আদালতের রায়ের পরও ভাগ্য বদলায়নি নদীর
৮ ডিসেম্বর ২০২১ ১৭:০৮
নিরবচ্ছিন্ন দখল-দূষণে হারিয়ে যাচ্ছে দেশের নদ নদী। অবৈধ দখল আর নানারকম দূষণের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সকল নদ-নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা করে মহামান্য উচ্চ আদালতের রায় থাকার পরেও দরিদ্র নিপীড়িত মানুষের ন্যায় দেশের নদীগুলোর ভাগ্যও বদলায়নি। দূষণ আর দখলদারদের কবল থেকে মুক্তির বদলে উল্টো নদী দখল দূষণ আরও বেড়েছে। দখলদারদের সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রয়েছে। সুশাসনের অভাব এবং দখল-দূষণকারীদের আইনের আওতায় আনতে না পারার ব্যর্থতায় নদ-নদী, জলাধার রক্ষা করা যাচ্ছে না। ঠেকানো যাচ্ছে না নদীর মৃত্যু।
দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নদীগুলোকে কিছু অর্থলোভী মানুষ নানা কৌশল অবলম্বন করে হত্যা করেছে। প্রমত্তা নদীগুলো এখন অস্তিত্ব হারিয়ে মৃতপ্রায় সরু খালে পরিণত হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে বেড়িবাধ, স্লুইসগেট, রাবার ড্যাম, ব্রিজ এবং নদী দখল করে নানা অবকাঠামো নির্মাণের কারণে পানিপ্রবাহ কমে গিয়ে গত ৫৭ বছরে ১৫৮টি নদী শুকিয়ে গেছে। অন্যদিকে, পরিবেশ অধিদপ্তরের এক সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে দেশের ২৯টি প্রধান নদ-নদীর দূষণমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে (নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত) এ সকল নদীর পানির দূষণ বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছায়। এছাড়াও, মাছের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশের ৯টি নদী নিয়ে অপর একটি সমীক্ষা করেছে মৎস্য অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ। এ সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে, মাছের উৎস এ নদীগুলো মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। একইসাথে, এসব নদীর পানিতে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মাত্রার ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। দুটো সমীক্ষাতেই দূষণের জন্য কিছু অভিন্ন বিষয়কে দায়ী করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো শিল্পকারখানার বর্জ্য। নদী তীরে গড়ে ওঠা এসব শিল্প-কলকারখানার বর্জ্য পরিশোধন না করেই নদীতে ফেলা হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে কৃষিকাজে ব্যবহৃত হওয়া মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক এবং গৃহস্থালি বর্জ্য (সূত্র: প্রথম আলো, ২২ মার্চ, ২০১৯)।
অব্যবস্থাপনা আর সমন্বয়হীনতার অভাবে এক শ্রেণীর দূর্বৃত্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমতো নদ-নদী দখল করে মার্কেট, শিল্প প্রতিষ্ঠান, ও আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলছে। কোথাও বালু উত্তোলন করা হচ্ছে, কোথাও নদীর মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে মাছ চাষ করছে। কিন্তু, এগুলো দেখার মতো বা এর বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার মতো প্রশাসনিক উদ্যোগ খুব একটা দৃশ্যমান নয়। উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে তা আবার থেমেও যায়। ফলে স্বভাবতই, প্রভাবশালী অবৈধ দখলকারীরা বহাল তবিয়াতে থেকে নব উদ্যমে দখল কার্যক্রম আরও সম্প্রসারিত করে। এ অবস্থা চলতে থাকলে নদীমাতৃক বাংলাদেশের পরিচয় ইতিহাসের পাতায় জায়গা পাবে। আর, নদীবৈরী একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নতুন পরিচয় পাবে।
নদীবিষয়ক বইপত্র ঘেঁটে জানা যায় যে, ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের নামে বিদেশি পরামর্শকদের সুপারিশে উপকূলীয় অঞ্চলে বেড়িবাধ নির্মাণ শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থার ওপর প্রথম আঘাত আসে। যদিও কোনো কোনো গবেষণায় বলা হয়েছে ইংরেজ আমল থেকেই নদী ব্যবস্থাপনায় ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্বিক শিল্প সভ্যতার প্রভাবে নদীর তীরে গড়ে উঠেছে বড় বড় শিল্প-কলকারখানা। ফলে, মুক্ত বাণিজ্যের প্রসারে নদীর দখল ও দূষণ ঘটেছে ব্যাপকহারে। অথচ, আমাদের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য- সবকিছুর সঙ্গে আমাদের নদীর সম্পর্ক রয়েছে। কত শত কালজয়ী কাব্য, গান, উপন্যাস রচিত হয়েছে নদী ও নদী নির্ভর মানুষ নিয়ে। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশকে সুজলা সুফলা করে তুলেছে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা এসব নদীগুলো। আমাদের কৃষি-শিল্প অর্থনীতিকে করেছে সমৃদ্ধ। অর্থাৎ, নদী আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না।
বাংলার এ জনপদ একসময়ে তেরো’শ নদীর দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও এখন আর সেই অবস্থান নেই। বর্তমানে আমাদের কাছে নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যার তথ্য নেই। নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক ও ভিন্ন ভিন্ন পরিসংখ্যান। নদীর সঠিক সংখ্যা কত? এ প্রশ্নের উত্তর সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, দপ্তর কারো কাছেই নেই। এমনকি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাছেও নাই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সর্বশেষ জরিপ (বাংলাদেশের নদী-নদী শীর্ষক ছয় খণ্ডের একটি সমীক্ষা) ২০১১ অনুযায়ী দেশের নদ-নদীর মোট সংখ্যা ৪০৫টি। নদী গবেষক ও বাংলাদেশ পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ওয়ারপোর সাবেক মহাপরিচালক ম. ইনামুল হক এর মতে বাংলাদেশে মোট নদীর সংখ্যা ১,১৮২ (বাংলাদেশের নদনদী, ম. ইনামুল হক, জুলাই ২০১৭)। তার গবেষণা অনুযায়ী প্রধান ও মাঝারি নদী ৩৬০ এবং ছোট নদী ৮২২। অন্যদিকে, বাংলাপিডিয়াসহ সরকারি বিভিন্ন নথিতে নদীর সংখ্যা কোথাও ৭০০, কোথাও ৮০০। নদীর সঠিক সংখ্যা যাই হোক না কেন বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের একটি বড় অংশের জীবিকা ও পরিবহনের জন্য নদীর ওপর নির্ভরশীল।
নদী নিয়ে কাজ করার সুবাদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নদীগুলোর করুণ অবস্থা এবং নদী নির্ভর মানুষের দুঃখ দুর্দশা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছে। কয়েকটি নদীর কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। যশোরের ভবদহ অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদ পলি জমে নাব্যতা হারিয়েছে। এ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধানে সরকার নদী-খাল খনন, স্লুইচগেট নির্মাণ ও উপকূলীয় বাধ সংস্কার, নতুন বাধ নির্মাণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব পদক্ষেপ জলাবদ্ধতা দূরীকরণে কোনো কার্যকর ফলাফল বয়ে আনেনি, বরং মানুষের দুঃখ দুর্দশা আরও বেড়েছে।
বগুড়ার করতোয়া নদীর উজানে অপরিকল্পিত বাধ নির্মাণ ও বর্ষাকালে নদীর তীর ভাঙনের ফলে তলদেশে পলি জমে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। আর অন্যদিকে, গৃহস্থালি ময়লা-আবর্জনাসহ কলকারখানার বর্জ্য ফেলে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে, এবং নদীর দুই পার অবৈধভাবে দখল হয়ে গিয়েছে। নাব্যতা সংকটের কারণে বাঙালি ও নাগর নদীর বুকে চাষাবাদ, অস্থায়ী বাধ দিয়ে মাছ চাষ, বালু উত্তোলনসহ এ দুটি নদীর আশপাশের ফসলি জমি এখন বিলীন হওয়ার পথে।
পাবনা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া ইছামতী নদী আজ দখল ও দূষণে জর্জরিত। ইছামতী নদীর উৎস মুখে চরশিবরামপুরে স্লুইচ গেট নির্মাণ, সারা বছর কপাট বন্ধ রাখা এবং পাবনা শহরসহ নদীটির গতিপথের বিভিন্ন স্থানে ১৭টি অপরিকল্পিত ছোট ছোট ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। যেগুলো নদীটিকে মেরে ফেলার কাজকে ত্বরান্বিত করেছে।
দেশের বৃহত্তম দুটি নদী পদ্মা-যমুনা এবং বৃহত্তর জলাভূমি চলনবিলের মধ্যে প্রধান সংযোগ রক্ষাকারী নদী হচ্ছে বড়াল। ১৯৮১ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড রাজশাহীর চারঘাটে বড়াল নদীর উৎস মুখে ৩০ ফুট চওড়া এবং ৮ ফুট উচ্চতার একটি স্লুইচগেট নির্মাণ করে। পরবর্তীতে আরও একটি ছোট স্লুইচগেট এবং তিনটি ক্রস বাধ নির্মাণ করা হয়। যা পরবর্তীতে নদীর বুকে পাকা রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও, ভূমিদস্যু কর্তৃক ভুয়া আর.এস রেকর্ডের মাধ্যমে বড়াল নদীর জায়গা দখল হয়ে গেছে। পাশাপাশি গৃহস্থালির বর্জ্য, হাসপাতাল, গরুর খামার, পোল্ট্রি খামার, ক্লিনিক, হোটেল-রেস্টুরেন্টের বর্জ্য এ নদীতে ফেলার কারণে প্রতিনিয়ত ভরাট ও দূষিত হচ্ছে বড়াল নদ।
অন্যদিকে ঢাকা শহরকে ঘিরে থাকা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, ও শীতলক্ষ্যা নদীরও একই দশা। এ নদীগুলোর দুই পারের তীর দখল করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের সকল প্রকার বর্জ্য নদীগুলোতে ফেলা হয়। সাভারে বর্জ্য পরিশোধনাগার তৈরি হলেও নিয়ম নীতি তোয়াক্কা করে কারখানাগুলোর বর্জ্য ফেলে বুড়িগঙ্গার মতো ধলেশ্বরী নদীও দূষিত করা হচ্ছে। অনুরূপভাবে মেঘনা, ভৈরব, হালদা, কর্ণফুলী, রূপসা নদীও একই পথে এগোচ্ছে। নদীর প্রতি নির্মম আচরণ বন্ধ না করলে আগামী প্রজন্মের সমূহ বিপদ আছে।
২০১৩ সালে গঠিত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন প্রথমবারের মতো নদী দখলকারীদের তালিকা ঘোষণা করেন ২০১৯ সালে। তখন প্রায় ৪৯ হাজার ১৬২ দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সংস্থাটির এ বছর প্রকাশিত তালিকায় এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৬০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। নদী দখলদারদের তালিকা প্রকাশিত হলেও নদী দূষণকারীদের কোনো তালিকা এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। দেশের সকল নদ-নদী দূষণ ও দখলমুক্ত করে সুরক্ষা, সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য উচ্চ আদালত নদী রক্ষা কমিশনকে নদ-নদীর আইনগত অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করেছে।
প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন জীববৈচিত্র্য, সব উন্মুক্ত জলাভূমি, সমুদ্র, নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, ঝিল, নদীর পাড়, পাহাড়, বন ইত্যাদি দেশের সকল নাগরিকের সম্পত্তি, কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের নয়। কিন্তু কিছু মানুষ নিজেদের স্বার্থে নির্বিচারে প্রাকৃতিক এ সম্পদসমূহ ধ্বংস করছে। এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য রাষ্ট্র ও জনগণকে সম্মিলিতভাবে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। সম্মিলিত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এই সংকটের প্রকৃতি, উৎস চিহ্নিত করা যেমন প্রয়োজন ঠিক তেমনি করণীয় সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট স্বার্থাধিকারীদের মধ্যে মতের আদান প্রদান ও অংশগ্রহণমূলক কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত দেশের বিপন্ন নদ-নদী সুরক্ষায় কৌশলগতভাবে রাষ্ট্র ও জনপ্রতিনিধিসহ মূল স্বার্থাধিকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ এখন সময়ের দাবি।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
সারাবাংলা/আইই