Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পোশাকের স্বাধীনতা ও চিন্তার পরিচ্ছন্নতা

জাফর হোসেন জাকির
১০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৫:৫৪

গ্রামে বেড়ে ওঠার সুবাদে দেখেছি নারীরা শুধুমাত্র শাড়ি শরীরে পেঁচিয়ে সাংসারিক সকল কাজ সেরে পুরুষের সাথে সহযোদ্ধা হিসেবে ফসলের মাঠে কাজ করেছে এবং এখনও করে চলেছে। ধান লাগানো থেকে শুরু করে ধান কাটা সহ ফসলের মাঠের সমস্ত কাজে নারীরা পুরুষের সাথে এক হয়ে কাজ করে চলেছে। প্রচন্ড রোদের তাপে মাঠে থাকতে না পেরে নারী-পুরুষ উভয়ে গাছের ছায়ায় আশ্রয় নেয় কিছুক্ষণ বিশ্রামের জন্য। এমন পোশাক পড়ে মাঠে কাজ করার জন্য নারীরা যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে জঘন্যতম অপরাধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে এমন কথা কখনো কি আমরা শুনেছি কিংবা হতে দেখেছি?

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর নামে কয়েকজন প্লাকার্ড হাতে রাস্তায় নেমেছে। তাতে লেখা ছিলো, ‘ছোট পোশাক নারীকে বিজ্ঞানী বানায় না পণ্য বানায়, পোশাকের স্বাধীনতার নামে পাবলিক নুইসেন্স বন্ধ হোক, ছোট পোশাক পড়ে বিপরীত লিঙ্গকে সিডিউস করা বন্ধ করুন’। আমরা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনু’র কথা ভুলিনি। তনু সারাক্ষণ হিজাব আর বোরখা পড়ে বাইরে বেড় হতো। তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। তনু তো ছোট পোশাক পড়তো না। তবে সে পণ্যে পরিনত হয়ে ধর্ষণের শিকার হলো কেন? বিভিন্ন মিডিয়ায় খবর আসে ছয় বছরের শিশু ধর্ষণ। ছয় বছর শিশুর কোন পোশাকের কারণে পুরুষেরা সিডিউস হন? কোন পোশাকের কারণে বলাৎকারের মতো জঘন্যতম ঘটনা ঘটে থাকে?

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান মতে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৪ হাজার ৩০৪ জন। এর মধ্যে ৭৪০জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে (প্রথম আলো, ২৯ মার্চ ২০১৬)। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের ‘স্টেট অব চাইল্ড রাইটস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে ৬৮৬ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। ২০১৭ সালে ৮৯৪ টি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২০১৭ সালে সামগ্রিকভাবে শিশু নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা বেড়েছে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ, যার মধ্যে শিশু যৌন নির্যাতন বেড়েছে ৩০ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হওয়ার মোট ৩৪৫টি সংবাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৩৫৬, যার মধ্যে মারা গেছে ২২ জন এবং আহত হয়েছে ৩৩৪ জন। ২০১৯ সালে ১ হাজার ৩৮৩ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ১৩৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সে হিসেবে গড়ে প্রতিমাসে ৫২টির বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর এসব ঘটনার বিপরীতে হওয়া মামলার মধ্যে গত ৫ বছরে মাত্র ১৬৪ মামলার রায় হয়েছে। ২০২০ সালে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৬২৬। ২০২১ সালে সারা দেশে ৮১৮টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং ৯৪টি শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়ে নিহত হয়েছে ১৪টি মেয়েশিশু। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ৩১ শতাংশ বেশি। পোশাকের কারণে যদি ধর্ষণ হতো তাহলে শিশু ধর্ষণের এই পরিসংখ্যান সামনে আসতো না। ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধ ঘটে পুরুষতান্ত্রিক বিকৃত-মস্তিস্কের কারণে, নারীর পোশাকের স্বাধীনতার কারণে নয়।

