সংবাদকর্মীরা করোনা যুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা
১৫ মার্চ ২০২১ ২০:১২
বলা হয়ে থাকে সংবাদমাধ্যম যে কোনো দেশ ও সমাজের জন্য দর্পণস্বরূপ। কোন দেশ কী রকম তা জানতে এবং বুঝতে সেই দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো লক্ষ্য করলেই অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায়। কেননা রাষ্ট্রকাঠামো পরিচালনায় সংবাদমাধ্যম বা মিডিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মেলবন্ধন, এমনকি জবাবদিহিতাও সম্ভব একমাত্র সংবাদমাধ্যমের দ্বারাই। এই সংবাদমাধ্যম একটি দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিনোদন, সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ যে কোনো ধরনের পরিপার্শ্বিকতার কথাই দেশ ও বিদেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারে। এ হিসেবে সংবাদমাধ্যমগুলো মূলত দেশের স্বার্থেই সর্বদা কাজ করে থাকে। যার কারণে সংবাদমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে অভিহিত করা হয়।
যদি বাংলাদেশের কথা ভাবি তাহলে দেখা যাবে যে, ১৯৭১ সালের ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী দীর্ঘ নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, দেশি-বিদেশি অনেক সংবাদমাধ্যমই স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে শুরু করে পাকিস্তানি রক্তপিপাসুদের বর্বর সকল কর্মকাণ্ডের ভিডিওচিত্র বা স্থিরচিত্র সংগ্রহ কর। এবং বিভিন্ন লেখা বা তথ্য প্রকাশ করে তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষের দুর্দশার কথা দেশের সর্বস্তরের মানুষের নিকট এবং সমগ্র বিশ্বের বুকে সত্যকে তুলে ধরেছিল। এই সংবাদ মাধ্যমসমূহ, বিশেষ করে রেডিওর কল্যাণে বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সঠিক তথ্য জানার সুযোগ পেয়ে, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে, নিজ দেশ রক্ষার সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এতে স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরেছিল বাঙালিরা। এভাবে ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও স্বৈরাচার বিরোধী কার্যক্রমের মতো জাতীয় ও ঐতিহাসিক সকল ঘটনাকে জনমনে প্রভাবিত করতে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
সবচেয়ে বড় কথা হলো যে, এই সংবাদমাধ্যমগুলো পরিচালিত হয় সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীদের ঘাম ঝরা পরিশ্রমের দ্বারাই। সুতরাং, দেশের স্বার্থে সংবাদমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করতে হলে অবশ্যই সাংবাদিকদের অবদান আলোচনায় আসা দরকার। মানুষের যা কিছু জ্ঞাত, যা কিছু অজ্ঞাত তার সমন্বয় সংবাদকর্মীরাই করে থাকেন। প্রতিনিয়ত বদলে যাওয়া পৃথিবীর সংবাদ, সংবাদের আড়ালের সংবাদও তারাই তুলে আনেন, আর এ সমাজকে ঋদ্ধ করেন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। তাত্ত্বিকভাবে কিংবা পেশাগত দায়িত্বের নিরিখে তাদের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় থাকলেও, যারা সংবাদ নিয়ে কাজ করেন বা জনগণের কাছে সত্য তুলে ধরেন, মানুষের কাছে তাদের সর্বাধিক প্রচলিত পরিচয় সাংবাদিক হিসেবে। প্রচলিত পরিচয় কিংবা নামে বোধকরি এই দুই পক্ষের কারোর-ই আপত্তি নেই; কিন্তু বিপত্তি বাঁধে তখনই, যখন এই সাংবাদিক তথা গণমাধ্যম কর্মীদের কাজকে শুধু পেশাদারী দিক থেকে বিবেচনা করে সমাজের মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা ও অবদানের কথা বেমালুম ভুলে যায় দেশের মানুষ।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশে করোনা নামক ভাইরাসের উত্থান হয়ে ধীরে ধীরে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লে, শক্তিশালী ও উন্নত দেশগুলোসহ পুরো বিশ্বেই এর আক্রমণে এক ধরনের আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। পৃথিবীটা পরিণত হয় এক মৃত্যুকূপে। চতুর্দিক থেকে শুধু মানুষের বাঁচার আকুতি ও আর্তনাদ ভেসে আসতে থাকে প্রতিনিয়ত। এমতাবস্থায় সমগ্র বিশ্বে মাস্ক ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব বজায়, লকডাউন, কোয়ারেনটাইন, আইসোলেশন ও ঘন ঘন হাত ধোয়াসহ নানা ধরনের কঠিন সব ব্যতিক্রমধর্মী নিয়ম-কানুন ও বাধা প্রতিবন্ধকতার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় মানুষ। ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশেও এর প্রভাব পুরোপুরি এসে পড়লে এ দেশ ও মানুষকে বহু সমস্যা এবং বড় বড় অনেক চ্যালেঞ্জ, এক কথায় একধরনের যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
এই যুদ্ধে সাংবাদিকগণ দেশ ও জাতির স্বার্থে প্রতিটি মুহূর্তেই যুদ্ধ করেছেন বলা যায়। লকডাউনে যখন মানুষ ঘর থেকে বেরই হতো না, ঠিক তখনও দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে জীবন হারানোর ভয় না করে সংবাদ সংগ্রহের জন্য ছুটে বেড়িয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। একটা লক্ষণীয় ব্যাপার হলো যে, করোনায় মানুষ ইন্টারনেটমুখী হওয়াতে অনেক কুচক্রী মহল যখন সহজেই গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলেছে ঠিক এমন মুহূর্তেও সাংবাদিকগণ সত্য সংবাদ সংগ্রহ করে গুজবের হাত থেকে রক্ষা করেছেন মানুষকে। তাদের পরিবেশিত বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের কারণেই করোনা প্রতিরোধের সম্মিলিত প্রয়াস হয়েছে গতিশীল, জনজীবনে নেমে এসেছিল স্বস্তি।
করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট প্রদানের মতো জাতীয় অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন, স্বাস্থ্যখাতের বহু অনিয়মের তথ্য প্রকাশ, অসাধু ও দুর্নীতিবাজ জনপ্রতিনিধিদের ত্রাণ আত্মসাৎ ও ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রশ্ন ফাস, ধর্ষণ, ইভটিজিং, মাদক ও সন্ত্রাসবাদসহ বিভিন্ন রহস্যমূলক বিষয় সম্বলিত সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশের মাধ্যমে জনগণ, সরকার ও প্রশাসনকে সতর্ক এবং সহযোগিতা করার পেছনে এই সূর্যসন্তানদের অতুলনীয় ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে প্রতিদিন কত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, কোথায় চিকিৎসা সামগ্রীর অপ্রতুলতা রয়েছে সেই তথ্যগুলো নিয়মিত সংগ্রহ করে দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ এই সাংবাদিকেরাই করেছিলেন। এ ধরনের তথ্যের মাধ্যমে সরকারও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়েছিল। পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী, দাতা সংস্থাগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও এই সকল তথ্য ব্যবহার করেছেন। দেশের সবকিছু যখন অচল, তখনও সাংবাদিকেরা সারাদেশের সকল প্রান্তের মানুষকে একই সুতোয় গাঁথার কাজটি করে গেছেন।
দুর্যোগ বা মহামারিতে কিছু পেশার মানুষকে অনেক সময় দায়িত্ব পালন করতে না হলেও মাসিক সম্মানী প্রদান করা হয়। কিন্তু হাজার বিপদের মধ্যেও সাংবাদিকদের কলম, মাইক্রোফোন ও ক্যামেরা কখনো থেমে থাকে না। তারা জীবন বাজি রেখে হলেও তখন মাঠে কাজ করার মাধ্যমে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের মাধ্যমে বিশ্বে দেশ এবং জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করেন। আবার অনেক অপরাধীচক্রের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানীমূলক সাংবাদিকতার সময় প্রাণনাশ এবং লাশ গুমের হুমকিও উপেক্ষা করে কাজ করতে হয় সাংবাদিকদের। ২০২০ সালে এক চেয়ারম্যানের ত্রাণ আত্মসাতের বিরুদ্ধে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করলে এক সাংবাদিককে চেয়ারম্যানের ছেলে কর্তৃক জনসম্মুখে মোবাইল ছিনতাইয়ের অপবাদ দিয়ে হেনস্থা করতে দেখা গিয়েছিল। আবার কয়েকদিন পূর্বে নোয়াখালীতে এক রাজনৈতিক দলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে বোরহানউদ্দিন মুজাক্কির নামের এক সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার ঘটনাও কারও অজানা নয়।
এভাবে প্রতিনিয়ত সাংবাদিকগণ জানা-অজানা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে আসছেন, তবুও তারা থেমে নেই। সাংবাদিকেরা দেশ ও জাতির স্বার্থে জীবন ও পরিবারের কথা চিন্তা না করেই করোনা নামক যুদ্ধের ময়দানে শুরু থেকেই যুদ্ধ করেছেন, এখনো করে যাচ্ছেন এবং সর্বদাই করে থাকেন। করোনাকালে স্বাস্থ্যকর্মী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সকল সম্মুখ যোদ্ধাদের মত সংবাদকর্মীদেরকেও অন্যতম যোদ্ধা হিসেবে অভিহিত করা যায়। করোনা মহামারির এই ভয়াল দুঃসময়ে কিছু কিছু মানুষ দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে হলেও নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে গেছেন। দেশের সাংবাদিক তথা গণমাধ্যম কর্মীরা হলেন সেই সারিরই বীরযোদ্ধা। জাতির গভীর এই সংকটে তাঁদের অবদান হয়ে থাকবে চির স্মরণীয়।
লেখক:
মো. জাফর আলী
শিক্ষার্থী, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মো. ফারহান ইশরাক
শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়