বিশ্বযুদ্ধ বনাম করোনাকাল: শিক্ষকতার স্বরূপ
৪ অক্টোবর ২০২১ ১৬:০৮
কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাস আছে নাম ‘অনুবর্তন’। খুব আলোচিত নয় উপন্যাসটি। স্বল্প পঠিত এই উপন্যাসটি পাঠরত অবস্থায় সমকালের এক ঘটনার সূক্ষ্মতম মিল খুঁজে পেলাম। উপন্যাসে পটভূমি ব্রিটিশ শাসিত বাংলা। বিশ্বযুদ্ধের কারণে সংকটময় পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের অবস্থা তখন সঙিগন। অনেকেরই নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। এই অবস্থাতেও শিক্ষক ও শিক্ষকতার প্রকৃত স্বরূপ বিভূতিভূষণ উপস্থাপন করেছেন এই উপন্যাসটিতে। উপন্যাসটির বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সঙ্গে করোনাকালের প্রসঙ্গ টানাই যায়। ৫ই সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবসের’ পটভূমিতে চারপাশে তাকিয়ে বহু শিক্ষকের কথাই মনে পড়ে।
‘অনুবর্তন’ উপন্যাসের নায়ক একজন শিক্ষক এবং যুদ্ধের পরিস্থিতিগত কারণে যথারীতি পেশাগত বিপদে। যেমনটি বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে বহু শিক্ষক এখন রয়েছেন। তখনকার পরিস্থিতি অনেকটা বর্তমান মতোই। উপন্যাসের শুরুতেই, কলকাতায় রাতের বেলায় ‘ব্ল্যাকআউট’ চলছে। জাপানি বোমার ভয়ে ব্রিটিশ সৈন্য অস্থির। আতঙ্কিত কলকাতার সাধারণ লোক। তারা দলেদলে প্রাণভয়ে পালাচ্ছে গ্রামাঞ্চলে। বিপন্ন জীবনের বিন্যাসে ছোটোখাটো স্কুল টিকিয়ে রাখা দায়৷ ছাত্রসংখ্যা নগণ্য। চারিদিকে সংকট। নিজেদের চাকরি রাখতে শিক্ষকরা এমন পরিস্থিতিতে ছাত্রসংখ্যা বাড়াতে এগিয়ে আসেন। শিক্ষকতার পর টিউশনিও করেন। নইলে সংসার চলে না। বিরূপতায় ভরা পরিস্থিতিতে একই সঙ্গে অর্থলোভী এবং ছাত্র প্রেমিক শিক্ষকদের ছবি এঁকেছেন বিভূতিভূষণ।
উপন্যাসে কঠোর কর্তব্যপরায়ণ রাজভক্ত হেডমাস্টার ক্লার্কওয়েল, ছাত্রপ্রেমিক নারায়ণবাবু, উঞ্ছবৃত্তি পরায়ণ দরিদ্র শিক্ষক যদুবাবু, কুচক্রী অ্যাসিস্টান্ট হেডমাস্টার, ক্লাসের শিক্ষিকা সিম্পসন। ‘অনুবর্তন’ উপন্যাস যেন এরকম নানা ধরনের চরিত্রের বর্ণিল চিত্রশালা। উল্লেখ্য, বাস্তবে এখানেই শিক্ষকতা করেছেন বিভূতিভূষণ স্বয়ং। পেশায় স্কুল শিক্ষক বিভূতিভূষণ এর আগে হরিনাভিতে প্রথম শিক্ষকতা শুরু করেন। এ সময় শিক্ষকতা পেশার উত্থান-পতনের দিকগুলোও সামনে চলে আসে। অথচ প্রবল দারিদ্র্য সহ্য করে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন জনপ্রিয় শিক্ষক ও সফল ভারতীয়-বাঙালি কথাসাহিত্যিক।
তবে শিক্ষকতার পেশায় না থেকে শিক্ষকদের নিয়ে লিখেছেন অনেকেই। তেমনই উল্লেখযোগ্য দুটি উপন্যাস গজেন্দ্রকুমার মিত্রের ‘রাত্রির তপস্যা’ ও ‘জন্মেছি এই দেশে’। গজেন্দ্রকুমার মিত্র ছিলেন একজন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক, প্রকাশক ও অনুবাদক। রবীন্দ্র-শরৎ উত্তর বাংলা সাহিত্যে বিভূতিভূষণ-তারাশঙ্করের পর বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজকে উপজীব্য করে যে সকল কথাসাহিত্যিক সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। সামাজিক উপন্যাস, পৌরানিক উপন্যাস, ঐতিহাসিক উপন্যাস, ছোট গল্প, কিশোর সাহিত্য সর্বত্র ছিলো তার অবাধ গতি। সুদীর্ঘ ষাট বছরের অধিককাল ধরে তার কয়েক হাজার ছোটগল্প ও পঞ্চাশটিরও বেশি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।
