বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী ও কীটপতঙ্গ; মানুষ কতদিন টিকবে
১১ ডিসেম্বর ২০২২ ১৮:২৫
মানুষের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ এবং গ্রহণযোগ্য আবাসস্থল হিসেবে স্বীকৃত এই পৃথিবী। সবুজ শ্যামল এই ধরণীর বুকে কোটি কোটি প্রাণীর বাস। পৃথিবীর শুরু থেকেই মানুষ প্রকৃতির সাথে লড়াই করে নিজের অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রেখেছে। প্রতিকূল পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পেরে বহু প্রাণী ও উদ্ভিদ হারিয়েও গেছে। এর মধ্যে আমাদের পরিচিত ডাইনোসরের কথা উল্লেখযোগ্য হিসেবে বলা যায়। ছোট বড় বহু প্রাণীর অস্তিত্বই হারিয়ে গেছে। আরও বহু প্রাণী সেই তালিকায় স্থান পেতে চলেছে। এভাবে হয়তো একদিন বিপন্ন হবে মানুষের অস্তিত্ব। এই চিন্তা থেকে মানুষ পৃথিবীর বাইরে কোনো গ্রহে বসবাসের উপযুক্ততা খুঁজে পেতে সংগ্রাম করছে। কিন্তু এখনও উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। শেষ পর্যন্ত কি হবে তা সময়ই বলবে। এখনও পৃথিবীতেই আশ্রয় খুঁজে নিতে হচ্ছে মানুষকে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এই হুমকি আরও বেড়েছে বহুগুণে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীতে কীটপতঙ্গ সংখ্যায় মানুষের অন্তত ১৭ গুণ বেশি। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে একশ বছরের মধ্যে তাদের ৬৫ শতাংশই বিলুপ্ত হতে পারে। ন্যাচার ক্লাইমেট চেইঞ্জ জার্নালে সম্প্রতি গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগীতায় এতে অংশ নেয় নাসা ও একাধিক দেশের বিজ্ঞানী। গবেষণায় বলা হয়েছে, তাপমাত্রার ভারসাম্যহীনতার কারণে প্রাণীর জনসংখ্যা প্রভাবিত হয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে আগামী ৫০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে ৩৮ প্রজাতির কীটপতঙ্গের ৬৫ শতাংশ বিলুপ্ত হতে পারে। বিশেষ করে শীতল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বলা হচ্ছে, ফুল,ফল, সবজির ফলনে পতঙ্গের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে তারা বিলুপ্ত হলে মানুষের জীবনধারণও হুমকির মুখে পরবে। ফলে মানুষের অস্তিত্ত্বও হুমকির মুখে পড়বে।
বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিলের (ডব্লিউডব্লিউএফ) তাদের এক প্রতিবেদনে বলছে, ১৯৭০ সালের পর থেকে পৃথিবীতে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমে গেছে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি। পাঁচ হাজারের বেশি প্রজাতির প্রায় ৩২ হাজার বন্যপ্রাণীর অবস্থার বিষয়ে জেডএসএলের ২০১৮ সালের তথ্য ব্যবহার করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে দেখা গেছে, ৬৯ শতাংশ বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমে গেছে। আরও জানা যায়, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি কমে গেছে। ওই অঞ্চলগুলো মাত্র পাঁচ দশকে ৯৪ শতাংশ বন্যাপ্রাণী হারিয়েছে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রাজিলের আমাজনে পিংক রিভার ডলফিনের সংখ্যা ১৯৯৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ৬৫ শতাংশ কমেছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার প্রভাবজনিত বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতি বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়। প্রকৃতি এবং প্রাণ ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। প্রকৃতি ধ্বংস হলে তা প্রাণের ধ্বংসও অনিবার্য। প্রকৃতির একটি উপাদানও বিনষ্ট হলে শৃঙ্খল নষ্ট হয়। যার প্রভাব থাকে সুদূরপ্রসারী। প্রকৃতি বলতে পৃথিবীতে সৃষ্প প্রতিটি প্রাকৃতিক উপাদানকেই বোঝায়। যার ওপর ভর দিয়ে মানব সভ্যতা এগিয়েছে। আমাদের খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা সবকিছুর যোগান পাই প্রকৃতি থেকে। মানুষ নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংস করেছে, এখন প্রকৃতি তার পাল্টা আচরণ করছে। আমরা যা আশা করি না তেমন রুদ্র রূপ দেখতে হচ্ছে। প্রকৃতি নিজেই নিজের অবস্থান পাল্টাচ্ছে যা মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলছে। বছরের বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নানা রোগ ব্যাধি পৃথিবীকে গ্রাস করছে।
জাতিসংঘ বিজ্ঞানীদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মানুষের হাতে বিশ্ব উত্তপ্তকারী বিপজ্জনক গ্যাস নির্গমন অব্যাহত থাকলে চলতি শতাব্দীর শেষদিকে সমুদ্রের পানির উচ্চতা দুই মিটার পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আগামী দশকগুলোতে বৈশ্বিক উষ্ণতা কিভাবে বিশ্বকে বদলে দেবে তা এই প্রতিবেদনে বিস্তারিত ফুটে উঠেছে। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়াসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরও বেশি সামনে এনেছে। ২০৫০ এ বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়বে ৩ ডিগ্রী। বাংলাদেশে এখনই বেড়ে গেছে ২.৭৪ ডিগ্রী। অর্থাৎ প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের সাথে মানুষের অস্তিত্বও হুমকির মুখে। সে কারণেই মানুষ হন্য হয়ে মানুষ অন্য গ্রহে ছুটে চলেছে। কিন্তু আদৌ মানুষ কোনোদিন অন্য কোনো গ্রহে তাদের বাসযোগ্য ঠিকানা খুঁজে পাবে কি? এটি এখনও অমিমাংসিত প্রশ্ন।
প্রকৃতিকে আমরা যতই হালকাভাবে দেখি না কেন এটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এর ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন ছিল। দীর্ঘদিনের এই ধ্বংসাত্বক কর্মকান্ড পরিবেশ পরিবর্তন করছে। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে। এই জলবায়ু পরিবর্তনই এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম কারণ। আমাদের বেঁচে থাকলে হলে প্রকৃতির রক্ষা করতে হবে। মানব সভ্যতার টেকসই নিরাপত্তা, খাদ্য শৃঙ্খলা রক্ষা করা,সুরক্ষা এবং সংরক্ষণের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ করতে হবে। প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো গাছপালা। মানুষ তার নিজের কাজের জন্য, সভ্যতার উন্নয়নের দোহাই দিয়ে গাছ কেটেই চলেছে। যেখানে আমাদের কোটি কোটি গাছ লাগাতে হবে পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য সেখানে আমরা সামান্য কারণেই গাছ কেটে সেখানে নির্মান করছি। একটি গাছ কেবল মানুষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয় প্রকৃতির অন্যান্য বহু প্রাণীরও আবাসস্থল। পরিবেশের সবকটি উপাদান পানি, বায়ু, মাটি এবং শব্দ এই সব দূষণ ঘটছে মারাত্বকভাবে। যার ফলও হাতেনাতেই পাচ্ছে মানুষ। কারণ এটা নির্ভর করছে মানুষের চরিত্রের ওপর এবং এটা মনে করার কোনো কারণ নেই হঠাৎ মানুষ নিজেকে বদলে ফেলবে। মানুষ নদী দখল করবে না, পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করবে, বনভূমি উজাড় করে সেখানে কৃষিজমি করবে অথবা অট্ট্রালিকা গড়বে।
সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে যে দেশগুলো সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পরবে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের বাস্তুভিটা হারাবে। এসব আশ্রয়হীন মানুষ জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে শহরমুখী হবে। এর ফলে বহুমুখী সমস্যা তৈরি হবে। প্রকৃতির পরিবর্তন আমাদের খাদ্য শৃঙ্খল,অভ্যাস ও জীবনধারা প্রভৃতির পরিবর্তন করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট বাড়ছে। প্রকৃতি সংরক্ষণ করতে হলে দরকার বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা। আজকের প্রকৃত মানুষের নির্মমতার শিকার। আর মানুষ এখন সেই কর্মকান্ডের ফল ভোগ করছে। যদি আমরা আমাদের অবস্থান পরিবর্তন না করি তাহলে ভবিষ্যতে এর ফলও আমাদেরই ভোগ করতে হবে। বহু উদ্ভিদ ও প্রাণীর সাথে মানুষও একদিন এই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে আর তার হাত থেকে আমরা কেউ বাঁচতে পারবো না।
লেখক: কলামিষ্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
অলোক আচার্য বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী ও কীটপতঙ্গ; মানুষ কতদিন টিকবে মুক্তমত