স্যার ফজলে হাসান আবেদ, নেতৃত্ব গড়ার অপ্রতিদ্বন্দ্বী কারিগর
২১ ডিসেম্বর ২০২২ ১৬:৩৮
মানুষের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা নিয়ে কাজের স্বপ্ন দেখলে একজন মানুষ তার চারপাশ, তার দেশ, এমনকি পৃথিবীও বদলে দিতে পারেন। যেমনটা বদলে দিয়েছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বিশ্বজুড়ে কোটি মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার কারিগর ছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ‘আমি’ নয়, ‘আমরা’ শব্দে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। তার শিক্ষা ও উন্নয়ন চিন্তার কেন্দ্রে ছিল সাধারণ মানুষ। সারা জীবনের বিচিত্র ও বহুগামী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ব্যাপকসংখ্যক দরিদ্র মানুষের জীবনে পরিবর্তন সাধনে ভূমিকা রেখেছেন। দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার প্রভৃতি ক্ষেত্রে তার প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাকের অবদান অনস্বীকার্য। ব্র্যাক এবং এর বিভিন্ন উদ্যোগকে টেকসই করা এবং এর সুফলকে বিস্তৃত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে জোর দিয়েছিলেন।
কার্যকর, বিশ্বাসযোগ্য ও নিয়মের ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান গড়া বাংলাদেশে সবচেয়ে কঠিন কাজ। এ কাজটিই স্যার ফজলে হাসান আবেদ করে গেছেন। তার ছিল ‘হ্যান্ডস অন অ্যাপ্রোচ’। তিনি সব কর্মকাণ্ডের ওপর সার্বিক নজর রাখতেন। তার লক্ষ্য ছিল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কল্যাণকর ফলাফলের ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করা। শিক্ষার প্রতি স্যার ফজলে হাসান আবেদের ছিল গভীর অনুরাগ। তিনি বিশ্বাস করতেন অল্প সময়ের মধ্যে যেসব বিষয় মানুষের জীবন পাল্টাতে পারে, শিক্ষা তার মধ্যে অন্যতম। এজন্য তিনি ব্র্যাকের শুরু থেকেই শিক্ষা কার্যক্রমের নব নব উদ্ভাবন ও এর উন্নয়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। বয়স্ক শিক্ষা, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা মডেলে শিশুশিক্ষা, শিখনসমাজ গঠনে গণকেন্দ্র পাঠাগার স্থাপন এবং কিশোর-কিশোরী উন্নয়নে কিশোরী ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিটি বিষয়ই তার নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন। বাংলাদেশের হাওড়-বাওড়, চরাঞ্চল এবং দুর্গম পাহাড়ের বিস্তীর্ণ জনপদের অবহেলিত প্রতিটি শিশু যাতে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাতে পারে সেজন্য তার ছিল গভীর মমতা। এ লক্ষ্যে অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে সারাদেশে হাজার হাজার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই সকল স্কুলের শতভাগ শিক্ষক নারী। নারী উন্নয়ন ও নরীর ক্ষমতায়নে এটিও ছিল তার একটি নব উদ্ভাবন। স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চর্চা ও অনুশীলনের ব্যবস্থা রেখেছিলেন যাতে শিক্ষার্থীরা এই চর্চার মাধ্যমে নিজেদের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ ঘটাতে পারে।
ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন ঐ অঞ্চলের জমিদার। স্যার ফজলে হাসান আবেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে ও পরে ব্রিটেনের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। সামাজিক উন্নয়নে তার অসামান্য ভূমিকার জন্য জীবনে তিনি অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দারিদ্র্য বিমোচন এবং ক্ষমতায়নে বিশেষ ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘নাইটহুড’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
মহান ও মহৎ হৃদয়ের প্রচারবিমুখ মানুষটি পৃথিবীর সব কিছুর মায়া-মমতা ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর। জীবনে যিনি শুধু স্বপ্ন দেখেননি, স্বপ্নকে কীভাবে বাস্তবে রূপ দিতে হয় সেটাও শিখিয়েছেন এ প্রবাদপুরুষ মানুষটি। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি বিচরণ করেছেন এবং সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছেন। একথা স্বীকার করতেই হবে যে, জীবনের পরতে পরতে অভিজ্ঞতা, লব্ধজ্ঞান, নিজের উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি আজ তাকে সমগ্র বিশ্বে পরিচিত করে তুলেছে। তার মন ও মননে সার্বক্ষণিক চিন্তা ছিল দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষিত জাতিগঠন। সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সৃষ্টিশীল ও মেধা বিকাশের স্বার্থে যে কোনো সৃজনশীল উদ্যোগকে তিনি সর্বদা স্বাগত জানিয়েছেন, পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, পাশে দাঁড়িয়েছেন, অর্থ জুগিয়েছেন। আর এখানেই তার কর্মময় জীবনের সার্থকতা। স্যার ফজলে হাসান আবেদের কর্মজীবন এবং দর্শন নিয়ে চর্চা করলে একটি সত্য খুব সহজেই অনুমেয় হয়, তিনি ছিলেন সত্যিকার উন্নয়নের বিশ্বনায়ক, অগ্রগতির মহানায়ক। তিনি অমর তার কাজের মাধ্যমে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ আছেন, থাকবেন বিশ্ববাঙালির হৃদয়ের মনিকোঠায় চিরদিন স্বমহিমায়।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
মুক্তমত মো. মেহেদী হাসান অর্ণব স্যার ফজলে হাসান আবেদ- নেতৃত্ব গড়ার অপ্রতিদ্বন্দ্বী কারিগর