গজেন্দ্রকুমারের ‘রাত্রির তপস্যা’ -এর নায়ক ভূপেন মেধাবী ছাত্র। ঘটনাচক্রে সে এক ধনী ব্যক্তির কন্যার গৃহশিক্ষক হয়। ছাত্রী সন্ধ্যার শিক্ষক-ভক্তি কখন যে প্রেমে রূপান্তরিত হল তারা কেউই বুঝতে পারে নি। এদিকে ভূপেন সংসারের কঠোর প্রয়োজনে শিক্ষক বৃত্তির চাকুরি বেছে নিল। যদিও পিতার ইচ্ছা ছিল, তার পরিচিত কোনো বিলাতি সওদাগরি অফিসে চাকুরি নেয় পুত্র। শিক্ষক জীবনের দারিদ্র্য, উঞ্ছবৃত্তি আবার সেই সঙ্গে কর্তব্যপরায়ণতা সবই ভূপেন অর্জন করল তার শিক্ষক জীবনে। কিন্তু সে নিজ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হল না। তার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই সে গড়ে তুলল নিজের জীবন। শক্ত করে ভিত্তি গড়ল নিজের পৈতৃক পরিবারের। বিচিত্র পরিস্থিতিতে সে বিয়ে করতে বাধ্য হল সতীর্থ বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকের কন্যাকে। আবার কখন যে তার প্রথম ছাত্রী সন্ধ্যা, যার গৃহশিক্ষকতায় তার প্রথম শিক্ষক জীবন শুরু, তাকে ভালোবেসেছিল, বিচিত্র পরিস্থিতিতে ভূপেন তার মাথায় সিঁদুর পরিয়ে দিল -এমনই মধুর পরিবেশে হয়েছে উপন্যাসের সমাপ্তি। ‘জন্মেছি এই দেশে’ আদর্শ পরায়ণ শিক্ষক এবং একই সঙ্গে সুযোগ সন্ধানী উঞ্ছবৃত্তি পরায়ণ শিক্ষকদের জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাস। শেষ পর্যন্ত আদর্শর জয়লাভ ও দরিদ্র শিক্ষকদের জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাস। শেষ পর্যন্ত আদর্শের জয়লাভ ও দরিদ্র শিক্ষকের আত্মত্যাগ এই উপন্যাসের মূল প্রতিবেদন।
উপন্যাসগুলোর আলোচনাকালে মনে রাখতে হবে, এসবের সময়কাল ঔপনিবেশিক অবিভক্ত বাংলা। তখন শিক্ষকদের জীবন এখনকার মতো সচ্ছল ছিল না। কিন্তু শিক্ষকতার পেশাগত সংকটের অনেকগুলো দিকই বর্তমানেও দৃশ্যমান। দুঃখের বিষয় হলো, অতীতের সংকটগুলো কথাসাহিত্যে যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে, বর্তমান বাস্তবতার চিত্রগুলো সেভাবে উদ্ভাসিত হয়নি। যদিও তখনকার মতো এখনও বহু সাহিত্যিকই পেশাগত দিক থেকে শিক্ষক, সাহিত্যের চরিত্র রূপে শিক্ষক বহুলাংশে অচর্চিত।
শিক্ষক ও শিক্ষা সম্পর্কে স্মরণ করতে পারি রিচার্ড ফাইনম্যানকে। যিনি নোবেল পুরস্কারজয়ী বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাত। কিন্তু ফাইনম্যান নিজেকে শিক্ষক ভাবতেই পছন্দ করতেন। ‘ইফ ইউ ওয়ান্ট টু মাস্টার সামথিং, টিচ ইট’ -এ শুধুমাত্র তার বিখ্যাত উক্তিই নয়, মনেপ্রাণে কথাটা নিজের জীবনেও বিশ্বাস করতেন তিনি। তার মত ছিল, ছাত্রদের সঙ্গে অনবরত জ্ঞান আদানপ্রদানের মধ্য দিয়েই বিজ্ঞানী/শিক্ষক বেঁচে থাকেন।