মানুষ সবসময় স্বাধীনতা খোঁজে কেন? কিংবা সবসময় স্বাধীনতা চায় কেন? শুধুই কি মানুষ স্বাধীনতা পিপাসু? না। জগতের সকল প্রাণী স্বাধীনতা চেয়ে এসেছে, চাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে চাবে কিংবা জীবনযুদ্ধে স্বাধীনতা পেয়ে এসেছে, পাওয়ার জন্য জীবনের সমস্তকিছু দিয়ে বিভিন্নভাবে যুদ্ধ করে চলেছে এবং ভবিষ্যতে এই যুদ্ধ আরো অধিক শক্তি নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকবে। পিঁপড়ার চলাচলের রাস্তায় যদি কিছু দিয়ে বাঁধা দেওয়া হয় তবে তাদের লাইন ভেঙ্গে যায়। ফলে লাইনের পরের পিঁপড়াগুলো আর ঐ পথ দিয়ে যাত্রা অব্যাহত রাখে না। কারণ তাদের চলার পথের স্বাধীনতা দ্বিতীয় কোনো মাধ্যম দ্বারা খর্ব হয়েছে। যাত্রাপথ পরিবর্তন করে তারা অন্যপথে মাধ্যমে একত্রে হয়ে আবার পূর্বের মতো করে সারিবদ্ধ হয়ে চলতে থাকে। যখন পিঁপড়ার বাসায় কেউ আঘাত হানে তখন আগের মতো আর তারা চুপ থাকে না। আক্রমণ করে বসে। এরকম পৃথিবীর সকল জীব তার বেঁচে থাকার স্বাধীনতা খোঁজে, স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। এই স্বাধীনতা হতে পারে পোশাক থেকে শুরু করে সমস্তকিছুতে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ করলে নারীদের পোশাক নিয়ে যেরকম বক্তব্য সামনে আসে তার বিন্দুমাত্র পুরুষের পোশাক নিয়ে বক্তব্য চোখে পরে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যে বক্তব্য দেখা যায় তাতে নারীদের পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বলা হয় নারী হলো মূল্যবান জিনিস, তাই নারীদের ভিতরে থাকা উচিৎ। প্রসঙ্গ টেনে বলা হয় সোনা হল মূল্যবান বস্তু, সোনাকে বাক্সের ভিতরে রেখে বাইরে তালা মেরে রাখতে হয়; বেশি টাকা হাতে নিয়ে মানুষ ঘুরে বেড়ায় না, টাকা বাক্সের ভিতরে রাখে; সমস্ত দামি জিনিস প্যাকেটের ভিতরে থাকে। এমন বক্তব্য কি শিক্ষা দেয়? নারীদের সম্মান করতে শেখায় না কি পণ্য ভাবতে শেখায়? নারীদের সম্মানিত করে না-কি বন্দী করে রাখতে চায়?

সমস্ত জায়গায় যারা ধর্মকে ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিল করতে চায়, ধর্মান্ধতা প্রচার করে চলেছে এবং করতে চায় তাদের প্রতিহত করতে হবে। আর এই প্রতিহত শুরু করতে হবে ব্যক্তি থেকে সর্বোচ্চ জায়গা পর্যন্ত। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় সহ সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। পোশাকের দোহাই ও বিচারহীনতা সংস্কৃতি একসঙ্গে পরিহার করে যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ সহ সকল অপরাদের বিচার দ্রুত শেষ করতে হবে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বস্তরে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বেড়া জাল ছিঁড়তে হবে। সমস্ত জায়গায় মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পেলে তবেই পরিপূর্ণ হয়ে ওঠবে স্বাধীনতা, জয় হবে সকল সংগ্রামের, প্রগতির হাত ধরে প্রগতিশীল হয়ে ওঠবে সমাজ তথা রাষ্ট্র।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

জাফর হোসেন জাকির পোশাকের স্বাধীনতা ও চিন্তার পরিচ্ছন্নতা মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর