Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কিছু শিক্ষক এত নিষ্ঠুর কেন


১২ মার্চ ২০২১ ১৮:৩৬

আমার বাবা একজন মাদরাসা শিক্ষক এবং মসজিদের ইমাম। ছোটবেলায় বাবার কাছে মক্তবে পড়েছি, মাদরাসাতে পড়েছি। বাবার খুব কাছে ছিলাম। সে সুবাদে দেখতাম, মানুষজন সন্তানদের বাবার কাছে এনে বলতেন, রক্ত-মাংসগুলো আপনার হাড্ডিগুলো আমাদের। বাবার যেন কিছুতে কর্ণপাত ছিল না তাতে। হেসে উড়িয়ে দিতেন। সবাইকে পড়া দিতেন, সবাই পড়তো। না পারলে বেতের সামান্য একটু ব্যবহার হতো। যেটাকে শাসন বলে বা পড়া না পারার বা পড়া মনোযোগ দিয়ে না পড়ার শাস্তি।

বিজ্ঞাপন

মক্তব শেষে দুই বছর মাদরাসায় পড়ে প্রাইমারিতে পাঠ শুরু। সেখানেও দেখতাম, আমাদের স্যাররা বেত নিয়ে ক্লাসে যেতেন। পড়া না পারলে, না পড়ে আসলে বেতের মাইর আছে, সে ভয়ে অনেকে পড়া শিখে যেত। তেমনটা আমিও। মাঝে মাঝে দু’একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠত, শিক্ষার্থী নির্যাতনের। সে জন্য প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং স্কুল কমিটির কাছে জবাব দিতেে হতো। তবে তাও নির্যাতনের মাত্রা অতটা ভয়াবহ ছিল না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেত নিষিদ্ধ হয়েছে অনেক আগেই। বলা হচ্ছে, বেত্রাঘাত শিক্ষার্থীদের মেধা-মননে নেতিবাচক প্রভাবে ফেলে। সেজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েক বছর ধরে বেতের ব্যবহার নেই বললেই চলে। তবে, কওমি মাদ্রাসাগুলোতে এখনো সেই বেতের ব্যবহারটা রয়েই গেছে।

সম্প্রতি যে ঘটনাটার সরাসরি মুখোমুখি হয়েছি, সেটা হলো, নোয়াখালীর চাটখিলের খিলপাড়ার জামিয়া ইসলামিয়া তৈয়্যবিয়া মাদরাসায় নিজ ছোট ভাইকে পড়তে দেওয়া হয়েছে। এলাকার অনেক অভিভাবকই সন্তানদের ওখানে পড়াচ্ছেন। তাই আমার মা-বাবাও সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখানে ছোট ভাইকে পড়তে দিয়েছেন। মাদরাসায় গেলাম, পরিবেশ বেশ ভালো। স্থানীয় সংসদ সদস্যের বড় ভাই মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করছিলেন। তাই তারও একটা দেখাশোনা আছে।

একদিন হঠাৎই বাড়িতে ফোন এলো, ছোট ভাই মাদ্রাসাতে নেই, সে পালিয়ে এসেছে। ভাগ্যিস সঙ্গে এলাকার একটা ছেলে ছিল, সে সহ জিজ্ঞেস করতে করতে এসে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছোট ভাই অবস্থান নেয়। পরে পরিবার খোঁজ পেয়ে তাকে সেখান থেকে বাড়িতে নেয়। জানা গেল, শিক্ষকের মার খেয়ে সে চলে এসেছে। বাড়িতে থেকে পড়া নষ্ট হচ্ছে। তাই বাবা মাদরাসায় গিয়ে দায়িত্বরত শিক্ষককে বুঝিয়ে দিয়ে আসলেন। যেন আর না মারে।

বিজ্ঞাপন

সপ্তাহ দুয়েক পর হঠাৎই এক সিএনজি চালক ফোন দিলেন বাড়িতে। তারপর জানা গেল, ছোট ভাই এবং আরেকটা ছাত্র মাদরাসা থেকে চলে এসেছে, এখন অপরিচিত এক জায়গায়। জেলা শহরে অবস্থান করায় সিএনজি চালককে বললাম, ওদের নিয়ে আসেন। তারপর ওরা আসলো, জানতে চাইলাম কী হয়েছে? ছোট ভাইয়ের সাথের ছাত্রটা বললো, তাকে হাত পিছনে বেঁধে মারধর করা হয়েছে। ছোট ভাই বললো, সে বাড়িতে কেন গেল? সেজন্যেও তাকে একই শিক্ষক আবার মেরেছে!