ভাল শিক্ষক হতে গেলে যে আগে ভাল ছাত্র হতে হবে, অর্থাৎ বিষয়টা নিখুঁতভাবে বুঝতে হবে -এ ব্যাপারে ফাইনম্যানের নির্দেশ অত্যন্ত পরিষ্কার। তার মতে, কোনও বিষয়ের নাম জানাটা আদৌ জ্ঞান নয়, স্রেফ একটা তথ্য মাত্র। সেই তথ্য ব্যবহার করে যখন ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে কোনও ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যায়, তখনই তা জ্ঞানে উন্নীত হয় এবং বিষয়টাও ঠিকঠাক শেখা হয়ে ওঠে। কোনও বিষয় শেখানো মানেও শুধু কিছু তথ্য সরবরাহ করা নয়। বরং যাবতীয় কী, কেন, কীভাবের উত্তর খুঁজে পেতে সাহায্য করা।
ফাইনম্যানের মতে, কোনও বিষয় একজন ঠিকঠাক শিখেছেন কি না, সেটা বুঝে নেওয়ার উপায় হল বিষয়টা একেবারে সহজ করে কাউকে বোঝাতে পারা। বোঝানোর সময় কোনও প্রতিশব্দ ব্যবহার করা চলবে না। সমীকরণও নয়। কারণ প্রতিশব্দ হল স্রেফ নাম, জ্ঞান নয়। বিশেষ প্রতিশব্দ ছাড়া যদি বিষয়টার কোনও অংশ ব্যাখ্যা করতে অসুবিধে হয়, তা হলে বুঝতে হবে নিজের বোঝায় খামতি আছে।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। উনুনে বসানো হাঁড়ির পানি কী ভাবে গরম হয়, সেটা বোঝাতে গিয়ে আমরা যদি বলি তাপের পরিচলন বা ‘কনভেকশন’ পদ্ধতি দায়ী, তা হলে শুধু পদ্ধতিটার নাম জানা হবে। প্রক্রিয়াটা কী? একটি ধাতব দণ্ড গরম হওয়ার পদ্ধতি পরিবহণ বা ‘কন্ডাকশন’ থেকে তা আলাদা কেন? এগুলো বোঝা প্রয়োজন। তা না হলে কেউ প্রশ্ন করলেও আমরা বার বার ওই পরিচলন-পরিবহণই বলে যাব।
কিন্তু প্রক্রিয়াটা বোঝা থাকলে বিভিন্ন ‘সাধারণ শব্দ’ ও উদাহরণের সাহায্যেই বিষয়টা সহজ করে বোঝানো যায়। ব্যাপারটা শুধু বিজ্ঞান নয়, যে কোনও বিষয়ের ক্ষেত্রেই সত্যি। যেমন, একটা ছবির বা গল্পের বা কবিতার বৈশিষ্ট্য বোঝাতে গিয়ে বিমূর্ত বা ‘অ্যাবস্ট্র্যাক্ট’ কিংবা ‘মরৃডান’ বা পোস্টমর্ডান’ বললে চলবে না, কারণ সেটা শুধুমাত্র একটা বৈশিষ্ট্যের নাম। যে লক্ষণগুলো তাকে বিমূর্ত, মূর্ত, আধুনিক কিংবা উত্তরাধুনিক করে তুলছে, সেগুলো বুঝিয়ে বলতে হবে।
প্রসঙ্গত চলে আসে শিক্ষা, বিজ্ঞান, জ্ঞানের সঙ্গে সংস্কৃতি ও জীবনবোধের সম্পর্ক। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক বৈশ্বিক মহামারি করোনার কথা। গত এক- দেড় বছরে তথাকথিত বহু শিক্ষিত মানুষের মুখে ‘করোনা এসে দেখিয়ে দিল বিজ্ঞান আসলে কিছুই পারে না’ -ধরনের কথা শোনা গেছে। এই কথা থেকেই বোঝা যায় বিজ্ঞান আদৌ আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে ওঠেনি, শুধুমাত্র আমাদের কিছু পারা না পারার হাতিয়ার হয়ে রয়ে গেছে।
কেন পারে নি? কারণ, আমরা কোনও জ্ঞানকেই আমাদের জীবনের ও সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুলতে পারিনি। আমাদের শেখা এবং পরবর্তী কালে শেখানো জুড়ে শুধুই একগুচ্ছ তথ্য। ফলে প্রথাগত লেখাপড়া শিখেও আমরা অনেক ক্ষেত্রেই কিছু তথ্য জানলেও বিষয়টি জানতে-বুঝতে এবং জীবনে বা জগৎ-সংসারে কাজে লাগাতে মোটেও পারছি না। এই ধারাবাহিক ‘না-পারা’ আমাদের এমন এক ‘শিক্ষা’, যার অপর নাম ‘অজ্ঞতা’, যা গভীরভাবে আমাদের ললাটে লেপ্টে আছে এবং এই দুর্বহ ‘শিক্ষা’ থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে ‘প্রকৃত শিক্ষিত’ হওয়ার বিষয়টি সুদূরপরাহত হয়েই রয়েছে।
লেখক: উন্নয়নকর্মী ও গবেষক
সারাবাংলা/এসবিডিআই