চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনায় কাছাকাছি বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা
২০ মার্চ ২০২১ ১৬:৩৪
শ্রীলঙ্কা পোস্ট কলোনিয়াল সময় থেকেই নানাভাবে বিশ্ব রাজনীতিতে আলোচিত নাম। বিপুল সম্ভাবনা, শিক্ষিত ও কর্মঠ জনশক্তি থাকা সত্ত্বেও তামিল বিদ্রোহ দেশটিকে বারবার হোঁচট খাইয়েছে। বর্তমানে ২ কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার দেশটির জিডিপি ৮০ বিলিয়ন, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৭.৫ শতাংশ এবং মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ৭০০ ডলার। ২০০৯ সালে বহু বছর ধরে চলা রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের অবসানের পর দেশটির নীতি নির্ধারকরা জোর দিচ্ছেন অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে। এশিয়ার উদীয়মান বৃহৎ দুই অর্থনীতি চীন ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য করে স্বপথে হাঁটছে শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাক্কালে ১৯৭২ সালের ৩ মার্চ বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় শ্রীলঙ্কা। সে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও স্বাধীনতার মহান পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শতজন্মবার্ষিকীতে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে ঢাকা এসেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহেন্দ্র রাজাপক্ষে। শ্রীলংকা ও বাংলাদেশ সার্ক, বিমসটেক ও কমনওয়েলথের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। দক্ষিণ এশিয়ার নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় দুই দেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার এখনই উপযুক্ত সময়।
দুই দেশের সহযোগিতার অগ্রাধিকার খাত হতে পারে কৃষি, পর্যটন, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, ব্যাংকিং, তথ্য প্রযুক্তি ও শিক্ষা খাত। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের এফটিএ চুক্তি নিয়ে আলোচনা রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো দেশের এফটিএ বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নেই। প্রথম দেশ হিসেবে শ্রীলংকার সঙ্গে আলোচনাধীন এফটিএ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক কয়েকগুণে দাঁড়াবে, সেই সঙ্গে দুই দেশের সম্পর্ক ইতিহাসের অংশ হবে। বর্তমানে প্রায় ২৫ হাজার শ্রীলংকান বাংলাদেশে কাজ করছে। এদের বেশিরভাগই তৈরি পোশাক খাতে কাজ করে। তৈরি পোশাক খাতে মধ্যমসারির দক্ষ কর্মকর্তা তৈরিতে দুই দেশ একসাথে কাজ করতে পারে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের বিজিএমই ফ্যাশন ইনস্টিউটের সঙ্গে শ্রীলংকা টেক্সটাইল অ্যান্ড এপারেল ইনস্টিউটিটের চুক্তি রয়েছে। ব্যাংকিং ও শেয়ারবাজারে প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতেও শ্রীলংকা বিশ্বমান অর্জন করেছে। বর্তমানে শ্রীলংকার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। শ্রীলংকায় বাংলাদেশের ওষুধ, কাগজ ও সিমেন্টের চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৪৫টি শ্রীলংকান কোম্পানির ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ (পোশাক খাতে) রয়েছে। অন্যদিকে শ্রীলংকার ওষুধ খাতে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ রয়েছে মাত্র ২০ মিলিয়ন।
দুই দেশ সহযোগিতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত হতে পারে উচ্চশিক্ষা খাত। শ্রীলঙ্কার উচ্চ শিক্ষা বিশ্বমানের। তারা শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তি নির্ভরতা বাড়িয়েছে। ভোকেশনাল কলেজ প্রতিষ্ঠায় সাফল্য পেয়েছে। এছাড়া চাকরিনির্ভর প্রযুক্তি শিক্ষায়ও শ্রীলঙ্কা ব্যাপক সফল। ফরেন সার্ভিস একাডেমিকদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। বন্দরনায়েক সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ ও বাংলাদেশ ইনস্টিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের মধ্যে ভারত মহাসাগরীয় নিরাপত্তা কৌশল নিয়ে যৌথ গবেষণা করা যেতে পারে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ইস্যুতে দুই দেশের ঐক্যমত্যের পাশাপাশি পরিবর্তিত জলবায়ু উপযোগী কৃষি বীজ উৎপাদনে যৌথ গবেষণায় উভয় দেশ উপকৃত হবে। দুই দেশ একসাথে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে একসাথে কাজ করতে পারে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহেন্দ্র রাজাপক্ষে শ্রীলঙ্কার প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। এর আগেও ২০১১ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। বিশ্ব রাজনীতি ক্রমশ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ধাবিত হচ্ছে। চীনের প্রস্তাবিত বিআরই প্রকল্পে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। যদিও শ্রীলঙ্কা চীনের ঋণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে কিন্তু বাংলাদেশ ভারসাম্য রেখেই ঋণ গ্রহণ করছে। চীনের বিআরআইয়ের বিপরীতে ভারত-জাপান-অস্ট্রেলিয়ার কোয়াড দাঁড় হয়েছে। এসব পরিস্থিতি এটাই বার্তা দিচ্ছে, আগামী দিনে পরাশক্তিদের আধিপত্য বিস্তারের পটভূমি হতে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এমএনসিসিতে যোগ দিতে নারাজি জানিয়েছে শ্রীলঙ্কা। আবার শ্রীলঙ্কা ক্রমশ চীনা বিনিয়োগ নির্ভর হলেও এখনও শ্রীলঙ্কার বড় রফতানি বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট বলে গেছেন, শান্তিপূর্ণ ও বাণিজ্যবান্ধব ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ মালদ্বীপ একসাথে কাজ করতে পারে। এই ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কাও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে পারে। এসব পরিস্থিতিতে ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা নয়’ মনোভাবে স্বতন্ত্র পররাষ্ট্রনীতিতে অবিচল থাকতে গেলে বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোর অভিজ্ঞতা, সমর্থন ও মতৈক্য দরকার হবে। মার্কিন ও সোভিয়েত আধিপত্যের বাইরে গিয়ে ‘বানডাং কনফারেন্স’ এর মাধ্যমে যে জোট নিরপেক্ষ বলয় গত শতকের মাঝামাঝি বিশ্ব রাজনীতিতে জায়গা করে নিয়েছিল, তার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিল শ্রীলঙ্কা। এই অঞ্চলে বৃহৎ পরাশক্তিগুলোর টানাপোড়নে আবার ছোট দেশগুলোর নিরপেক্ষ জোট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাই অনাগত বিশ্ব রাজনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা টেকসই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তৈরির বিকল্প নেই। এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এই অঞ্চলে আগামী দিনের জোট নিরপেক্ষতার নেতৃত্ব দিতে পারে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক