আয়াতের মৃত্যু এবং আমাদের নষ্ট সমাজ
২৭ নভেম্বর ২০২২ ১৬:৫৪
শিশুদের একটি সুন্দর ও নিরাপদ ভবিষ্যত গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সকলের। রাষ্ট্রে অগ্রাধিকারের তালিকায় প্রথমে থাকে শিশু ও বৃদ্ধ। আজকের শিশু আগামী দিনের কর্ণধার। ওদের হাতেই সোনার বাংলা গড়ে ওঠার ভার। তাদের ওপর ঘটা নির্যাতন প্রতিরোধের দায়িত্বও আমাদের। কারণ শিশুরা অবুঝ এবং ভীত। ঠিক এই কারণেই শিশুদের ওপর নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসে। এই তালিকা থেকে বাদ যায় না কেউ। এমনকি বাবা-মা’র হাতেও শিশু হত্যার ঘটনা ঘটে। এছাড়া সমাজের অন্যানরা তো আছেই। একটি আলোকিত সমাজ গঠনে শিশুদের মুক্ত মনে বড়ে ওঠা একান্ত আবশ্যক। কিন্তু তা হচ্ছে না। শিশুরা বিভিন্নভাবে। সহিংসতার শিকার হচ্ছে। শিশুরা ধর্ষণ, অপহরণ ও হত্যাসহ বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার। প্রতি বছর শিশু নির্যাতনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি চট্রগ্রাম ও দিনাজপুরে ভয়ংকরভাবে শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনায় শিশুর নিরাপত্তার প্রতি উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। শিশু আয়তকে যেভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাতে দায় চাপে এই পঁচে যাওয়া সমাজের ওপর। সাত বছর বয়সী আয়াতকে প্রথমে মুক্তিপণের উদ্দেশ্যে অপহরণ করা হয় এবং এরপর তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেওয়া হয় নদীতে। মেয়েটি নিজেও জানে না সে এক নিষ্ঠুর সমাজের বাসিন্দা হয়ে পৃথিবীতে এসেছিল। একটি নিষ্পাপ শিশুকে এভাবে কেন প্রাণ দিতে হলো তার জবাব কে দিবে? সমাজের কিছু মানুষ যে পশুতে পরিণত হয়েছে তার খোঁজ কে রাখে। আবার পারিবারিক কলহের জেরে দুই ভাইকে তাদের পিতা বিষ খাইয়ে হত্যা করেছে। এভাবে শিশু হত্যা,নির্যাতন কোনো সুস্থ সমাজের কাজ হতে পারে না। তাছাড়া ঘটনা তো কেবল এই দুটি নয়। শিশু নির্যাতন হচ্ছে। ধর্ষণ হচ্ছে। আমরা তা ঠেকাতে পারছি কোথায়?
আমাদের দেশে শ্রমক্ষেত্রে প্রায়ই শিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বিকৃতমনা কিছু মানুষ শিশুদের ওপর যথেচ্ছ নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির গৃহকর্মী থেকে শুরু করে রাস্তার পাশে ওয়েল্ডিং কারখানায় কাজ করা শিশু সব জায়গাতেই নির্যাতিত হচ্ছে। এর কারণ মনে হয় শিশুর অসহায়ত্ব এবং শারীরিক দুর্বলতা। কারণ যে শিশু শারীরিক শ্রম দিয়ে অর্থ উপার্জন করে সে বাধ্য হয়েই কাজ করে। শিশুদের সমাজে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিবেশ। সেই পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব আমাদের বড়দের। শিশু বান্ধব পরিবেশ বলতে যা বোঝায় তা সৃষ্টি করা জরুরি হয়ে দাড়িয়েছে। ঘরে, বাইরে শিশুদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতন বলতে আমরা যদি কেবল শারীরিক প্রহারকে বুঝি তাহলে মস্ত ভুল হবে। শারীরিক এবং মানসিক উভয় প্রকার নির্যাতনকেই এর আওতায় বিবেচনা করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে একটি জোরে ধমক বা চিৎকারও কিন্তু শিশুমনে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। আর ্এ কাজে সবাইকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত দেশের ১১টি জেলায় মোট পাঁচ হাজার ৭৪ জন শিশুর ওপর একটি জরিপ করে যে তথ্য পায় সেখানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৯৬ ভাগ শিশু তাদের ঘরেই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,কর্মক্ষেত্র ও বিভিন্ন স্থানে প্রায় একইভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তারা। শিশুরা ফুলের মত পবিত্র। সমাজের প্রতিটি শিশুই সমান অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো যে, সমাজে সকল শিশু সমান অধিকার নিয়ে জন্মায় না। বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সমাজে শিশুদের নির্যাতন ও নিগৃহের শিকার হতে হয়। এবং প্রায়ই তা আমাদের মত বড়দের কাছেই হয়। শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে সচেতনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সচেতনার অভাবে এই নির্যাতনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অভাব, দারিদ্রতা, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা, পেশীশক্তির প্রভাব এসব কারণে শিশু হত্যা, ধর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশে^র অধিকাংশ দেশগুলিতেই দেখা যায় শিশুরা মারাত্বক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। ক্ষেত্রবিশেষে তারা বেশিরভাগই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ কাজ করছে। এর প্রধান কারণ অবশ্য দারিদ্রতা। দারিদ্রতাই আমাদের দেশের বহু শিশুর মত সারা বিশে^র শিশুদের পরিশ্রমে বাধ্য করছে। শিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শিশুরা তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কবি সুকান্তের ভাষায়, এ পৃথিবী শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার। শিশুর জন্য এ পৃথিবী নিরাপদ হিসেবে গড়ে তুলতে আমাদেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি