শেখ ফজলুল হক মণির রাজনৈতিক চিন্তা-দর্শন
১১ নভেম্বর ২০২১ ১৭:৪০
আমরা অনেকেই জানি বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি তার সব লেখায় সমাজ, প্রশাসন, সরকার পরিচালনা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রেখেও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, পুরনো আমলাতন্ত্র ইত্যাদি ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা পরিস্ফুট হয়েছে। কিন্তু সে কাজটি হয়নি বলেই দেশ ও সমাজে দ্রুত সংকট নেমে এসেছিল যা নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে শেখ মণির আশঙ্কাই পরবর্তী সময়ে সঠিক ও সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। শেখ মণির সময়ে তার মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা খুব কমই ছিল।
শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাংবাদিক, কলাম লেখক, ছোট গল্পকার, তাত্ত্বিক দার্শনিক ও ভবিষ্যৎ স্বপ্নদ্রষ্টা।
বাংলাদেশের পললভূমিতে শেখ ফজলুল হক মনি ১৯৩৯ সালের ৪ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ঐতিহাসিক শেখ পরিবারে জন্ম নেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেজ বোন শেখ আছিয়া বেগমের বড় ছেলে, বঙ্গবন্ধুর আদরের ভাগ্নে। তার বাবা শেখ নূরুল হক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নীপতি।
ছাত্র অবস্থাতেই শেখ মনি মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তিনি ঢাকা নবকুমার ইনস্টিটিউট থেকে মাধ্যমিক ও জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর ১৯৬০ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬২ সালে ড. আলীম আল রাজী কলেজ থেকে তিনি আইনের উপর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাশ করেন।
মাত্র ৩৫ বছর বয়সের ক্ষণজন্মা শেখ মনি ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান, দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, কবি ও ছোট গল্পকার।
শেখ ফজলুল হক মনি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সব থেকে প্রিয় রাজনৈতিক শিষ্য। তার রাজনৈতিক জীবন ছিল সরাসরি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় পরিচালিত। বঙ্গবন্ধু তাকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে অনেক ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধু ও শেখ মনির সম্পর্ক শুধু রক্তের বন্ধন দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না। সেই সম্পর্ক ছিল অন্তরাত্মার। ঘাতকরা জানত বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করতে হলে শেখ মনিকে আগে আঘাত করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু তার ভাগ্নেকে রক্ষা করতে পারেননি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মনি তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী শেখ আরজু মনিসহ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হলেন।
শেখ ফজলুল হক মণির চারিত্রিক দৃঢ়তা, গভীর অধ্যয়ন, আগ্রহ ও পরিশ্রম শাণিত করেছিল তার অন্তর্দৃষ্টিকে। দেশ স্বাধীনের পর বিভিন্ন সংকট তাকে শঙ্কিত করেছিল। সদ্য স্বাধীন একটি দেশের জন্য বঙ্গবন্ধু রাত দিন পরিশ্রম করছিলেন। প্রতিক্রিয়াশীল ও স্বার্থবাদী শ্রেণীরা সর্বদিক দিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছিল। দূরদর্শী রাজনীতিবিদ শেখ মণি কে কি করতেন সবকিছু জানতেন। বারবারই তিনি বঙ্গবন্ধুর জীবন সংশয়ের ব্যাপারটি ভাবছিলেন। তার শঙ্কার কথা বাংলার বাণীতে লিখলেন, “আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। আমাদের জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভাবনা-চিন্তা আমাদের সাধের বাংলাদেশটিকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবন্ধুর জীবন আমাদের আমাদের মতো একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সমস্যাসঙ্কুল দেশের মানুষের জন্য অশেষ মূল্যবান। চীন, রাশিয়া, আমেরিকার জনগণের দৃষ্টিতে সেখানকার নেতাদের জীবনের চেয়েও মূল্যবান। মাও সে-তুং না থাকলে, নিক্সন না থাকলে বা ব্রেজনেভ, কোসিগিন না থাকলে সেখানে আজ আর সমস্যা হবে না। কারণ সেখানকার সমাজ আজ একটা পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। তাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য সড়ক নির্মাণ হয়ে গেছে। আমরা কেবল শুরু করেছি। আবর্জনা সাফ করে আমাদের যাত্রাপথ তৈরি হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন সেই পথপ্রদর্শনকারী। খোদা না করেন, তাকে যদি আমরা হারাই, তাহলে বাংলার এই সাড়ে সাত কোটি দুঃখী মানুষের ভাগ্যে কি আছে! সুতরাং জাতীয় স্বার্থেই তার জীবনের জন্য যে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে তার চেয়ে শতগুণ কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার….।” (‘ন্যাপের বাহনটির এই আচরণ কেন?’ বাংলার বাণী, ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭২)
স্বাধীনতা পরবর্তী ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ ভাবনায় শেখ মণি কাতর হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি সতর্ক করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে অত্যধিক বিশ্বাস করতেন। নিজের আতঙ্কের কথা তিনি জনসমক্ষে প্রকাশ করলেন। আর তার আতঙ্কের কারণও ব্যাখ্যা করলেন। বঙ্গবন্ধুর সর্বজনের প্রতি বিশ্বাসের ভিত টলাতে না পেরে শেখ মণি ‘বাংলার বাণী’তে (১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২) লিখেছিলেন- “‘বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ারই একটি রাষ্ট্র। মানুষ এখানে দরিদ্র। মধ্যবিত্তের উচ্চাভিলাষ এখানে অপরিমিত, স্বাধীনতার শত্রুরা এখানে তৎপর, পুরাতন আমলারা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রে পুনর্বাসিত। সুতরাং সময় থাকতে রোগ ধরা না গেলে দাওয়াইটিও কেউ খুঁজবে না এবং একজন সংবাদপত্রসেবী হিসেবে সে দায়িত্ব আমাদেরই।’
এ উদ্ধৃতির আক্ষরিক বাস্তবতা আমরা ’৭৫ পরবর্তী কালে দেখেছি।
শেখ ফজলুল হক মনি নামটি শুনলে আমাদের সামনে একজন যুবনেতার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। কিন্তু তিনি তার জীবনের সোনালী সময় ছাত্র রাজনীতি, কিছু ক্ষেত্রে শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
মামা বঙ্গবন্ধু ছিলেন তুখোড় ছাত্রনেতা, যুবনেতা ও আওয়ামী লীগ নেতা। তাই ছোটবেলা থেকেই শেখ মনির আদর্শ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। শেখ মনি বঙ্গবন্ধুকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তার চোখের ভাষা সহজেই বুঝতে পারতেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই শেখ মনি রাজনীতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু এ কারণেই ভাগ্নেকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন।
ছাত্রজীবন থেকেই শেখ মনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছাত্র রাজনীতি করার সময়ে তিনি ছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রাণের স্পন্দন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে তিনি বারংবার অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন।
ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি শুরু করেন শেখ মনি। তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের কারণে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। আইয়ুব-মোনায়েম খান তাকে ব্যক্তিগতভাবে অন্যতম বড় শত্রু বিবেচনা করতেন।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের ফলে রাজনীতিতে বড় ধরনের আঘাত আসে। অর্থাৎ, ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল এই তিন বছরের মধ্যে আড়াই বছরই প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। আর এ সময় গোপনে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালু রেখে ছাত্র ইউনিয়ন অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। তাই দলকে শক্তিশালী করতে গোপন রাজনীতির বিকল্প ছিল না।
শেখ মনির প্রধান কাজ হয়ে পড়ল ছাত্রলীগকে পুনরুজ্জীবিত করা। যেহেতু রাজনীতি সংকটে, তাই শেখ মনি ছাত্রলীগকে ভিন্ন নামে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন।
শেখ ফজলুল হক মনি শিল্প ও সাহিত্য সংঘের আড়ালে ছাত্রলীগকে পুনরুজ্জীবিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এভাবে তিনি একটি বাহিনী গঠন করলেন এবং এই বাহিনীকে তিনি ছাত্রলীগ কর্মী আখ্যায়িত করতেন; যাকে পরে সিরাজুল-রাজ্জাক সাহেবরা ‘নিউক্লিয়াস ‘ নাম দিয়েছিলেন। বাস্তবতা এই যে, শুরুটা শেখ মনির হাত দিয়ে হয়েছিল।
নিউক্লিয়াস ছিল পাঁচ বা দশ সদস্যের বিশেষ কর্মী দল, যারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা কামনা করে। সঙ্গত কারণে প্রায় সব ছাত্রলীগ কর্মীই এ মনোভাব পোষণ করতেন। শেখ মনি বলতেন, তারা তাদেরই ছাত্রলীগে নিতেন; যারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং দেশের স্বাধীনতা কামনা করত।
শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন মেধাবী ও সাহসী। সেই সময়ের বক্র রাজনীতির মধ্যেও তিনি আইয়ুব খানের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন ভাগ্নে হিসেবে নয়, ষাটের দশকের গোঁড়া থেকেই শেখ ফজলুল হক মনি নিজের মেধা ও অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা বলে দেশের ছাত্র ও যুব সমাজের কাছে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তিনি গ্রেফতার হন এবং ছয় মাস কারাভোগ করেন।
উত্তাল সেই আন্দোলন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা স্মৃতি কথায় বলেন, “মনে পড়ে ১৯৬২ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। মনি ভাই এই বাড়ি থেকে নির্দেশ নিয়ে যেতেন, পরামর্শ নিতেন। ১৯৬২ সালে আব্বা গ্রেফতার হন। তখনকার কথা মনে পড়ে খুব।”
ষাটের দশকের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি আন্দোলনে শেখ মনি ভূমিকা রেখেছেন। বাংলার কুলাঙ্গার মোনায়েম খানের হাত থেকে সার্টিফিকেট না নেওয়ার আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
১৯৬৪ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আবদুল মোনায়েম খানের নিকট থেকে সনদপত্র গ্রহণে তিনি অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সমাবর্তন বর্জন আন্দোলন শুরু করেন।
যারা মোনায়েমের হাত থেকে উপাধিপত্র নেওয়ার জন্য সভাস্থলে হাজির হয়েছিলেন, তারা উল্টো শেখ মনির নেতৃত্বে সভাস্থল বয়কট করেন এবং মোনায়েম খানকে প্রকাশ্যে বর্জন করেন; উপাধিপত্র না নিয়েই তারা ফিরে যান। এই আন্দোলন ব্যাপক রূপ ধারণ করে। প্রবল ছাত্র বিক্ষোভে সমাবর্তন পণ্ড যায়। ক্ষুব্ধ সরকার প্রতিশোধ নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত ছাত্রকে গ্রেফতার করে। প্রায় দেড়শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে মোনায়েম খান ক্ষমতার দম্ভ দেখান।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার ডিগ্রি প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তী সময়ে তিনি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে জয়লাভ করে ডিগ্রি ফিরে পান। ১৯৬৫ সালে তিনি পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন এবং দেড় বছর কারাভোগ করেন।
শেখ মনির রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বড় কৃতিত্ব ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফার পক্ষে হরতাল সফল করে তোলা। ১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ছয় দফার পক্ষে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন দেশব্যাপী হরতাল ডাকা হয়। জনমত আদায় ও আন্দোলন কর্মসূচির অংশ হিসেবে ‘আমাদের বাঁচার দাবি-ছয় দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক পুস্তিকাও প্রণীত হয়। তখন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী-আব্দুর রাজ্জাক। শেখ মনি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের পথসভা ও গেইটসভা করতে বললেন এবং সমস্ত ঢাকাকে ১১টি ভাগে ভাগ করে দায়িত্ব বণ্টন করে দিলেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে মুনিরুল ইসলাম, আলী আহমেদ (চুনকা), গোলাম মূর্শীদ (এসসিএ), আনসার সাহেব, চকবাজারের রিয়াজুদ্দিন ও নাজিরা বাজারের সুলতান সাহেব, ফজলুর রহমান, নিজাম সাহেব পুরাতন ঢাকার। নতুন ঢাকার কর্মীদের পরিচালনার জন্য আনোয়ার চৌধুরী, ময়েজউদ্দিন আহমেদ, নুরুল ইসলাম। মিসেস আমেনা বেগম ও গাজী গোলাম মোস্তফাকে সবকিছু দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিলেন। ছাত্রদের ১১টা গ্রুপের সার্বিক নেতৃত্বের ভার দিলেন মিজান চৌধুরীকে। তেজগাঁও, আদমজী পোস্তগোলাসহ শ্রমিকদের তিনি সংগঠিত করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু তখন জেলে। ৭ জুন হরতাল সফল না হলে ছয় দফা ইস্যুটি মুখ থুবড়ে পড়বে। রাতদিন পরিশ্রম করেও রাজনৈতিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর সমর্থন পেলেন না শেখ মণি। শেখ মণি ১৯৭২ সালের ৭ জুন ‘ছেষট্টির সাত জুন: প্রস্তুতি পর্ব’ কলামে উল্লেখ করেছেন,“আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, শ্রমিক সংগঠনের উপর নির্ভর না করে সরাসরি শ্রমিকদের সাথে যোগাযোগ করাই শ্রেয়। তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাদের দুয়ারে ধর্না না দিয়ে সরাসরি জনতার সাথে সংযোগ স্থাপন করাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ।” কারণ তিনি জানতেন, সাধারণ শ্রমিকরা শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য জানমাল কোরবান করতে প্রস্তুত। উল্লিখিত কলামে তিনি প্রস্তুতি সম্পর্কে বলেছেন,“মানিক মামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি বললেন, ইত্তেফাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও তিনি পিছপা হবেন না। শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য তিনি সবকিছু করবেন। তিনি আরও আশ্বাস দিলেন যে, হরতালের কর্মসূচি যাতে করে সব কাগজে ছাপা হয় তার জন্য তিনি প্রভাব বিস্তার করবেন।”
বঙ্গবন্ধু জেলে থাকলেও তার বিশ্বাস ছিল একমাত্র তার মণি-ই হরতাল সফল করে তুলবেন। বঙ্গবন্ধু সেভাবেই তাকে প্রস্তুত করেছিলেন। শেখ মণি বলেছেন, “…জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু জানতে চেয়েছেন হরতালের প্রস্তুতি কতদূর কী হলো সেটি সম্পর্কে। গভীর রাতে পেছনের দেওয়াল টপকিয়ে ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গেলাম। মামিকে বিস্তারিতভাবে সবকিছু জানিয়ে বললাম রাতের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য। হরতাল হবেই।” (‘ছেষট্টির সাত জুন: প্রস্তুতি পর্ব’, দূরবীনে দূরদর্শী)
বলা বাহুল্য, জাতির পিতার ছয় দফা ছিল বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মজুর, মধ্যবিত্ত তথা গোটা বাঙালির মুক্তির সনদ। বাঙালি জাতির স্বকীয় মহিমায় আত্মপ্রকাশ আর আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের চাবিকাঠি ‘ছয় দফা’। শোষকের হাত থেকে শোষিতের অধিকার ছিনিয়ে আনারও হাতিয়ার। ছয় দফার উপর ভিত্তি করেই আমরা আমাদের স্বাধীনতা নামক লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলাম।
ওই হরতালে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ কমপক্ষে ১১ জন বাঙালি শহিদ হয়েছেন। ইতিহাসবিদরা বলেন, ৭ জুনের হরতাল সফল না হলে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম পিছিয়ে যেত। ৭ জুনের হরতাল সফল করতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকদের সংগঠিত করেছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। ফলে ১৯৬৮ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া হলেও শেখ মণিকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ছয় দফা প্রস্তাব জনগণের সামনে পেশ করার পর থেকে সরকার আমার ওপর অত্যাচার চালাইয়া যাচ্ছে। …আমার ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণি ও আরও অনেকে ১৯৬৬ সাল থেকে জেলে আছে এবং সবার বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে।’ (‘কারাগারের রোজনামচা’)
তিনি যেহেতু ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করছিলেন; সেই সঙ্গে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকদের হরতালের পক্ষে তিনিই সংগঠিত করেছিলেন। এই হরতাল সফল না হলে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম হয়ত পিছিয়ে যেত। সচেতন ছাত্রসমাজের নেতৃত্বাধীন ভাষা আন্দোলনের পর ছয় দফা আন্দোলনই ছিল পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালির প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলন, যে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন পূর্ববাংলার মেহনতি জনগণ ও শ্রমিক সমাজ।
১৯৬৬ সালে ছয়দফা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়ে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয় এবং মোনায়েম খান শেখ মনিকে কারারুদ্ধ করেন। এ সময় বিভিন্ন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা দায়ের করা হয়।তিনি মুক্তি পান ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর।
তিনি ছিলেন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনমুখী কর্মসূচির অন্যতম প্রণেতা। ছয় দফার ওপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই নির্বাচন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের অন্যতম কারিগরও বলা হয় শেখ মণিকে। নির্বাচনের ইশতেহার ও কর্মসূচিতে ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনসহ বাঙালির অধিকার বাস্তবায়নের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তিনি। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী শেখ মনি, সত্তরের নির্বাচনী কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেন, পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশকে ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন, ব্যাংক-বিমা ও ভারী শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য, পাট ও তুলা ব্যবসা জাতীয়করণ, পূর্ব পাকিস্তানের জায়গিরদারি, জমিদারি ও সর্দারি প্রথার উচ্ছেদ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের ভারী শিল্পের শতকরা ২৫ ভাগ শেয়ার ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি। (স্মরণীয়-বরণীয়, ব্যক্তিত্ব, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-পৃ: ৪৬১)।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শেখ ফজলুল হক মনির উদ্যোগে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্যতম প্রধান গেরিলা বাহিনী মুজিব বাহিনী শেখ মণির নির্দেশে ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গঠিত এবং পরিচালিত হয়। বিশ শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মুজিব বাহিনী গঠনের ধারণার উন্মেষ ঘটে বলে ধারণা করা হয়। সে সময় কতিপয় জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে এটি একটি একাডেমিক চিন্তা হিসেবে লালিত হত। মুজিব বাহিনীর অগ্রণী সংগঠকরাই এক সময় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন এবং তারাই ছিলেন ১৯৬৯ সালের এগারো দফা কর্মসূচির প্রবক্তা। তারা ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন, ১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনা করেন, ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধের পথে সার্বিক প্রস্তুতি সংগঠিত করেন।
মুজিব বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত একটি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী। আওয়ামী লীগ ও এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে এ বাহিনী গঠন করা হয়। প্রায় পাঁচ হাজার সদস্যের এ বাহিনীকে চারটি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং এর নেতৃত্বে ছিল ১৯ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমান্ড। প্রথমদিকে সেক্টর কমান্ডাররা ভারতের ব্যারাকপুর, শিলিগুড়ি, আগরতলা ও মেঘালয় থেকে নিজ নিজ বাহিনী পরিচালনা করতেন। এ বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডার ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান ও আব্দুর রাজ্জাক। শেখ ফজলুল হক মনি মুজিব বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল উবানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দেরাদুন পাহাড়ি এলাকায় এ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুজিববাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য ছিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি স্বাধীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা; যা মুজিববাদের অন্যতম লক্ষ্য। ধারণা করা হয় মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে সম্ভাব্য বিকল্প নেতৃত্বের প্রয়োজন মোকাবেলার জন্য মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়েছিল।
যুদ্ধক্ষেত্রে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে মুজিব বাহিনী যুদ্ধ করেছে। তারা দখলদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গন এবং ঢাকার আশেপাশে বেশ কিছু দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে। মুজিব বাহিনীর সদস্যরা গেরিলা রণকৌশল বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ছিল এবং তারা ছিল তুলনামূলকভাবে উন্নত অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত। স্বাধীন-সার্বভৌম লাল সবুজের পতাকা খচিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এই মুজিব বাহিনীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অনস্বীকার্য।
আগেই আমি উল্লেখ করেছি, শেখ মনি ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ নিউক্লিয়াস বাহিনীর পরিকল্পক ছিলেন, তেমনি ১৯৭১ সালের সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিব বাহিনী গঠনের অন্যতম প্রণেতা ছিলেন। এই ভূমিকা নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও আজ বুঝতে পারি, কেন শেখ মনি মুজিব বাহিনী গঠন করে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
সহজেই বিষয়টি অনুমান করা যায়, যদি সেই সময়ের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করি। পাকিস্তানের শাসকরা তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, বিশেষ করে বাঙালিদের অধিকার বঞ্চিত করার জন্য ধর্মীয় বিভেদ উস্কে দিয়েছে। ১৯৭১ সালের গণহত্যা তাদের কাছে ছিল ‘হিন্দুদের নির্মূল অভিযান’। আওয়ামী লীগ যেহেতু ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি অধিকারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়, তাই আওয়ামী লীগকেও নিশ্চিহ্ন করতে হবে। এটাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় মুজিব বাহিনী গঠনের প্রয়োজন ছিল অনেক বেশি।
দেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের জন্য গোটা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা রাখেন শেখ মনি।
মুজিব বাহিনী গঠনের পাশাপাশি শেখ মনি প্রকাশ করেন ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকা। এ পত্রিকায় তিনি নিজে লিখতেন। থাকত রণাঙ্গনের খবর। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলার বাণী দৈনিক পত্রিকা হিসেবে তার সম্পাদনায় আত্মপ্রকাশ করে।
শেখ মনি ছিলেন যেমন মাঠের নেতা, তেমনি ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা ধারণকারীও। প্রতিটি কথা ও কাজকে তিনি যুক্তি তর্কের মাধ্যমে জবাব দিতেন। আব্দুল গাফফার চৌধুরী সম্পর্কে বলেন, “দোহাই গাফফার ভাই গোস্বা করবেন না। আপনার নিবন্ধে আপনি বাংলার বাণীর হিম্মতের কথাটি তুলেছেন। এটা যদি কমপ্লিমেন্ট হয়ে থাকে তাহলে আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আর যদি এটা খোঁচা মারার জন্য আপনি লিখে থাকেন তবে আমি বিনয়ের সাথে বলছি, আমার অবস্থা আপনার থেকে কোনক্রমেই সুবিধাজনক নয়। আপনার যোগ্যতা আছে, মেধা আছে, আছে অভিজ্ঞতা এবং পেশার ব্যাপারে সুনাম। একটা গেলে আর একটা পেয়ে যাবেন। আর ঐ একই একই কাজ করে আমাকে হারাতে হবে জাত। একবার হারালে আর ফিরে পাবো না। জানেনইতো আমার শত্রু সংখ্যা এদেশে আপনার চাইতে অনেক বেশি।” (২৭ এপ্রিল, ১৯৭৩ বাংলার বাণী)
স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনি আওয়ামী যুবলীগ গঠন করেন। এ সময়ে তার বয়স ছিল ৩২ বছর। একই সময়ে পত্রিকার সম্পাদনার কাজ চালিয়ে যান। শ্রমিক আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট থাকেন। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য তিনি। দক্ষ সংগঠক, পরিশ্রমী, সাহসী ও উদ্যমী। কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতার আশেপাশেও নেই। মন্ত্রী-এমপি হতে পারতেন সহজেই। তিনি এ পথে চললেন না। শেখ মনি ছাত্র নেতা, শ্রমিক নেতা, যুবনেতা, মুক্তিযোদ্ধা সর্বোপরি মাঠের নেতা ছিলেন বলেই আত্মবিশ্বাসটা অনেক বেশি ছিল। এ কারণে এনায়েত উল্লাহ খানকে বলতে পেরেছেন, “শেখ মনিরা জীবন বাজী রেখে মোনায়েমের কারাগারে অশেষ নির্যাতন আর ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ভুঁইফোড় হিসেবে তাদের আবির্ভাব ঘটেনি। পরাজিত রাজনৈতিকদের গ্লানিও তাদের নেই। বাংলার বাণী বাংলাদেশে যদি আজ কোন সত্য আসন দখল করে থাকে তাহলে স্বাধীনতা সংগ্রামে তার বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্য, কারো পৃষ্ঠপোষকতার জন্য নয়। ভুলে যান কেন আপনারা যখন চায়ের কারবার করেছেন আমি তখন যুদ্ধ করেছি। আপনি যখন মোনায়েমের গুণ্ডার পার্টনারশিপ বাগিয়েছেন আমি তখন জেল খেটেছি। আপনি যখন তেল কোম্পানির নকর ছিলেন, আমি তখন আন্দোলন চালিয়েছি। আর আপনি যখন হামিদুল হক চৌধুরীর হেরেমে সাংবাদিকতার তালিম নিচ্ছিলেন, আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সামরিক শাসন বিরোধী সংগ্রাম শুরু করেছি।” ( ১৯৭৩ সালের ১ লা অক্টোবর বাংলার বাণী)
শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন বড় মাপের দার্শনিক। ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সমস্যা বের করেছিলেন। এ জন্যই তিনি বলেছিলেন – “রাজনৈতিক যুদ্ধে আমাদের পরাজিত করতে পারে এমন শক্তি বাংলাদেশে সহজেই জন্মাবে না। কিন্তু আমাদের সমাজনীতি, অর্থনীতি যদি ব্যর্থ হয়ে যায় তাহলে রাজনীতিটাই টিকবে না”।
টেকসই উন্নয়ন, এমনকি দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে যে প্রগাঢ় চিন্তা করতেন শেখ মনি- তার এই উদ্ধৃতি দ্বারা সহজেই বোধগম্য হয়।
শেখ ফজলুল হক মনি একটি নাম, একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সাথে সাথে বাঙালি সংস্কৃতির উপাসকও। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি চেয়েছিলেন স্বতন্ত্র একটি জগত গড়ে তুলতে। মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল যেন নিজস্বতা হারিয়ে না বসে। তার প্রতিষ্ঠিত দৈনিক বাংলার বাণী, বাংলাদেশ টাইমস এবং বিনোদন পত্রিকা সাপ্তাহিক সিনেমার সম্পাদক ছিলেন তিনি। বাংলার বাণী যেমন মুক্তিযুদ্ধের মুখপাত্র হয়ে উঠেছিল। আবার তার প্রতিষ্ঠিত সুস্থ বিনোদন ধর্মী সাপ্তাহিক ‘সিনেমা’ পত্রিকা বাঙালি সংস্কৃতির পরিশীলিত বুনিয়াদ নির্মাণে ভূমিকা রেখেছিল।
শেখ মনি মনেপ্রাণে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা গঠন করতে চেয়েছিলেন। শিশু কিশোরদের সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক বিকাশের লক্ষ্যে গড়ে তুলেন শাপলা কুঁড়ির আসরের মত প্রতিষ্ঠান।
শেখ মনি রচিত বেশ কিছু রাজনৈতিক উপন্যাস পাঠক সমাজে-সমাদৃত হয়েছে। একটি উপন্যাস অবলম্বনে ‘অবাঞ্ছিত’ নামে একটি জনপ্রিয় টেলিফিল্মও তৈরি হয়েছে। এছাড়া “গীতারায়” নামে গল্পগ্রন্থ বেশ জনপ্রিয় ছিল ।
শেখ ফজলুল হক মনি সংবাদ পত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। সংবাদপত্রকে তিনি সমাজের দর্পণ হিসেবে বিবেচনা করতেন। তিনি নতুন পত্রিকা বের করার পিছনে দুটো যুক্তি দেখান- (১) মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ও সঠিক ইতিহাস সংবাদপত্রের মাধ্যমে তুলে না ধরলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সুযোগ পেলেই আঘাত হানবে এবং বিভ্রান্ত করবে দেশের সাধারণ মানুষকে। (২) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে সাংবাদিকের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার পথ চিরতরে বন্ধ হবে। তখনকার বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে তার দুটো যুক্তিই ছিল অত্যন্ত সময় উপযোগী। (শেখ মনি – এম এ মুফাজ্জল, দৈনিক নিউ নেশন সম্পাদক)।
শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। তিনি এ পর্যন্ত যা সৃষ্টি করেছেন, সবই ছিল সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। সেই সঙ্গে তিনি সমসাময়িক প্রথিতযশা সাংবাদিকদের সাথে তুলনীয় ছিলেন। সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বলেন,
“সংবাদপত্রের মালিক অনেকেই হতে পারেন। টাকা থাকলেই হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে যেমনটা হচ্ছে।কিন্তু সাংবাদিকতা পেশার ব্যাক গ্রাউন্ড নিয়ে যারা এসেছেন তাদের সংখ্যা খুব কম। মাওলানা আকরাম খাঁ, তফাজ্জল হসেন মানিক মিয়ার নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় । শেখ ফজলুল হক মনি তাদেরই মত উদ্যোক্তা ছিলেন। যেহেতু তিনি নিজে সাংবাদিকতা করে সংবাদপত্র প্রকাশ করেছেন সেজন্য পেশার প্রতি ছিল তার ঐকান্তিক ভালবাসা। সংবাদপত্রকে তিনি শিল্প হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন।” ( সাংবাদিক মনি ভাই,রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ,দৈনিক ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রধান সম্পাদক)।
শেখ ফজলুল হক মনির উপস্থাপন ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তিনি সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় সব কিছু তুলে ধরতেন। অজস্র লেখায় নজির মেলে। ‘দূরবীনে দূরদর্শী’র লেখাগুলো পড়ে উপলব্ধি করা যায় শেখ মনির কলামে ছিল যথার্থ লেখকের ক্ষমতা। গদ্য শৈলীর প্রশ্নে বঙ্কিম চন্দ্রের মতো অনুপেক্ষণীয় গদ্যের বড়গুণ সরলতা এবং স্পষ্টতা। শেখ মনির কলামগুলোতে তার নিজস্ব মত সরল-সাবলীলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তার কথার সপক্ষে তথ্যের সন্নিবেশে কোনো ঘাটতি নেই। তিনি তাত্ত্বিকও ছিলেন। তত্ত্ব এসেছে অভিজ্ঞতা ও অধীত বিদ্যার উৎসমূল থেকে।
১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে সিরাজুল আলম খান, এম এ জলিল, আ স ম আব্দুর রব প্রমুখ যখন উগ্র স্লোগান তুলে জাসদ গঠন করেন, বঙ্গবন্ধু সরকারকে দুর্বল করে ফেলার দেশি-বিদেশি চক্রান্ত বাস্তবায়নে প্রধান ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন তখন শেখ ফজলুল হক মনি তাদের অন্যতম টার্গেটে পরিণত হন। ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে সাতজন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এ খুনি চক্র গ্রেপ্তার হয়, বিচারে শাস্তি হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা জবরদখল করার পর জিয়াউর রহমান তাদের মুক্ত করে দেন। ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে শফিউল আলম প্রধানের মিথ্যা-কুৎসাপূর্ণ আক্রমণের প্রধান টার্গেট ছিলেন শেখ মনি।
এসব অনেক কারণে শেখ ফজলুল হক মনি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী অস্থির যুবসমাজকে সৃজনশীল খাতে প্রবাহিত করতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র গণতন্ত্র, শোষণমুক্ত সমাজ অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়বিচার, জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা অর্থাৎ সকল ধর্মের মানুষের স্ব স্ব ধর্ম স্বাধীনভাবে পালনের অধিকার তথা জাতীয় চার মূলনীতিকে সামনে রেখে বেকারত্ব দূরীকরণ, দারিদ্র্য বিমাচেন, শিক্ষা সম্প্রসারণ, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলো এবং যুবসমাজের ন্যায্য অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নির্দেশে শেখ ফজলুল হক মনি বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে দেশের সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্য থেকে স্বাধীনতা ও প্রগতিকামী যুবক ও যুব মহিলাদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে একটি সুশৃঙ্খল সংগঠন গড়ে তোলাই ছিল যুবলীগের মাধ্যমে তার উদ্দেশ্য।
একাত্তর পূর্ববর্তী আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর এক নম্বর সিপাহসালার। তেমনি একাত্তর পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় শোষণহীন সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ’ও ফ্রন্ট ফাইটারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন স্বাধীনতা পরবর্তী যুব সমাজকে সৃজনশীল ও আদর্শ দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলতে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সে সময়ে কোন যুব সংগঠন ছিল না। অনেকটা সে কারণেই শেখ ফজলুল হক মনি শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসেন। ‘তলা বিহীন’ ঝুড়ি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া দেশটি গড়ে তুলতে হলে তরুণদের ভূমিকা নিতে হবে – যুবলীগ গঠনের পেছনে এটাই ছিল প্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শও ছড়িয়ে দিতে হবে।
বাংলাদেশ জন্ম নেয় বিপুল খাদ্য ঘাটতি নিয়ে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল শূন্য। শিল্প পণ্য আমদানি করতে দরকার ছিল প্রচুর অর্থ। জ্বালানি তেলের পুরোটাই আমদানি করতে হতো। কিন্তু তেলের দাম হু হু করে বাড়ছিল। স্বাধীনতা বিরোধীরা এসব প্রতিটি সমস্যার জন্য দায়ী করতে থাকে বঙ্গবন্ধুকে, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম গড়ে তোলা দল আওয়ামী লীগকে এবং বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী দেশ ভারতকে। এমনকি যুবলীগ – ছাত্রলীগকে এই নতুন অপশক্তিকে মোকাবেলা করতে হয়। এ কারণে তাদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়। শেখ মনির যুবলীগ সকল সমস্যা মোকাবেলা করছিল। শেখ মনি সব সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন যুবকদের মধ্যে কোনভাবেই যেন ভুল মেসেজ না যায়।
বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ শুরু থেকেই সকল বাধা চূর্ণ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনের জন্য যুবসমাজকে সংগঠিত করার দায়িত্ব পালনে যতœবান ছিল। তবে তাদের কাজে বিঘ্ন আসে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের তৎপরতায়। এ সংগঠনে যারা যোগ দিয়েছিল, তাদের একটি অংশ আসে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের মধ্য থেকে। তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। তবে এ দলে আরেক অংশ যুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির মধ্য থেকে। ক্রমে তারাই হয়ে ওঠে পরাক্রমশালী। যে সকল আলবদর ও রাজাকার এবং তাদের দল জামায়াতে ইসলামী – মুসলিম লীগের নেতা কর্মী স্বাধীনতার পর পালিয়ে ছিল, তারা জাসদ গঠিত হওয়ার পর আশার আলো দেখতে পায়। ভোল পাল্টে জাসদে ঢুকে পড়তে থাকে। তারা সহিংস পথ অনুসরণ করতে থাকে। নানা অপপ্রচারে মেতে থাকে।
শেখ মনি সকল বিষয়ের নেতিবাচক দিক অনুধাবন করেছিলেন। তিনি হয়ত ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুকে সাবধান করেছিলেন। উপায়ান্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত তিনি কলমও ধরেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫-এ জাতীয় ঐক্যের রাজনৈতিক দল বাকশাল গঠনের পর শেখ ফজলুল হক মনি বাকশালের অন্যতম সম্পাদক নির্বাচিত হন। জাতীয় যুবলীগের দায়িত্ব দেওয়া হয় তোফায়েল আহমদকে। নতুন ধারার আন্দোলন গড়ে তুলতে এ সংগঠন মনোযোগী হয়। কিন্তু ১৫ অগাস্টের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর যুবলীগ-ছাত্রলীগ সহ সকল সংগঠনকে ফের মনোযোগ দিতে হয় মিছিল-সমাবেশ-হরতালের মত কর্মসূচির প্রতি। পরের দুই দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুবলীগ থাকে সামনের সারিতে।
বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত স্নেহভাজন ভাগিনা হিসেবে নয়, ষাটের দশকের গোঁড়া থেকেই শেখ মণি নিজ প্রতিভা, মেধা-মনন ও সাংগঠনিক ক্ষমতাবলে দেশের ছাত্র-যুব সমাজের কাছে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন। পরবর্তীতে ‘৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখে এবং মুজিব বাহিনীর প্রধান হিসেবে তাঁর যোগ্যতার নজির স্থাপন করে দেশপ্রেমের উদাহরণ তুলে ধরেছিলেন। তিনি দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে ভাবতেন। বঙ্গবন্ধুর ভাবনাই তাঁর মধ্যে প্রোথিত হয়েছিল। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের ভঙ্গুর অবস্থা এবং পরবর্তীতে স্বার্থান্বেষী মহল দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তারই আগাম বার্তা দিয়েছিলেন বাংলার বাণী প্রকাশের শুরুর সংখ্যায়,“পাকিস্তানী বর্বর দখলদার সেনাধ্যক্ষরা দলিত লুণ্ঠিত মথিত বাংলাদেশে এমন কি পরিত্যক্ত সম্পত্তি রেখে গেছে যার থেকে আমাদের মধ্যবিত্ত লালসার জিহ্বা চেটে পুটে খেয়ে পুষ্টি সাধন করতে পারে। ….” (‘দেশের সাথে বাংলার বাণীর যাত্রা শুরু’- বাংলার বাণী)। বাস্তবতা হয়েছিল তাই, ‘৭৫ এর ১৫ আগস্টে ঘটে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম কালো অধ্যায়। পরবর্তী ২১ বছর স্বাধীনতা বিরোধীদের আস্ফালন ছিল চোখে পড়ার মত। দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সব সময় মধ্যবিত্তের সংগঠন। প্রতিটি কর্মীর এই আত্মপোলব্ধি যেমন থাকা প্রয়োজন, তেমনি নেতাদের সব সময় এই কঠিন সত্যটি মনে রাখা প্রয়োজন। এই বিষয়ের উপরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন শেখ মণি। আওয়ামী লীগ যদি পশ্চিম পাকিস্তানী বিত্তশালীদের সাথে মিশে যেত তাহলে চূড়ান্ত পরিণতি হতো মুসলিম লীগের মত। কারণ তখন আওয়ামী লীগ বাংলার কামার-কুমার-জেলে-চাষী-শ্রমিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। এ কারণেই শেখ মণি বলেছেন,“আওয়ামী লীগ যদি মধ্যবিত্তের দ্বারা না হয়ে উচ্চবিত্তের দ্বারা পরিচালিত হতো তাহলে সে কোনক্রমেই স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারতো না।” (‘প্রসঙ্গ: আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পরিবর্তন’- দূরবীনে দূরদর্শী)।
শেখ মণি স্বাধীনতা পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগকে মধ্যবিত্ত নির্ভর বললেও স্বাধীনতাত্তোর যে তা ধরে রাখা কঠিন তার উপরও গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন,“স্বাধীনতাত্তোর মধ্যবিত্ত কোনক্রমেই আর তার পূর্বের প্রগতিশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে না। … সেদিনকার বাঙালি মধ্যবিত্তের দুঃসহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তাকে সংগ্রাম মুখর করে তুলেছিল। তার সেদিনের সেই ভূমিকা ছিল অনেকটা বাধ্যতামূলক।” বাস্তবতা হয়েছিলও তাই। স্বাধীনতা পরবর্তী সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে স্বার্থকেন্দ্রিক বিষয় নিয়ে অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কারণ সবাই ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে চায়। সুযোগসুবিধা নিতে চায়। আর এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর জোর দিতে বলেছেন শেখ মণি। কারণ জনগণকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা কোন সাধারণ বিষয় নয়, এগুলো অঙ্গীকার। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে এই অঙ্গীকারের কারণেই সবাই একাত্মতা হতে পেরেছিল। সময়ের প্রয়োজনে এ কারণে সংগঠনের মৌলিক পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি।
শেখ ফজলুল হক মণি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তথা একটি রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার মতামত ব্যক্ত করেছেন। দল ও সরকারকে পৃথক সত্ত্বা হিসেবে দেখতে চান। তিনি বলেছেন,“দলের গণতান্ত্রিক বিধান মতে যারা মন্ত্রী পরিষদের সদস্য হয়েছে তাদের পক্ষে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা থাকা সম্ভব নয়, ….।” (‘প্রসঙ্গ: আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পরিবর্তন’- দূরবীনে দূরদর্শী)। তিনি দলের নেতৃত্বের পরিবর্তন থেকে কাঠামোগত পরিবর্তনের দিকে বেশি জোর দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর মত শেখ মণি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন এদেশের মানুষের মন থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর করে গণতন্ত্রমুখী করে জাতীয় অহংবোধ জাগরিত করা। ধর্মীয় ও সামন্ত সমাজব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধু এই কাজটি করেছিলেন ধীরে ধীরে।
দল ক্ষমতায় থাকলে কিছু মানুষের মধ্যে অতিরিক্ত অর্থ ও ক্ষমতার মোহ আকৃষ্ট করে। স্বাধীনতাত্তোরকালেও এমনটি হয়েছিল। এটা আওয়ামী লীগ ও দেশের জন্য যে ভাল লক্ষণ নয়, তা শেখ মণি স্পষ্টভাবেই ব্যক্ত করেছেন। কিছু কর্মীর অনৈতিক কর্মকা-ের দায় কেন আওয়ামী লীগ নেবে সেই বিষয়টি বার বার বলেছেন শেখ মণি। তিনি বলেছেন,“যে সর্বনাশা পরিবর্তনের ব্যাধি আজ আওয়ামী লীগের মধ্যে সঞ্চারিত হতে চলেছে, জনতাকে গড়ে তোলার পরিবর্তে নিজেকে গড়ে নেবার অশুভ মানসিকতা আমাদেরকে পেয়ে বসেছে, তাতে করে আমরা যেন নিজেরাই সআরোপিত জ্যান্ত কবরে ঢুকে পড়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে পড়েছি।” (‘প্রসঙ্গ: আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পরিবর্তন’- দূরবীনে দূরদর্শী)। আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি সব সময় এই আবেদনই করে গেছেন জাতির ও দলের ঘোর দুর্দিনে কোনক্রমেই বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তারা যেন তাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব থেকে বিস্মৃত না হয়।
আমরা মুজিববাদ বলতে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চারের নির্যাসকেই বুঝে থাকি। মুজিববাদের বীজ রোপিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ছয় দফায়। প্রসঙ্গক্রমে বলতে পারি, বঙ্গবন্ধু নিজেই বার বার বলেছেন, তিনি সমাজতন্ত্র তথা শোষণ বঞ্চনাহীন বাংলাদেশ দেখতে চান। একই সঙ্গে চান গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ। ধর্মনিরপেক্ষতাও অপরিহার্য। ১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “আগে স্লোগান ছিল ছয় দফা, এখন চারটি স্তম্ভ।” ৪ নভেম্বর ১৯৭২ জাতীয় সংসদে সংবিধান (গৃহীত) বিল অধিবেশনের ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুজিববাদের চার মূলনীতির প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্ট করেছেন। ১৯৭২ সালের সংবিধানে মুজিববাদের চার স্তম্ভ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতি হিসাবে গৃহীত হয়েছে। তবে মুজিববাদের চার মতবাদের মধ্যে শেখ মণি ধর্মনিরপেক্ষতাকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন,“জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজবাদ – এর কোনটাই সফল নয় ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থা ছাড়া। … ধর্মাশ্রিত জাতীয়তাবাদ মুখ্যত সাম্প্রদায়িকতা; গণতন্ত্র বস্তুতঃ সর্বশ্রেণীর সম্প্রদায় চেতনা নিরপেক্ষ, …।” ( ‘মুজিববাদ দর্শনে ও বাস্তবে’- ১২ এপ্রিল, ১৯৭২)। মুজিববাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ‘সোনার বাংলা’ কায়েম করা।
