প্রথম স্বাধীন জেলা যশোরের ইতিহাস ঐতিহ্য
২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৫:৫৭
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের তীর্থভূমি যশোর নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন আরবি ‘জসর’ থেকে যশোর শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ সাঁকো। এককালে যশোরের সর্বত্র নদীনালায় পরিপূর্ণ ছিল। নদী বা খালের ওপর সাঁকো বানানো হতো। জানা যায় একসময় পীর খানজাহান আলী বাঁশের সাকো নির্মাণ করে ভৈরব নদী পেরিয়ে মুড়লীতে আসেন।
অনেকের অভিমত, ‘যশোর’ নামটি খানজাহান আলী আসার আগে থেকেই ছিল। আবার কেউ কেউ বলেছেন, যশোর শব্দ ‘যশোহর’ শব্দের অপভ্রংশ। যার অর্থ যশ হরণকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। গৌড়ের যশ হরণ করে এই শহরের শ্রীবৃদ্ধি হওয়ায় যশোর নাম হয় । অনেকের অনেক ধরণের মতামতের মধ্য দিয়ে নামকরণটা যেভাবেই হোক পরবর্তীকালে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও বৈপ্লবিক ইতিহাস বহু উত্থান-পতন আর বৈচিত্র্যপূর্ণ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যশোর জেলার আজকের এই অবস্থান।
যশোর জেলায় রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল, শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভূমি, বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের সমাধি, বিমান বন্দর ও সেনানিবাস, এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম প্রবেশদ্বার বেনাপোল পৌরগেট, ফুলের রাজধানীখ্যাত গদখালী, খেজুরের গুড় ও জামতলার রসগোল্লা, দেশের প্রথম ও দীর্ঘতম ঝাঁপা বাওড়ের উপর ভাসমান সেতু, মণিহার সিনেমা হল, শ্রীধরপুর জমিদারবাড়ি, কালেক্টরেট পার্ক, পৌরপার্ক, লালদীঘির পাড়, বেনাপোলের পঁচার পান ভান্ডার।
এছাড়া ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠর মধ্যে দুইজনই বৃহত্তর যশোর জেলার কৃতি সন্তান। তারা হলেন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ ও বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান। দেশের সর্বপ্রথম শত্রু মুক্ত হয় আমাদের এই যশোর জেলা ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম জেলাটির মাধ্যমেই ১৭৮১ সালে বর্তমান বাংলাদেশে ব্রিটিশ প্রশাসনের প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ওই বছর জেলা ঘোষণার পর প্রথম জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেন মি. টিলম্যান হেঙ্কেল। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের ফলে অবিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চলকে করা হয় পাকিস্তানের অংশ এবং পশ্চিমাঞ্চলকে করা হয় ভারতের। যশোরের বনগ্রাম মহকুমাকে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করে সীমানারেখা নির্ধারণের ফলে যশোর জেলার ভৌগোলিক অবস্থানের পরিবর্তন সাধিত হয়।
বেনাপোল স্থল বন্দর: যশোর জেলার অর্থনীতির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেনাপোল স্থলবন্দর, যা শার্শা উপজেলার সীমান্তবর্তী বেনাপোলে অবস্থিত। সরকারি আমদানী শুল্ক আহরণে স্থলবন্দরটির ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। শার্শা উপজেলার বেশির ভাগ মানুষের জীবিকার অন্যতম পেশা স্থলবন্দরের কাস্টমস ক্লিয়ারিং এজেন্টের কাজ। এর কার্যক্রম পরিচালনা করে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। শুধু তাই নয় এই বেনাপোল দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত রেল চলাচল করে। বেনাপোলের বিপরীতে ভারতের দিকের অংশটি পেট্রাপোল নামে পরিচিত। এই পথে দৈনিক হাজার হাজার ভ্রমণকারী বাংলাদেশ ও ভারতে আশা যাওয়া করেন।
আইটি পার্ক: আইসিটি সেক্টরের বিকাশ ও আইটি খাতকে সমৃদ্ধ এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করতে যশোরে স্থাপিত হয়েছে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক। ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যশোরে আন্তর্জাতিক মানের একটি আইটি পার্ক স্থাপনের ঘোষণা দেন। এরপর ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই আইটি পার্কের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভূমি: ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি ছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত ও জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান। মধুসূদন দত্তের পিতা ছিলেন খ্যাতনামা উকিল। তেরো বছর বয়স থেকে তাকে কলকাতায় বসবাস করতে হত। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তার মায়ের কাছে। জাহ্নবী দেবীই তাকে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত করে তোলেন। সাগরদাঁড়ির পাশের গ্রামের শেখপুরা মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। দীর্ঘ জীবন শেষে ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে কপর্দকহীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তাকে কলকাতার সার্কুলার রোডে সমাধিস্থ করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের সমাধি: ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর গোয়ালহাটি ও ছুটিপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে নূর মোহাম্মদ মৃত্যুবরণ করেন। শার্শা উপজেলার ডিহি ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামে তাকে সমাহিত করা হয়।
