Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিশু শ্রমিকের কান্নার শেষ কোথায়

রাশেদুজ্জামান রাশেদ
১১ ডিসেম্বর ২০২২ ১৬:১২

বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। টেকসেই উন্নয়ন আর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া কি আদৌও সম্ভব? উত্তর সহজ সরল। কলমের মাথায় কিংবা খাতার পৃষ্টায় সেটা সম্ভব। কেন এমন বললাম কারণ বলা হয়ে থাকে শিশুরা জাতির কর্ণধার। আজকের শিশু আগামী দিনের সম্পদ। অর্থাৎ কোনো দেশকে উন্নয়ন করতে হলে সেই দেশের জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা একান্ত প্রয়োজ। গবেষকদের গবেষণায় পাওয়া যায় যে জাতি শিক্ষায় যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গেছেন একজন স্বাস্থ্যবান ব্যক্তির দেহের সমস্ত রক্ত যদি মুখের জুড়ো হয় তাহলে সেই ব্যক্তিকে সুস্বাস্থ্য বলা যায় না ঠিক তেমনি কোনো দেশে বড় বড় দালাল কোঠা দেখে সে দেশের উন্নয়ন বলা যায় না। আমাদের দেশের উন্নয়ন যেন ঠিক ওই অসুস্থ্য ব্যক্তির মত হয়েছে। তাই বর্তমান সংকট মুহূর্তের পরিস্থিতিতে বড় বড় সংকট গুলোর ভিরে যেন গতিশীল সংকট গুলো চাপা পড়ে যায়। তবে সেই সংকট নিয়ে আলোচনা হয় কোনো দিবস ভিত্তিক। তাছাড়া তেমন জড়াল ভাবে আলোচনা কিংবা সংবাদমাধ্যের পাতায় দেখা যায় না। তেমন আলোচনায় না আসা মধ্যে বাংলাদেশের বড় সমস্যা শিশুশ্রম।

বিজ্ঞাপন

তবে শিশুশ্রম বলার আগে সাংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক খবরের শিরোনাম দেখে মনে হয় শিশুদের জন্য যে নিরাপদ পরিবেশ করতে না পারার ঘাটতি অনেক। কারণ মুখে বলা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে এখনও জাত পাতের কবলে শিকার শিশুরা। অথচ কত শত মুখরোচক কথার ফুলঝুরি শুনা যায় শিশুকে ভালোবাসে না এমন মানুষ কোথায় নেই। আর এই ভালোবাসাকে শ্রেণিকরণ করাও সম্ভব না। কিন্তু সেটা হয়তো উন্নত দেশের কথা। আর বাংলাদেশের চিত্রটা একটু ভিন্ন যেমন আমরা দেখতে পাই হরিজন শিশুরাও বসতে পারে না হোটেলে, কাগজে খাবার নিয়ে খেতে হয় বাইরে।

ঘটনাটি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলা শহরের রেলওয়ে কলোনির রাবেয়া আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টিফিনের সময় বাকি সব শিশু হোটেলে বসে খেতে পারলেও হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েরা ঢুকতে পারে না। তারা স্কুল ড্রেস পরা থাকলেও কাগজে নাস্তা দেয়, ময়লা পাত্রে পানি দেয়, আর বসতে হয় হোটেলের বাইরে। কি অপরাধ হরিজন সম্প্রদায়ের ছোট্ট সোনামণিদের? কেন একই স্থানে বসে খেতে পারবে না?

এমন বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ড একটি স্বাধীন দেশে কি করে হতে পারে? এই বৈষম্যমূলক আচারণে জাতির লজ্জিত হওয়ার কথা। একই দেশ, একই পরিবেশ অথচ জাতের ভিন্নতায় মানুষে মানুষে ঘৃণা করা হয়। যখন প্রকৃতি আমাদের আলো, বাতাস, পানি ও অক্সিজেনসহ আরও অনেক কিছু নিঃস্বার্থ ভাবে দিয়ে মানবজাতিকে বাঁচিয়ে রাখে তখন প্রকৃতি তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা কোনো শ্রেণিবিভক্ত করে দেয় না। তাহলে প্রকৃতির মধ্যে বসবাসকারী মানুষের এত বিভাজন কারা করে? দেশে শুধু হরিজন সম্প্রদায়ের শিশুরা বৈষম্যের শিকার নয় অপ্রকাশিত কোটি সর্বহারা মানুষের সন্তান বৈষম্যের শিকার।

নতুন প্রজন্মের জন্য আমরা কেমন পৃথিবী রেখে যাব? যে পৃথিবীতে মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে নানা কারণে তারাই অংশ হিসেবে আমাদের বাংলাদেশকে নতুন প্রজন্মের জন্য কেমন দেশ রেখে যাচ্ছি তা বিশ্লেষণ করা জরুরি। গবেষণার কথা আমাদের দেশের প্রতিটি শিশু ৬০ হাজার টাকার ঘাটতি বাজেট নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাহলে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন আসে শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরী করতে পারতেছি? উত্তর হচ্ছে পারছি তবে এদেশের পুঁজিবাদী সন্তানদের জন্য সকল আয়োজন আছে আর গরীব অসহায় মানুষের সন্তানদের জন্য কোনো আয়োজন নেই বরং সবাই মিলে হোটেলে বসে খাওয়া যেন বড় অন্যায়। এক সাথে বসে খাওয়ার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। এর শেষ কোথায়?

প্রকৃতির নিয়মে মানুষ যখন জন্মগ্রহণ করে ভূপৃষ্ঠে আসে। তখন কোনো শিশুর গায়ে লেখা থাকে না কে হিন্দু, কে মুসলিম, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিষ্টান অথবা কে নিচু জাতের ইত্যাদি কোনো কিছু লেখা থাকে না। পৃথিবীতে তার বড় পরিচয় সে শিশু এবং মানুষ। তাহলে স্পষ্ট বুঝা যায় পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের ভেদাভেদ তৈরী করে। শিশুদের পণ্যে পরিণত করে। যারা শিশুদের শ্রমিক বানায় যারা শিশুদের পথশিশু বানায় তারা কি দেশপ্রেমিক হতে পারে?

যে বয়সে শিশুরা বই হাতে নিয়ে বিদ্যালয়ে সোনালী শৈশব অতিবাহিত করার কথা। কিন্তু তা না হয়ে সে বয়সে তাদের ইটভাটা কিংবা শিল্পকারখানায় শ্রমিক হিসেবে পরিচয় দিতে হয়। এছাড়াও হোটেল, মোটেল, লঞ্চ, বাস, ইটভাটা, পাথর ভাঙা, মোটর গ্যারেজ, অ্যালুমিনিয়াম কারখানা, কলকারখানা, বাসাবাড়ি, মিষ্টি ও বিস্কুট ফ্যাক্টরি, তামাকশিল্প, চামড়াশিল্প, চাশিল্প, তেপ তোশকের কারিগর, ভারী শিল্প প্রভৃতিতে প্রতিনিয়ত দেখা যায় শিশুশ্রমের নির্মম চিত্র। দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাতে জর্জরিত পরিবারের সন্তানরা দুবেলা দুমুঠো ভাত মুখে দেওয়ার জন্য নিরুপায় হয়ে শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ে। তেমনি উদাহরণ হিসেবে বলা যায় তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া আলিফ হোসেন।সে জয়পুরহাট শহরের কেন্দ্রী ইদগা মাঠে লেপ-তোশক তৈরির কারিগর।

তার বাড়ি সদর উপজেলার কুটিবাড়ী ব্রিজের পাশের গ্রামে। বাড়িতে বাবা,মা ও ছোট্ট ভাই আছে। তার বাবা গত কয়েক বছর আগে পা হারিয়ে পঙ্গু হয়ে বিছানায় জায়গা করে নিয়েছেন। তার মা মানুষের বাড়িতে গৃহিণী হিসেবে কাজ করেন। কাজের বিনিময়ে যে টাকা পায় তা দিয়ে তাদের চার সদস্যের সংসার চালানো হিমশিম। শিশু শিক্ষার্থী এ বয়সে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলার আড্ডায় না যেয়ে সংসারের হাল ধরেছেন। প্রতিদিন স্কুলের ক্লাস শেষ করে কোনো খেয়ে না খেয়ে শহর আসে কাজের সন্ধানে। কাজও পেয়ে যায় তারপর ‘সুই আর সুতা’ নিয়ে জীবন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন লেপ-তোশক তৈরীর কাজে। প্রতিদিন মজুরি হিসেবে ১০০ টাকা পায়। এ টাকা দিয়ে তার লেখাপড়ার খরচ চলে। আর বাকী অবশিষ্ট টাকা তার মায়ের কাছে জমা দেন।

দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাতে থাকা শিশুদের জীবনের বাস্তব গল্প দেখে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন আসে শিশুর জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরী না করে শিশু শ্রম বন্ধের স্লোগান দেওয়া কি উচিত? শিশুর বয়সসীমা ও শিশুশ্রম নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২(৬৩) ধারায় ‘শিশু’ মানে ১৪ বছর বয়স পূর্ণ করেনি এমন কোনো ব্যক্তিকে বোঝায়। ২০১১ সালে জাতীয় শিশুনীতি ২-১ ধারায় শিশু বলতে ১৮ বছরের কম বয়সি কোনো ব্যক্তিকে বোঝায়। আর আইএলওর জরিপ অনুযায়ী, পৃথিবীতে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৩৬ কোটি ৬০ লাখ। প্রতি ছয়জন শিশুর মধ্যে একজন শিশুশ্রমে নিযুক্ত। পাচার, সন্ত্রাস, নির্যাতন প্রভৃতি কারণে প্রতিবছর প্রায় ২২ হাজার শিশু মারা যায়।

শ্রম অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ৬৯ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে। ইউনিসেফের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশে শিশুর সংখ্যা ছয় কোটিরও বেশি। ৯০ শতাংশ প্রাথমিকভাবে স্কুলে গেলেও শিক্ষা সমাপ্ত করার আগেই অর্ধেকের বেশি ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা যায়, ৫৭ শতাংশ শিশু কেবল খাদ্যের বিনিময়ে শ্রম দিচ্ছে। ২৩.৭ শতাংশ শিশুকে মজুরি দেওয়া হলেও এর পরিমাণ শিশু আইনের তুলনায় নগণ্য। স্বাধীনতার ৫১ বছরের বাংলাদেশে চিত্রটা এমন যে লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্টের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রায় ২০-২৫ লাখ পথশিশু আছে।

এসব শিশু অভাবের তাড়নায় অলিখিত ভাবে পথ শিশুর খাতায় নাম দিয়েছে। শিশুদের স্বপ্ন ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে তবুও শিশুদের নিরাপত্তা কিংবা তার শিক্ষার পরিবেশ দিতে রাষ্ট্র কেন পারছে না? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিশুশ্রমের প্রধান কারণ হলো ‘অর্থনৈতিক বৈষম্য। অবহেলায় অব্যবস্থাপনায় আজকে শিশু যেন আগামীর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।

সময় এসেছে সকল জাতপাত ভুলে বড় পরিচয় মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা করতে। টেকসেই উন্নয়ন আর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে বিশেষ নজর দিতে হবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতি। শিশুদের শ্রম থেকে মুক্তি দিয়ে ফিরিয়ে দিতে হবে তাদের দুরন্ত শৈশব, করে তুলতে হবে শিক্ষার আলোয় আলোকিত। শিশু শ্রমিকদের প্রতি অমানবিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। তাদের শিক্ষার আলোর পথ দেখাতে হবে। দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে।অমানবিক শিশুশ্রম বন্ধে মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ১৪ বছরের কম শিশুদের সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধান করতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধে গ্রাম ও শহরভিত্তিক পুনর্বাসন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

যেসকল অভাবের কারণে যারা শিশুশ্রমে নিয়োজিত হচ্ছে, তাদের তালিকা তৈরি করে শিশু ভাতা প্রদান করতে হবে। শিশুশ্রম নিরসনে যেসব আইন রয়েছে, তা বাস্তবায়নে সরকারকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শিশুশ্রম এবং শিশুদের অধিকার সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। শিশুশ্রম নিরসনের জন্য কোথায় কোথায় শিশুশ্রম হচ্ছে, তা খুঁজে বের করা দরকার এবং গণমাধ্যমে এ বিষয়ে বেশি বেশি প্রচার করতে হবে। দেশের শিশুশ্রম কমিয়ে আনতে মৌলিক অধিকার গুলো নিশ্চিত করে সুনির্দিষ্টভাবে আইনের প্রয়োগ ও কঠোর শাস্তির বিধানের মাধ্যমে শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে। তা না হলে দেশ ও জাতি অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। তাই রাষ্ট্রের উচিত শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ হরিজনের শিশু আর শিশু শ্রমিকের কান্না শেষ কোথায়

বিজ্ঞাপন

বাঘায় কৃষককে গলা কেটে হত্যা
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৬:৪৩

আরো

সম্পর্কিত খবর