ঢাকা কলেজে শিক্ষার্থীরা রক্তাক্ত, দায় কার?
২০ এপ্রিল ২০২২ ২২:৪৯
বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র গড়ার পেছনে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও দিনমজুরসহ বিভিন্ন পেশজীবী মানুষের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন ছিল দৃঢ়। এমনকী সম্পর্ক ছিল স্নেহ, মমতা, শ্রদ্ধা ও সম্মানের জায়গায়। যার ফলাফল হিসাবে আমরা দেখছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহা ছাত্র–ছাত্রীদের জীবন বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। ইতিহাসের সেই মহান বাঙালি শিক্ষক বলেছিলেন, ‘ছাত্রদের গায়ে গুলি লাগার আগে সেই গুলি আমার বুকে লাগবে।’
অপরদিকে দেখেছি ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’– স্লোগানে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন তখন ছাপাখানার কর্মচারি রফিক, সরকারি অফিসের পিয়ন সালাম রাজপথে ছাত্রদর সাথে জীবন দিতে মাতৃভাষা রক্ষা করেছিলেন। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শহিদ জাফর, জেহাদ, মোজাম্মেল, কাঞ্চন, দিপালীসহ অনেকে ছিলেন ছাত্র। তবে বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে মিছিলে যোগ দিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়া মানুষটি ছিলেন একজন শ্রমিক। এমন কী ডাক্তার মিলনকেও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে জীবন দিতে দেখেছি। এভাবেই যুগে যুগে ছাত্র শ্রমিক জনতার ঐক্যবদ্ধ শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি জাতি ইতিহাস রচনা করেছিল।
তবে স্বাধীনতা একান্ন বছরের বাংলাদেশকে নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হতে হয়। নিত্যনতুন একি দেখি, চারিদিকে ইট পাটকেল ছোড়াছুঁড়ি, ব্যবসায়ী ছাত্রের মারামারি, রক্তে রঞ্জিত রাজপথ। মুখামুখি সংঘর্ষে ঢাকা কলেজের রাজপথ যুদ্ধক্ষেত্র! শুধু কি এটাই শেষ, পুরোনো পত্রিকা খুঁজে দেখলে দেখতে পাব যে, বাসের ড্রাইভার আর ছাত্রে মারামারি। বাসের কন্ডাক্টরা করে একটু বাড়াবাড়ি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কিংবা নরসিংদীতে মাইক দিয়ে ঘোষণা দিয়ে করে মারামারি। কেন এমন অনাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে? রাষ্ট্র নীরব কেন? কিছু মানুষ ন্যায্য অধিকারের দাবি চাওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর দমন–পীড়ন করে। কোন রাজনীতির আদর্শ এমন করে? কেইবা দেয় এদের ইন্ধন! ভিন্ন মতের শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে মারে। হলে হলে সন্ত্রাসের আয়োজন চলে। রাজনীতির নামে অপরাজনীতি চলে। রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের দখলে। বাজার কালোবাজারীদের হাতে। জনগণ কাঠামোগত সহিংসতায় লিপ্ত। রাষ্ট্র কী কখনো ভেবে দেখেছে জাতির দুর্দশা কেন? অস্ত্রশস্ত্র মারামারিতে লিপ্ত জাতিকে কি আমরা সভ্যজাতি দাবি করতে পারি?
সম্প্রতি রাজধানীর নিউমার্কেটে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে একজন চাকরিজীবী (ডেলিভারি ম্যান) নিহত ও ১০ জন সাংবাদিকসহ দুইশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। সংবাদপত্রের সংবাদ বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, শিক্ষার্থীরা খেয়ে বিল কম দিয়েছে; ব্যাবসায়ীদের এমন অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। উল্টো দেখা যায়, ব্যবসায়ীদের নিজেদের বিতণ্ডায় শিক্ষার্থীদের ডেকে আনলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। নিউমার্কেটের–৪ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতেই ‘ওয়েলকাম’ ও ‘ক্যাপিটাল’ নামের দুটি ফাস্টফুডের দোকান। ইফতারের সময় হাঁটার রাস্তায় টেবিল বসিয়ে ইফতার সামগ্রী বিক্রি করতে বসাকে কেন্দ্র করে ওই দুই দোকানের কর্মীদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এরপর রাত ১১টার দিকে বাপ্পীর সমর্থক ১০–১২ জন যুবক আসে নিউমার্কেটে। এ সময় তারা হাতে রামদা নিয়ে আসে। তারা ক্যাপিটাল দোকানে গিয়ে কাওসারের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়ায়। সেখানে কাওসার সমর্থকরা বাপ্পীর সমর্থকদের ওপর হামলা চালিয়ে মার্কেট থেকে বের করে দেয়। বাপ্পী সমর্থকরা মার্কেট থেকে পালিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পর ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি দলকে নিয়ে এসে মার্কেটে হামলা চালায়। তবে ঘটনা সামাল দিতে না পেরে ঢাকা কলেজ প্রশাসন কলেজ বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের হলত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর আগেই আমরা দেখেছি ক্যাম্পাসে কোনো ঘটনা ঘটলেই ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেওয়া হয়। আচ্ছা ধরেন, কোনো ব্যক্তির মাথা ব্যাথা। এখন তার মাথা কেটে ফেলবেন না কী চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করবেন। কিন্তু দুঃখের রাষ্ট্র বারবার একই কাজ করে থাকেন মাথা ব্যাথা হলে মাথা কেটে ফেলেন। ফলে এটা কোনো সভ্য জাতির সভ্য সমাধান হতে পারে না।
শিক্ষার্থীদের পরিক্ষা চলছে, সেই মুহূর্তে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ না খুঁজে কলেজ বন্ধ দেওয়া দায়িত্বহীনতার পরিচয়। তুচ্ছ ঘটনায় তুলকালাম বলা একেবারেই ঠিক হবে না। কারণ প্রায় সতেরো থেকে আঠারো ঘণ্টা ধরে ঢাকা কলেজ ও নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে সংঘর্ষ ঘটছে, তা দেশের জনগণকে উদ্বিগ্ন হতে হয়েছে। ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলার আপডেট তথ্য নেওয়ার জন্য মানুষ যেমন টিভি চ্যানেলের সামনে বসে থাকে ঠিক তেমনি ঢাকা কলেজ বনাম নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ দেখেছে। দীর্ঘদিন ধরে ওই অঞ্চলে নিয়মিতভাবে শিক্ষার্থী–ব্যবসায়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটার পরও সরকার কিংবা প্রশাসন দায়িত্বহীন কেন? বিশেষ করে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি কিংবা দোকানদারদের দুর্ব্যবহারের ফলে স্বার্থান্বেষী ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর স্বার্থের দ্বন্দ্ব সংঘাতের ফলে সবসময়ই ভুক্তভোগী হতে হয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা ও ক্রেতা, পথচারী এবং যাত্রীরাসহ অনেক মানুষকেই।
তবে সংঘর্ষের ঘটনা রক্তপাতের দিকে গড়াতে পারতো না, যদি রাষ্ট্র কিংবা প্রশাসন যথাযথ সময়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা সেটা না করে পুলিশ বাহিনী দিয়ে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করা জাতির জন্য দুঃখজনক ঘটনা। অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আর কোনো মারামারি কিংবা সংঘর্ষ নয়, দেশে শৃঙ্খলা ফিরে আনতে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজির দৌরাত্ম বন্ধ করতে হবে। সেইসাথে রাজনৈতিক দলের মাস্তানদের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে না পারলে এমন দ্বন্দ্ব ও সংঘাত লেগেই থাকবে। দেশের বিশৃঙ্খলা বাড়তে থাকবে।
ঢাকা কলেজের ভেতরে হলে হলে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের দখলদারিত্ব, অগণতান্ত্রিক পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদেরকে স্বার্থের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। কালোবাজারি কালো হাত যেন লম্বা না হতে পারে তার জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। নিহত ডেলিভারিম্যান নাহিদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যারা এম্বুলেন্স ভেঙেছে, যারা শিক্ষকদের ওপর হামলা করেছে– তা সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। মানুষের মধ্যে স্নেহ, মমতা, শ্রদ্ধা ও সম্মানের জায়গায় তৈরীর জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যার ফলে শিক্ষার বাজেট সংকোচ নয় প্রসার করতে হবে। ভ্রাতৃত্বের বাংলাদেশে শৃঙ্খলা নিয়ে আনতে রাষ্ট্রকেই ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঢাকা কলেজে শিক্ষার্থীরা রক্তাক্ত দায় কার? রাশেদুজ্জামান রাশেদ