যশোর বিমান বন্দর ও যশোর সেনানিবাস: ১৯৩৯-৪৫ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মিত্রবাহিনী কর্তৃক বর্তমান যশোর সেনানিবাসে সামরিক ক্যাম্প বা ‘বাশবাড়িয়া ক্যাম্প’ স্থাপন করে পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৮ সালের ২৪ জুলাই ক্যাম্পটিকে যশোর সেনানিবাস হিসেবে ঘোষণা করে। তবে যশোরে পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর চালু হয় ১৯৬০ সালে।
বেনাপোল পৌরগেট: দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত শহর বেনাপোলে নির্মাণ করেছেন এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম প্রবেশদ্বার। বেনাপোল সীমান্ত শহরে প্রবেশদ্বার এই গেটটি নান্দনিক স্থাপনা। যায় উচ্চতা ৫৩ ফুট ও প্রস্থ ১৪৪ ফুট। বেনাপোল পৌর সভার মেয়র লিটনের মনোনিত ডিজাইন অনুসারে সাড়ে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে দীর্ঘ দুই বছর ধরে নির্মিত হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন গেটটি এক নজর দেখতে।
গদখালী: ফুলের রাজধানী হিসাবে সুপরিচিত যশোর জেলার গদখালী বাজার। যশোর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ঝিকরগাছা ও শার্শা থানার ৯০ টি গ্রামের প্রায় ৪ হাজার বিঘা জমিতে চাষ করা হয়। জানা যায়, সর্বপ্রথম ১৯৮৩ সালে ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি গ্রামের শের আলী ভারত থেকে বীজ এনে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ শুরু করেন। শের আলীর সেই গদখালি গ্রামই এখন যশোরের ফুল চাষের রাজধানী। বর্তমান প্রতিদিন ভোর থেকেই ফুলের হাট বসে। এই গদখালী ফুল চাষিদের চাষের ফুল এখন ঢাকাসহ দেশের ৫৪ টি জেলায় যাচ্ছে এছাড়া পাশের দেশগুলোতে যায় বলে জানা গেছে।
খেজুরের গুড়: যশোরের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে খেজুরের রস, গুড় ও পাটালি। ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের যশোর খুলনা ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯০০-১৯০১ সালে পূর্ব বঙ্গে খেজুরের গুড় তৈরি হয়েছে ২১ লাখ ৮০ হাজার ৫৫০ মণ। এর মধ্যে শুধুমাত্র যশোরেই তৈরি হয়েছে ১৭ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ মণ গুড়। সর্বপ্রথম ১৮৬১ সালে ইংল্যান্ডের নিউ হাউজ চৌগাছার তাহেরপুরে খেজুরের গুড় থেকে ব্রাউন সুগার তৈরি করে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ঐ কারখানার উৎপাদিত গুড় সে সময়ে ইউরোপে রপ্তানি হয়েছে। পরবর্তীতে যশোরের বিভিন্ন গ্রামে ১১৭টি কারখানা গড়ে উঠে। বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে যশোরের ‘নোলেন গুড়’ দিয়ে বিখ্যাত সন্দেশ তৈরি করা হতো যা কোলকাতায় এখনো একটি সুস্বাদু খাবারের তালিকায় স্থান পায়।
জামতলার মিষ্টি: যশোর শহর থেকে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার শার্শা উপজেলার জামতলা বাজার (যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের পাশে অবস্থিত)। ‘যে চেনে সে কেনে, সাদেকের সৃষ্টি জামতলার মিষ্টি’— এই স্লোগানে ১৯৫৫ সালে শেখ সাদেক আলীর হাত ধরে যাত্রা শুরু হয়‘সাদেক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’র । বাবার মৃত্যুর পর বর্তমানে তার ছয় ছেলে ব্যবসার হাল ধরেন। অক্ষুণ্ন রাখেন এই মিষ্টির সুনাম। দৈনিক হাজারও মানুষ ছুটে আসেন জামতলার মিষ্টি খেতে ও কেনার উদ্দেশ্যে।
ভাসমান সেতু: যশোরের মণিরামপুরের ঝাঁপা বাওড়ের ওপর প্রায় ১৩০০ ফুট দীর্ঘ একটি ভাসমান সেতু (Floating Bridge) নির্মাণ করা হয়েছে।
মণিহার সিনেমা হল:যশোরের মণিহার সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালের ৮ ডিসেম্বর। এর নকশা করেন কাজী মোহাম্মদ হানিফ । আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর জন্য প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যেই সিনেমা হলটি খ্যাতি অর্জন করে । ৪ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত সিনেমা হলটির আসন সংখ্যা ১৪ শ।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
সারাবাংলা/এজেডএস