বাল্যবিবাহ সমাজের অভিশাপ
২৯ অক্টোবর ২০২২ ১৭:৪৬
বিভিন্ন সমস্যার আবর্তে আমাদের দেশে বাল্যবিবাহ একটি মারাত্মক সমস্যা এবং সামাজিক অভিশাপ। গ্রামে-গঞ্জে এখনো মেয়েদেরকে ১২-১৩ বছর হলেই বিয়ের উপযুক্ত হিসেবে ধরা হয়ে থাকে এবং বিয়ে দেওয়ার জন্য অস্থির ও ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। অনেক অভিভাবকই বাল্যকালে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাবকে অত্যন্ত সম্মান ও লাভজনক মনে করেন। আর তাই দেখা যায়, ১২-১৩ বছরের মেয়ের ২৫-৩০ বছর কিংবা আরও বেশি বয়সের পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে এবং দরিদ্র কন্যাপক্ষও খুবই অল্প ব্যয়ে মেয়ের বিয়ে দিতে পেরে ভীষণ খুশি। অথচ এ ব্যাপারটি যে কত মারাত্মক, তা তারা একটিবারও বুঝতে পারে না। খেলাঘর ছেড়ে সংসার জীবনে গিয়ে বিরাট একটা দায়িত্ব তার কাঁধে চাপার ফলে এই অল্প বয়সী মেয়েটি বা স্ত্রীটি বিরাট এক সমস্যায় নিমজ্জিত থাকে। অপরদিকে, প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষটিও এই কম বয়সী স্ত্রীর কাছ থেকে তেমন সহযোগিতা না পাওয়ায় বিরাট সমস্যায় ভুগে থাকে। একমাত্র বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ বা বন্ধের মাধ্যমেই এসব সমস্যা দূর করা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞমহল তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন।
সংসারের দাম্পত্য বন্ধনের সুখই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সুখ। এই সুখের অভাবেই দাম্পত্য জীবন দুঃখ-বেদনায় ভরে যায়। বাল্যবিবাহ সমাজে স্বাভাবিক শৃংখলা নষ্ট করে এবং দাম্পত্য জীবনে অকালে ডেকে নিয়ে আসে নির্যাতন-অশান্তি। বাল্যবিবাহ আমাদের সমাজে জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ। এছাড়া বাল্যবিবাহের ফলে দেশে বিধবা ও তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পাশাপাশি বাড়িয়ে তুলছে সামাজিক নৈতিক অবক্ষয়। বাল্যবিবাহ সমাজে নিরক্ষর জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারী শিক্ষার হার হ্রাস করে এবং শিক্ষার অভাবে সহজেই বেড়ে ওঠে কুসংস্কার ও অজ্ঞতা। তাছাড়া বাল্যবিবাহের ফলে মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায় বলে পরবর্তী জীবনে তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। সহস্র অপবাদ-লাঞ্ছনা সয়ে পরিবারে বাস করতে থাকে একজন নির্ভরশীল সত্ত্বা হিসেবে।
বাল্যবিবাহের প্রচলন আমাদের গ্রামে-গঞ্জে এখনো লক্ষ্য করা যায়। পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বাল্যবিবাহের বিভিন্ন কারণের মধ্যে অশিক্ষা বা শিক্ষার অভাবই মূলত দায়ী। এছাড়াও আছে দারিদ্র্য, মেয়ে বড় হয়ে যাওয়ার অহেতুক ভীতি ও লজ্জা, কম যৌতুক অথবা বিনা যৌতুকে মেয়ে উদ্ধার (বিয়ে), পাত্রপক্ষের অক্ষত যৌন সম্ভোগের লালসা ইত্যাদি। অপরদিকে, ছোট বয়সে মেয়েদের স্বাধীনসত্ত্বা বিকাশের কোনো সুযোগ থাকে না বলে অভিভাবকরা যেমন খুব সহজেই তাদের ইচ্ছেমতো পাত্রের সঙ্গে (বয়স যা-ই হোক) কন্যার বিয়ে দিতে পারেন, তেমনি পাত্রপক্ষও একান্ত বাধ্য হিসেবে তাকে পাবার প্রত্যাশায় বাল্যবিবাহের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েন। আর এসব কারণেই এক শ্রেণির বিবেক-বুদ্ধিহীন জনগোষ্ঠী কর্তৃক বাল্যবিবাহের প্রচলন এখনো আমাদের বর্তমান সভ্য সমাজে টিকে আছে এবং এর ফলে উভয়পক্ষ সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
খেলাঘর থেকে উঠিয়ে আনা সেই অল্প বয়সী মেয়েটির জন্য ‘বিবাহ’ নামক সামাজিক প্রথাটি নিঃসন্দেহে বিরাট ক্ষতি বয়ে আনে এবং তাদের (স্বামী-স্ত্রী) শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া বা সমস্যা বেশি দেখা দেয়। বাল্যকালে বিয়ের ফলে সন্তান জন্মদানের ব্যাপারেও দেখা দেয় জটিলতা। শুধু তাই নয়, এই অল্প বয়সে সন্তান ধারণের ফলে মেয়েটির স্বাস্থ্যের ওপর বিরাট চাপ পড়ে এবং স্বাস্থ্যহানী ছাড়াও তাকে অকাল মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়। এছাড়া গর্ভের শিশুও সুস্থ-সবলভাবে ভূমিষ্ঠ হতে পারে না। অনেক সময় শিশুমৃত্যুর কারণ হয় কিংবা মৃত সন্তান জন্ম দেয়। চিকিৎসকদের মতে, বাল্যবিবাহের কারণে ঘন ঘন সন্তান হওয়ায় এবং অপরিষ্কার ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রসূত জীবনযাত্রায় অনেক মেয়েই জরায়ুর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। তাছাড়া অল্প বয়সে সন্তান প্রসব হওয়ায় এবং বিশেষ করে গ্রামীণ দাইদের প্রসব কাজে নিয়োজিত করায় খুব সহজেই তারা প্রসবোত্তর সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে মারাত্মক সমস্যায় ভুগে থাকে। বাল্যবিবাহের ফলে শুধু মেয়েরাই নয়, ছেলেরাও বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও সমস্যার সম্মুখীন হয়। অনেকে উপার্জনের আগেই সন্তানের পিতা হয়ে পরিবারের আর্থিক সমস্যা ডেকে আনে এবং এ সমস্যায় তারা অনেক সময় ভিন্ন পথ বেছে নেয়।
দাম্পত্য জীবন স্বামী-স্ত্রীর দৈহিক মিলনের ক্ষেত্রে উভয়েরই মানসিক সম্মতির ব্যাপারটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু এক্ষেত্রে স্ত্রী অল্প বয়সী ও অপ্রাপ্ত বয়স্কা হওয়ার কারণে তার মানসিক বিকাশ না হওয়ায় স্বামীর সঙ্গে দৈহিক মিলনে সম্মতি থাকে না এবং একটা ভয়-ভীতি তার মনে সারাক্ষণ কাজ করে বলে স্বাভাবিক দৈহিক আকাংক্ষাও তার থাকে না। ফলে স্বভাবতই স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধ্য হয় অথবা অবৈধ স্থানে দৈহিক সুখ খুঁজতে যায় এবং যৌন রোগের শিকার হয়। আর এর ফলে স্বামীর শরীরে আসা যৌনরোগ পরবর্তীতে সেই অল্প বয়সী স্ত্রীর শরীরে সংক্রমিত হয়ে যায়। এক কথায়, বাল্যবিবাহ স্বামী-স্ত্রী তথা গোটা সমাজের জন্য কুফল বয়ে আনে এবং শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়ায় দাম্পত্য জীবন হয়ে ওঠে বিষাদময় ও ভয়াবহ।
বাল্যবিবাহ সমাজের একটি প্রাচীন কুপন্থা হিসেবে দীর্ঘকাল থেকে বিবেচিত হয়ে আসছে। পরবর্তীতে এর ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আইন প্রচলিত হয়েছে এবং বেশ কয়েকবার আইনগুলোর সংস্কারও করা হয়েছে। বাংলাদেশের বিবাহ আইনে ছেলেদের সর্বনিম্ন বয়স ২১ বছর এবং মেয়েদের সর্বনিম্ন ১৮ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। ধারা ৭ এ বলা হয়েছে, যদি কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি (বর বা কনে যে-ই হোক না কেন) বাল্যবিবাহ করে থাকে, তবে তিনি সেই অপরাধে সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন এবং এরই সঙ্গে সর্বোচ্চ এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড পেতে পারেন। তিনি যদি অর্থদণ্ডের অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হন, তবে আরও তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড পেতে পারেন। অন্যদিকে, যদি কোনো অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি (বর বা কনে যে-ই হোক না কেন) বাল্যবিবাহ করে থাকে, তবে তিনি সেই অপরাধে সর্বোচ্চ এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন এবং এরই সঙ্গে সর্বোচ্চ পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড পেতে পারেন। উল্লেখ্য যে, যেহেতু ১৮ বছরের নিচে কোনো ব্যক্তি একজন শিশু তাই তার বিচার শিশু আইন, ২০১৩ অনুসারে হবে। তবে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিলে সেজন্য তারা কোনো সাজা ভোগ করবে না।
এ ধরনের একটি সহজ ও সাধারণ আইন থাকার কারণে আমাদের সমাজে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং উৎসাহী হচ্ছে। যদিও বাল্যবিবাহের খবর তেমন ফলাও করে প্রচার হচ্ছে না, তবু দেখা যায় আইনের এ সামান্য শাস্তিকে সহজভাবে হাসিমুখে গ্রহণ করে এক শ্রেণির লোভী ও অজ্ঞ জনগোষ্ঠী বাল্যবিবাহে মত্ত থাকছে এবং মদদ যোগাচ্ছে। এক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে আরও কঠিন শাস্তির বিধান করা উচিত বলে বিশেষজ্ঞমহল অভিমত প্রকাশ করেছেন। বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক অভিশাপ। এর প্রতিক্রিয়া যে কত ব্যাপক ও মর্মস্পর্শী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশে নারী অধিকার বাস্তবায়নের বিভিন্ন প্রচেষ্টা চললেও বাল্যবিবাহের সংখ্যা তেমনভাবে প্রতিরোধ সম্ভব হয়নি। অথচ এটি একটি বিরাট সমস্যা। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধকল্পে এবং এর ভয়াবহতা অনুধাবন করে সবাইকে মহান উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। জনগণকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। বিভিন্ন সংগঠককে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বাস্তব ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে হবে। পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও দারিদ্র দূর করতে হবে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কারসহ তা বাস্তবায়নে জোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি