একটি বজ্রহুঙ্কার, বাঙালি পেল স্বাধিকার
৭ মার্চ ২০২১ ০৯:০৯
শোষণের জাঁতাকলে হাজার বছর ধরে পৃষ্ঠ হওয়া জাতি বাঙালি। শোষণমুক্তি, অন্যায় অবিচার কিংবা পরাধীনতার বিরুদ্ধে বাঙালিকে চূড়ান্ত অগ্নিপরীক্ষার পথ পরিক্রমায় যে ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে গিয়েছিল তা ৭ মার্চের ভাষণ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যা মুক্তিকামী মানুষের স্বার্থে পরাধীনতার কবল থেকে জাতিকে মুক্ত করতে পাকি হানাদারদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দিয়েছিলেন। বর্তমানে ইউনেস্কোর ঘোষণা অনুযায়ী যা, বিশ্ব ঐতিহ্যর প্রামাণ্য দলিল হিসাবে স্বীকৃত। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য কিংবা মুক্তির ইতিহাসে অনবদ্য, অদ্বিতীয় এক নিদর্শন ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ।
৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের সেরা ভাষণগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে অভিহিত হয় সর্বদা। যার পিছনে রয়েছে উল্লেখযোগ্য অনেক কারণ। প্রথমত, ভাষণটি ছিল উদ্দীপনাময়, মুহূর্তেই সবাইকে নব চেতনায় এগিয়ে যেতে উৎসাহ যোগায়। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ যার ফলশ্রুতিতেই হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, এই ভাষণের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ শোষণ থেকে একটি জাতিকে চিরমুক্তি দেওয়া। তৃতীয়ত, ৭ মার্চের ভাষণ ছিল বাঙালির জন্য সর্বদা প্রেরণাদায়ক (৭ কোটি বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবে না)। চতুর্থত, ভাষণটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে শব্দশৈলী, শব্দচয়ন এবং গতিময়তার পরিচয় দিয়েছেন অলিখিত অবস্থায় তা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। যার ফলশ্রুতিতে নিউজউইক পত্রিকা বঙ্গবন্ধুকে Poet of politics হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সর্বোপরি, স্বতঃস্ফূর্ত, হৃদয় নিহিত, অলিখিত, নীতিদীর্ঘ (১৮ মিনিট -১১০৫টি শব্দ) ভাষণ ছিল বঙ্গবন্ধুর দেওয়া মুখনিঃসৃত অমৃত মুক্তির বাণী। স্বভাবতই, বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য অন্যান্য সকল বিশ্বনেতার ভাষণের চেয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পুরোপুরি আলাদা, অদ্বিতীয় এবং অবশ্যই শ্রেষ্ঠ।
তাৎপর্যগত দিক থেকে ঐতিহাসিক এই ভাষণের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা ভাষণটি ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা। পাক সরকারের রক্তচক্ষু, নানা চাপ, ভয়ভীতি দূর করে মঞ্চে বিশ্বজয়ে তৈরি হতে হয়েছিল শেখ মুজিবকে। পরিস্থিতির চাপে ভীতসন্ত্রস্ত পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সদর দফতর থেকে বিভিন্নভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে এই মেসেজ দেওয়া হয় যে, ৭ মার্চ যেন কোনোভাবেই স্বাধীনতা ঘোষণা না করা হয়। ৭ মার্চ জনসভাকে কেন্দ্র করে কামান বসানো হয়। খোলা আকাশে সার্বক্ষণিক টহল দিতে থাকে হেলিকপ্টার। তবুও দমে যাননি বঙ্গবন্ধু! দিয়েছেন অসীম সাহসের চূড়ান্ত পরিচয়। মৃত্যুভয়কে করেননি পরোয়া। যতদূর জানা যায়, ৭ মার্চ ভাষণ দেওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বলেছিলেন, আল্লাহর নাম নিয়ে তোমার মন-দিল-অন্তর থেকে যা আসে- তাই বলে দিও। বাস্তবেও বঙ্গবন্ধু মনের কথা বলেছিলেন অবলীলায় – এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি সেদিন যুদ্ধের ঘোষণা যেমন পরোক্ষভাবে প্রদান করেন, আবার যুদ্ধে কিভাবে জয়ী হতে হবে সে ব্যাপারেও বক্তব্য রাখেন।
মুক্তিকামী জনতার মুক্তিকামী হওয়ার সময়োপযোগী এক সমাবেশ ছিল রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ৭ মার্চের ভাষণ। আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিংদের ছাড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তাই জায়গা করে নিয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে। ইউনেস্কো বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, গৌরবের এক উপহার দিয়েছে বাঙালি জাতিকে। ইউনেস্কোর প্রতি কৃতজ্ঞতা তাই প্রতিটি বাঙালির হৃদয় গহ্বরে থাকা উচিত। ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি দেওয়ার পেছনে ছিল যথেষ্ট সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার ছাপ।
৭ মার্চের ভাষণ বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের অগ্রিম প্রস্তুতির বিশেষ সংকলন। যা আমাদের এগিয়ে চলার প্রেরণা। সকল অপশক্তি রুখে দেওয়া এবং দেশপ্রেমে মত্ত থাকাই এ ভাষণের মূল শিক্ষা।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়