তাৎক্ষণিক ওই শিক্ষককে ফোন দিয়ে জানতে চাই, তিনি উল্টো গরম। তারপর তাকে মেসেঞ্জারে নক করলে তিনি বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। আইনি ব্যবস্থা নেব, বলার পর তিনি বললেন, আপনি কিসের সাংবাদিক, ফেসবুকে ছবি দুই একটা ছবি ছাড়লেই কি সাংবাদিক হয়? এভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা।

পরদিন সকালে বিষয়টি নোয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে জানাই। তিনি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেন এবং স্থানীয় প্রশাসনকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। পরে মাদরাসা কমিটি তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে। মাদরাসা কমিটির কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, আমাদের এখানে বেতের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এরপরেও এরা কিভাবে যে বেত নিয়ে ছাত্রদের ওপর বেত্রাঘাত করেন। কয়েক বার সর্তক করেছি, এর আগেও একজনকে একই অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রথমে ছাত্ররা স্বীকার করে না শিক্ষকের ভয়ে, পরে তাদের নীরব স্থানে ডেকে নিয়ে জানতে পারি, ছাত্রদের পেটানোর ঘটনাটি সত্য এবং তাকে আমরা সেজন্য চাকরি থেকে বরখাস্ত করি। পরে ছোট ভাইকে আর সে মাদরাসায় দেইনি।

কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর একটি মাদ্রাসায় এক ছাত্রকে শিক্ষকের অমানবিক নির্যাতনের ভিডিও নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, ওই ছাত্রের জন্মদিনে তার মা তাকে দেখতে এসেছেন এবং তাকে সময় দিতে এসেছেন। দেখা করা শেষে ছেলেটি মায়ের পেছনে পেছনে চলে যাচ্ছে। এ গেল কেন, সেজন্য অভিযুক্ত ওই শিক্ষক শিশু শিক্ষার্থীকে একটি রুমে নিয়ে বর্বরতম এক পিটুনি দিয়েছেন। যে ভিডিও দেখে অনেকের রাত ঘুম হয়নি। এত অমানবিক, এত পাষাণ হতে পারেন একজন মানুষ, ভিডিওটি না দেখলে আসলে বিশ্বাসই করা যাবে না। ওই ছাত্রের মা-বাবা অন্ধভক্ত হয়ে বসে আছেন, তিনি শিক্ষক, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলে বেয়াদবি হয়ে যাবে! তাই তিনি কাগজে আবেদন করে ওই অভিযুক্ত শিক্ষককে ছাড়াও করেছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, ছাত্রের মা-বাবা কেনই বা অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই যেতে চাননি। তার একমাত্র কারণ, প্রথমে যে বলেছি, আমার ছোটবেলার গল্প। মানুষ ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এসে বাবাকে যে বলতেন, রক্ত-মাংস আপনার, হাড্ডিগুলো আমাদের। মনে হয় যেন, পিটে মেরে ফেললেও তাদের ছেলে-মেয়ে মানুষ হতে হতে বেহেশতে চলে যাবে! ঠিক, এমনই এক কুসংস্কারের ফলেই অভিভাবকরা যেমন বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলছেন না, ঠিক কওমি মাদরাসাগুলোর, বিশেষ করে যে সব শিক্ষক একদম শিশু, ১ম, ২য়, ৩য় শ্রেণি, এই ক্লাসগুলোতে পড়ান, সেই সব শিক্ষকরা বেতের ব্যবহারটা করে যাচ্ছেন।

বছরখানেক আগেও সাভারের একটি মাদরাসায় একই কায়দায় এক শিক্ষক ছাত্রকে বেধড়ক পিটিয়েছেন। যেটার ভিডিও সিসিটিভি ফুটেজ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তখনও বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এখন কথা হচ্ছে, তারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছেন, তারা মূলত কারা? কী যোগ্যতার বলে তারা শিক্ষকতা পেশায় আসছেন।

এখন কথা হচ্ছে কিভাবে এ পরিস্থিতি থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি? অনেকেই দাবি তুলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিসিটিভির ব্যবস্থা করার। পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর