণে এখন অনেকেই সাহিত্যের প্রতি মাথা খাটিয়ে কিছু আরোহণ করার আগ্রহ রাখে না। ফলসরূপ যেটি ঘটে তা হলো, নির্দিষ্ট ও সীমিত শব্দণ্ডারে সীমাবদ্ধ থেকে কিংবা ইংরেজি ভাষা থেকে কিছু শব্দ ধার করে ভাবের আদান প্রদান করতে হয়। অনেক সময় অনেক বাংলা শব্দ বুঝাতে গেলেও বিদেশি শব্দ দিয়ে বুঝাতে হয় কারণ নিজ ভাষায় সেটি অনেকেই বুঝতে পারে না।
এদেশে উচ্চশিক্ষায় নেই মাতৃভাষার ব্যবহার। নির্দিষ্ট কিছু বিষয় ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশিরভাগ বিষয়ই ইংরেজি ভাষায় পড়ানো হয়। কারণ বিদেশি ভাষার বইগুলোকে অনুবাদ করে আমাদের ভাষায় পড়ানোর মতো জায়গায় আমরা এখনো পৌঁছাতে পারিনি। কেন পারিনি সেটি সহজেই অনুমেয়। অনেকটা আড়াল করা সত্য। অথচ, অনেক দেশেই মাতৃভাষায় শিক্ষাদান হচ্ছে। এছাড়া নতুন প্রজন্মের শিশুদের ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে আমরা তাদের বাংলা ভাষার প্রতি আরও অজ্ঞ করে তুলছি।
অন্যভাষা কি তাই বলে শিখবো না? অবশ্যই শিখবো। একাধিক ভাষা জানা একটি দক্ষতার বিষয়। একাধিক ভাষায় দক্ষতা থাকা যুগের প্রয়োজন অনুযায়ী অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অন্যভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে গিয়ে যদি নিজ ভাষা ভুলে যাওয়া হয় তবে সেটি মাতৃভাষার মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করার শামিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে চাই, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন।’
আঞ্চলিক ভাষা কি অশুদ্ধ? না, আঞ্চলিক ভাষা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা। এর কোনো লেখ্য রূপ নেই। আঞ্চলিক ভাষা তাই বলে অশুদ্ধও নয়। ভাষার ধর্ম বদলানো, তাই এটি অঞ্চলে অঞ্চলে বদলে গিয়ে আঞ্চলিক রূপ ধারণ করে। আঞ্চলিক ভাষা বাংলার ঐশ্বর্য। সকল মানুষকে বুঝানোর জন্যই ভাষার প্রমিত রূপ আছে, যেটি মৌখিক ও লেখ্য রূপে প্রকাশ করা যায়।
ভাষার ব্যাবহারিক প্রয়োগের কথায় যদি আসি, বাংলা ভাষা লেখার ক্ষেত্রে আমাদের একধরণের উদাসীন ভাব লক্ষ্য করা যায়। সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায় ‘বানান’ এর ক্ষেত্রে। যাচ্ছেতাই ‘বানান’ শুধু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেই যেন মানায়। অন্য ভাষার বানানে, উচ্চারণে ভুল হলে সেটি ‘মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাওয়া’র ভুলের মতো মনে হলেও বাংলা ভাষায় ভুলের ক্ষেত্রে ‘এ আর এমন কি’। এছাড়া অধুনিক বা কথিত ‘স্টাইলিশ’ উচ্চারণের কারণে ভাষার যে বিচ্ছিরি বিকৃতি ঘটাচ্ছি সেটিও অনেকে ভুলে যাচ্ছি।
ভাষার মাসে কৃতজ্ঞতা সকল ভাষা সৈনিক ও শহিদের প্রতি, যারা প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেছেন মাতৃভাষা বাংলাকে। এখন সকলের আগ্রহ, সহযোগিতা, ভাষার প্রতি যত্নশীলতা ও বাংলাচর্চাই বাংলা ভাষার শুদ্ধতা ও মর্যাদা রক্ষা করতে পারে। অতুলপ্রসাদ সেনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলে যেতে চাই—
‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালোবাসা!’’
লেখক: শিক্ষার্থী (বাংলা বিভাগ) ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়