শেখ ফজলুল হক মণি স্বাধীনতার পর মুজিববাদের আলোকে ‘সোনার বাংলা’ গঠন করতে চেয়েছিলেন। মুজিববাদকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য তিনি বারংবার কলম ধরেছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা ধনতন্ত্রে ফিরে যেতে চাই না, আমরা চাই মুজিববাদী বাংলাদেশ। তাই মুজিববাদী বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনাকে কার্যকর করার জন্য নতুন আইনের শাসন দরকার, পুরনো আইনের ব্যাধির সংক্রমণ নয়। বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতার চাহিদা সেটাই। প্রগতিবাদী বাংলার জনতার সেটাই কামনা। তারা শেখ মুজিবের শাসন চায়, পুরাতন পুঁজিবাদী আইনের শাসনের পুনর্বহাল বা পুনর্বাসন নয়।” (‘মুজিবের শাসন চাই আইনের শাসন নয়’- দূরবীনে দূরদর্শী)
শেখ ফজলুল হক মনি বিশ্বাস করতেন, নতুন দেশ ও সমাজের চিন্তা করলে পরিকল্পিত কার্যপন্থার বিকল্প নেই। দক্ষ রাজনীতিবিদের একটু ভুলের কারণে ইতিহাসের কালো অধ্যায়ে নিক্ষিপ্ত হতে পারেন। সমসাময়িক বিশ্ব ও বৈশ্বিক রাজনীতির ওপর তার প্রগাঢ় জ্ঞান ছিল। তার লেখা প্রবন্ধ ‘বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লব আসবে’ পড়লেই বোঝা যায় বিশ্ব রাজনীতির সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপট। রুশ নেতা ক্রেনেস্কি জারের রাজাকে সরিয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন। তার কাছ থেকেই ক্ষমতা কেড়ে নিলেন লেনিন। অথচ রাশিয়ায় লেনিনের চেয়ে ক্রেনেস্কির জনপ্রিয়তা ছিল বেশি। তবুও যে সে সফল হলো তার প্রধান কারণ জারের শাসনের পর রাশিয়ার প্রশাসনযন্ত্রে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল ক্রেনেস্কি নিজের লোক দিয়ে সেটা পূরণ করার ফুরসত পাননি বা সুযোগ নেননি। পক্ষান্তরে লেনিন সেই শূন্যতার সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন নিজের সপক্ষে কমিউনিস্ট বিপ্লবের অনুকূলে। জার সরে গেল। সমাজবাদী (!) ক্রেনেস্কি বিতাড়িত হলো কিন্তু লেনিন বেঁচে রইল নতুন রাশিয়ার জন্মের মধ্য দিয়ে। ইতিহাসের পাতায়, বিশ্বের সমাজবাদী আন্দোলনের ধারা বিবরণীর ছত্রে ছত্রে তার নাম মুদ্রিত হলো, ‘মহান লেনিন’ হিসেবে।
শেখ মনি যেমন দার্শনিক ছিলেন, তেমনি ছিলেন ভবিষ্যৎ চিন্তক। তিনি অন্যান্য দেশের জাতীয় নেতাদের পতনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা মেসেজ দিতে চেয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও কেন ইন্দোনেশিয়ার নেতা ড. সুকর্ণের পতন হলো। ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ ক্ষমতায় এসেছিলেন বিপ্লবের পথ ধরে, যুদ্ধের পরে। তার দেশে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। সুকর্ণো কেবল নব্য ইন্দোনেশিয়ার জন্মদাতাই নন, তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বযুগের ইন্দোনেশীয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে সব চাইতে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, সব চাইতে চাকচিক্যময় মহাপুরুষ।
ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতিতে, জনতার মনে এবং বিশ্বের মনীষীদের দৃষ্টিতে তিনি এতটা শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন যে, অনেকে তার মধ্যে দৈবশক্তির, ঐশী প্রভাবের মহাত্মা আরোপে করতে দ্বিধাবোধ করেননি। অথচ সেই সুকর্ণো আজ হারিয়ে গেলেন ইতিহাসের পাতা থেকে। বিশ্ব নাট্যমঞ্চের সব চাইতে দুর্দমনীয় প্রতিভাবান নায়ক একদিন মঞ্চের উপর দুমড়ে পড়লেন আকস্মিক, অভাবিত মুহূর্তে। হতবাক বিশ্ব, বিস্ময়, বিমূঢ় ইন্দোনেশীয় জনগণ, অবাক বিস্ময়ে দেখল, সুকর্ণ আর তার দেশের কর্ণধার নন। যা কেউ কল্পনায়ও আনেনি, বা কেউ ভাবতে পারেনি, বাস্তবে তাই ঘটে গেল।
এই পতন বঙ্গবন্ধুর বেলায়ও হতে পারে বলে সন্দেহ করেছিলেন তিনি। চিন্তা চেতনায় শেখ মনি সব সময় ছিলেন বিচক্ষণ।
বঙ্গবন্ধুকে, তার দলকে দুর্বল করে ফেলতে হলে শেখ ফজলুল হক মনিকে দুর্বল করে ফেলতে হবে, এটি চক্রান্তকারীদের বুঝতে সমস্যা হয় নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দিনেই শেখ ফজলুল হক মনিকেও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তার কারণ সহজেই বোধগম্য। খুনি চক্র জানত – প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তোলার উপযুক্ত ব্যক্তি কে কে হতে পারে। শেখ ফজলুল হক মনির নামটি ছিল তাদের তালিকার একবারে উপরের দিকে।
সমাজ পরিবর্তনের জন্য বিশে^ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মতবাদ ও দর্শন এসেছে। সেই মতবাদ ও দর্শন স্থায়ী হয়েছে, যা সমাজের সব শ্রেণির মানুষের জন্য কাজ করেছে। ধনতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। মার্কসবাদ তেমনি একটা মতবাদ। কিন্তু এই মতবাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সব ক্ষেত্রে সফল হতে পারেনি। তবে মুজিববাদ সকল সীমবিদ্ধতাতে কাটিয়ে বাংলাদেশের সর্ব শ্রেণির মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে। মুজিববাদ মূলত জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চারটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। শেখ ফজলুল হক মণি তাঁর সকল কর্মে ও লেখায় মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার উপর জোর দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর পুরো জীবন বাঙালীকে মুক্ত করার লক্ষ্যে নির্দিষ্ট আদর্শের উপর ভিত্তি করে চালিত করেছেন। তাঁর সেই দর্শনকে অনুসারীরা নাম দিয়েছেন ‘মুজিববাদ’।
লেনিনের মতবাদে স্বাদেশিকতা বা জাতীয় চেতনা ছিল না। আবার মাও সে তুং লেনিনের ভুল বুঝতে পেরে জাতীয়তাবাদকে অন্তর্ভুক্ত করলেন। বঙ্গবন্ধু কৌশলে শক্ত হাতে দুর্গম আরণ্যিক পথের কাঁটা কেটে কেটে সমাজবাদী আন্দোলনের সুগমতার জন্য সড়ক নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। শেখ মণি এ প্রসঙ্গে যথার্থই বলেছেন-“অপূর্ব দৃঢ়তার সাথে সমাজতন্ত্রের মধ্যে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের নির্যাস ঢেলে দিয়ে বঙ্গবন্ধু সমগ্র বাঙালী জাতির নিকট সমাজবাদী কর্মসূচীকে গ্রহণীয় করে তুলেছেন।” (‘মুজিববাদ দর্শনে ও বাস্তবে’- বাংলার বানী, ২১ মে ১৯৭২)। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে বঙ্গবন্ধু সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী চক্র নিধনের জন্য উদ্বোধন করেছিলেন এক নতুন রাজনৈতিক অস্ত্রের। সেটা হলো গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ অস্ত্র। শেখ মণি এ প্রসঙ্গে বলেছেন,“তিনি (বঙ্গবন্ধু) সমাজবাদী হয়েও গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী। তিনি অনন্য, অসাধারণ, নতুন। পরমুখাপেক্ষী নন। তাঁর বাংলাদেশে সমাজবাদী আন্দোলনও তাই নতুন কক্ষপথে পরিক্রমিত। সেটা মাওবাদী নয়, মার্কসবাদীও নয় – সেটা মুজিববাদী।” (‘মুজিববাদ দর্শনে ও বাস্তবে’- বাংলার বানী, ২১ মে ১৯৭২)
বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রকে গণতন্ত্রের একই ধারায় নিয়ে এসেছিলেন। আবার জাতীয়তাবাদের নতুন অস্ত্র ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে তিনি পুঁজিপতিদের থেকে উদ্ধার করে সমাজতান্ত্রিক চেতনার সাথে একীভূত করে দিয়েছিলেন। শেখ মণি এ প্রসঙ্গে বলেছেন,“আব্রাহাম লিংকনের দৃষ্টিতে যা ছিল স্বপ্ন, মার্কসের মতে যা ছিল অসম্ভব, মুজিবের হাতে পড়ে তাই বাস্তব ও সম্ভবপর হয়ে উঠেছে। …মার্কস কেবলমাত্র বস্তুবাদী, গণতান্ত্রিক নন। জাতীয়তাবাদী নন। এটা মাওবাদী নয়, কারণ মাও মূলত: বস্তুবাদী ও জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক নন। এটা লিংকনবাদীও নয়। কারণ লিংকন জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক; সমাজবাদী নন। এটা নতুন। এবং এ নতুনত্ব শেখ মুজিবের অবদান। তাই এটা মুজিববাদী।” (‘মুজিববাদ দর্শনে ও বাস্তবে’- বাংলার বানী, ৪ জুন ১৯৭২)। সমগ্র বিশ্লেষণের পর আমরা বলতে পারি মুজিববাদ একটি পরিপূর্ণ রাজনৈতিক মতবাদ। এ মতবাদ বঙ্গবন্ধু প্রচারিত রাজনৈতিক চিন্তা-দর্শন ও মূল্যবোধের সমষ্টি, যার প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে সুখী-সমৃদ্ধ, সমাজতান্ত্রিক চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার কথা।
শেখ মণি দেশ পুনর্গঠনের জন্য অন্যতম বাঁধা হিসেবে দেখেছিলেন আমলাতন্ত্র। কারণ আমলাদের কর্মকা- তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন কাছ থেকে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী আমলাদের অবস্থান কখনোই স্পষ্ট ছিল না। ছয় দফা থেকে শুরু করে কোন আন্দোলনেই শতকরা পঁচানব্বই ভাগের কোন অবস্থান ছিল না। তারা অফিস আদালত বন্ধ রাখত কারণ অফিস চলবে না, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সব কিছু অচল হয়ে পড়ত। অনেকে ভয়ে আবার অফিসে যেত না। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার তারা ফাইল খুলে বসে যেতেন। আমলারা জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে স্বেচ্ছায় কোন আন্দোলনে আসেননি। তারা স্বাধীনতা পূর্ববর্তী যেমন পাকিস্তানের কালো আইন প্রতিপালনের জন্য কাজ করেছেন, আবার স্বাধীনতাত্তোরেও তারা আওয়ামী লীগ সরকারের আজ্ঞা পালন করেছেন। কিন্তু বিষয়টি অতটা সহজ নয়। অনেক আমলা স্বাধীনতা আন্দোলনে বুদ্ধি ও শ্রম দিয়ে পাকিস্তানীদের সাহায্য করেছেন। সেই সব আমলা স্বাধীনতাত্তোরকালেও ষড়যন্ত্র করে চলেছিল। কারণ সেই সময় মার্কিন, চীন, পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল। আমলারা তাদের সাথে আঁতাত করে চলছিল। এজন্য বঙ্গবন্ধু সরকার বিভিন্ন সমস্যার ভিতর দিয়ে অতিক্রম করছিল। শেখ মণির এই কথাগুলো স্বাধীনতাত্তোকালে বিভিন্ন লেখায় ফুটে উঠেছে।
শেখ ফজলুল হক মনি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা ছিলেন। তিনি দেখেছিলেন প্রশাসনের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে আছে প্রতিক্রিয়াশীল স্বাধীনতা বিরোধীরা। মোনায়েমের আমলা দিয়ে মুজিবের শাসন চলতে পারে না। এই শিরোনামে শেখ মনি উপসম্পাদকীয় লিখেছিলেন। যে লেখা নিয়ে তোলপাড় হয়েছিলো প্রশাসনে। আমলারা একযোগে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ছুটে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে অভিযোগ নিয়ে। একজন মন্ত্রী টেলিফোন করে শেখ মনিকে বলেছিলেন, এ ধরনের লেখা প্রশাসনকে দুর্বল করবে। আমলারা আমাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে। শেখ মনি বলেছিলেন, “আজ হয়তো ক্ষমতায় থাকার জন্য আমার সমালোচনা করছেন কিন্তু মনে রাখবেন অল্প দিনের মধ্যেই বুঝতে পারবেন এই প্রশাসন কার।”
অনেকেই শেখ মনিকে ভুল বুঝতেন। তারা মনে করতেন, তিনি বোধকরি বিকল্প কোন শক্তির উন্মেষ ঘটাতে চাচ্ছেন। এই ধরনের অভিযোগ বঙ্গবন্ধুর কাছেও করা হতো। সিনিয়র মন্ত্রীরা নালিশ জানাতেন। পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্টের পর আমলাদের অবস্থা কী হয়েছিল তা অনেকেরই জানা। খন্দকার মুশতাকের পেছনে ১৫ অগাস্টের দিন জুম্মার নামাজ আদায়ের জন্য আমলাদের রীতিমত প্রতিযোগিতা ছিল। ( মনি ভাই, অকৃতজ্ঞ থেকে গেলাম- মতিউর রহমান চৌধুরী, মানব জমিনের সম্পাদক)
আমলাদের আরেকটি বড় সমস্যা হলো তারা দুর্নীতিগ্রস্ত। পাকিস্তান সরকারের আমলা হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু তাদের সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সুযোগের তারা অপব্যবহার করেছিলেন তারা। পাকিস্তান আমলের মত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশেও তারা পুরাতন আমলের অভ্যাস মাফিক স্ব স্ব আখের গুছাবার কাজে ব্যস্ত ছিল। শেখ মণি এ প্রসঙ্গে বলেছেন,“চারিদিকের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের দেশের দুর্নীতিপরায়ণ আমলাদের ঝেঁটিয়ে তাড়াবার দরকার এসে গেছে। সরকার সমাজতন্ত্রীকরণ কর্মসূচি ঘোষণার পরেও তাদের মানসিক পরিবর্তন হয়নি। তিরিশ লাখ লোকের লাশের উপর দাঁড়িয়ে এখনও যে সকল আমলা ও দুর্নীতিপরায়ণ লোকেরা দু’হাতে লুটে খাবার কাজে মত্ত, ধরে নিতে হবে তারা সংশোধনের বাইরে। … খাসলত এদের বদলায়নি, বদলাবার নয়। … এদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান নয়, উচ্ছেদ অভিযান চালাতে হবে।” (‘দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্র’ ১১ মে ১৯৭২)
শেখ ফজলুল হক মণির বর্ণাঢ্য জীবনের প্রতিটি স্তরেই রয়েছে মুজিবাদর্শের আলোকে ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার ইতিবৃত্ত এবং কালোত্তীর্ণ মুক্তি-দর্শনের পথ। দেশ স্বাধীনের পর প্রশাসনযন্ত্রের স্থবিরতা তাকে উৎকণ্ঠিত করেছিল। বিশেষ করে তাকে অনেক বেশি পীড়া দিচ্ছিল পরিকল্পনা ও অর্থনীতি বিষয়ক জটিলতা নিয়ে। তিনি বলেছেন,“কিভাবে এই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প, বাণিজ্য ও অর্থ সংস্থাগুলো পরিচালিত হবে সে সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণীত হয়নি। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে চরম নৈরাজ্য ও অনিশ্চয়তা। … এদিকে দেশের অবস্থা কাহিল। পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তের অভাবে ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদনে মন্দা প্রভাব এসে গেছে। দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হবার উপক্রম। তাই বঙ্গবন্ধুর নিকট আমাদেরও আবেদন, এই সকল আয়ুবী আমলাদের পুঁথিপড়া বিশেষজ্ঞদের পরিবর্তে আপনি একবার দেশি নাপিত দিয়ে চেষ্টা করে দেখুন।…।” (পরিকল্পনা ও অর্থনীতি বিষয়ক জটিলতা, বাংলার বাণী, ১৫ মে ১৯৭২)
শেখ ফজলুল হক মনির রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শন ছিল দেশপ্রেম ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, “সেই একটা সময় ছিল, ত্যাগ-ব্রতের রাজনীতি তাদের ঘিরে যারা জড়ো হতেন তাদের মধ্যে গভীর দেশপ্রেম ছিল। রাজনীতি চর্চার জন্য শিক্ষা ও আদর্শ ছিল, চরিত্রে সংহতি ছিল। তারা দেশের মানুষকে ভোটার বা রাজনীতিকে ক্ষমতার সিঁড়িই শুধু ভাবতেন না, বড় করে দেখতেন। আমাদের মনি সাহেব ছিলেন এই দলের মানুষ। মনি ভাইকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও সালাম।”
শেখ মনির রাজনৈতিক দর্শন ও চিন্তার দূরদর্শিতা যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি, তাহলেই তাকে স্মরণ করা সার্থক হবে।
তথ্যসূত্র
শেখ ফজলে শামস পরশ এর স্মৃতিকথা
শেখ ফজলে নূর তাপস এর স্মৃতিকথা
স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তিত্ব, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেখ মনি – এম এ মুফাজ্জল
সাংবাদিক মনি ভাই – রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ
দূরবীনে দূরদর্শী
বাংলার বাণীর বিভিন্ন সম্পাদকীয়ইন্টারনেট
লেখক: শেখ মণি গবেষক ও প্রাবন্ধিক, গ্রন্থনা ও প্রকাশনা বিষয়ক উপ সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ; পিএইচডি গবেষক (বৃত্তিপ্রাপ্ত), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/আইই