Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বই উৎসব; অপেক্ষায় কোটি-কোটি শিক্ষার্থী

অলোক আচার্য
২৬ ডিসেম্বর ২০২২ ১৪:১৫

প্রতি বছরের মতো ২০২৩ সালের প্রথম দিনেই বই হাতে উল্লাসে মেতে ওঠার অপেক্ষায় কোটি শিক্ষার্থী। মাত্র কয়েকদিন পরেই সেই মহোৎসবের দিন। নতুন দিনে নতুন বই- চমৎকার এক মুহূর্ত। শিক্ষার্থীর কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো বই। আর সেই বই যদি নতুন হয় তাহলে তো কথাই নেই। বর্তমান সরকারের অনেক সাফল্য রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এবং আমার কাছে সবচেয়ে বড় বলে মনে হয় বিনামূল্যে বই বিতরণ করার মতো মহাযজ্ঞ। একসাথে একদিনে দেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থী এবং তার পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো সহজ কথা নয়। সেই কঠিন কাজটিই করেছে বর্তমান সরকার। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। করোনার কারণে বই উৎসব না হলেও নতুন বই বিতরণ ঠিকই হয়েছে। এই করোনাকালীন দুশ্চিন্তার মধ্যেই হাসি ফটেছে কচিকাঁচাদের মুখে। বই লেখাপড়ার প্রধান উপকরণ। বছরের শুরুতেই নতুন বই পৌছে গেছে দেশের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রীর হাতে। আমরা একটি সুন্দর নতুন বছর শুরুর প্রত্যাশা করি। এর থেকে নতুন বছরে ভাল শুরু একটি দেশে আর কিছুই হতে পারে না। চমৎকার একটি উৎসব মুখর পরিবেশের মধ্যে দিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে নতুন বছর শুরু হয়। বলা যেতে পারে এর থেকে নির্মল হাসির উৎস আর দ্বিতীয়টি নেই। নতুন বই হাতে নিয়ে তার গন্ধ বুকে টেনে নেওয়ার যে অনুভূতি তা সত্যি অসাধারণ। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে ২০২২ (চলতি শিক্ষাবর্ষ) সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে মোট ৪শ’ ৩৫ কোটি ২৪ লাখ ৯০ হাজার ৪১ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের স্তরের মোট ৪ কোটি ৯ লাখ ১৫ হাজার ৩৮১ শিক্ষার্থী ধরে নিয়ে পাঠ্যপুস্তক ছাপা হচ্ছে। এসব শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যে ৩৩ কোটি ৪৮ লাখ ৭৬ হাজার ৯২৩ কপি পাঠ্যবই ছাপছে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। প্রাক-প্রাথমিক ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বইসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে। মোট বইয়ের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বিভিন্ন ভাষার শিক্ষার্থীদের জন্য মোট ৯ কোটি ৬৬ লাখ ৮ হাজার ২৪৫টি বই ছাপা রয়েছে। অন্যদিকে মাধ্যমিকে (স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি) স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য ২৩ কোটি ৮২ লাখ ৬৭ হাজার ৯৪৫ কপি বই ছাপা হচ্ছে। এসব বই দিতে সরকারের বছর প্রতি খরচ হচ্ছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি। সোয়া চার কোটি শিক্ষার্থীদের মাঝে এসব বই বিতরণ করা হয়েছে পাঠ্যপুস্তক। ছোট ছোট কোমলমতি ছাত্রছাত্রীর হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার আনন্দ অনুভব করতে পারেন শিক্ষকরা। যে বিপুল আগ্রহ নিয়ে ওরা নতুন বইয়ের জন্য অপেক্ষা করে তার তুলনা যেন আর কিছুতেই হয় না। এই আনন্দের, উৎসাহের সত্যিই কোন তুলনা করা যায় না। সন্তান যখন নতুন বই নিয়ে খুশি মনে বাড়ি ফেরে তখন সেই খুশি স্পর্শ করে তার অভিভাবককে। হাসি ফোটে তার মুখেও। বার্ষিক পরীক্ষার পর থেকেই দেশের কোটি কোটি কচি মুখ অপেক্ষা করে থাকে নতুন বইয়ের জন্য।

বিজ্ঞাপন

নতুন বই বাড়িতে নিয়ে তা উল্টে পাল্টে দেখা, বই যেন নষ্ট না হয় তার জন্য মলাট লাগানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। কোন হতদরিদ্র পরিবারের শিশুর মুখে এই চিন্তা থাকে না যে বছরের শুরুতেই তাকে বই কিনতে হবে। যদি তা থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই বছরের শুরুটা ভালো হতো না। তার অভিভাবকের মুখেও চিন্তার কোন ভাঁজ থাকে না যে সন্তানের নতুন বইয়ের যোগান সে কিভাবে দেবে। বিনামূল্যে বই প্রদানের এই সময়ের আগেও ছাত্রছাত্রীরা বছরের প্রথমে বই পেয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নতুন নয় পুরাতন। তা স্কুল থেকে দেয়া হয়নি। নিজ উদ্যোগে খোঁজ খবর করে উপরের ক্লাসে প্রমোশন পাওয়া কোনো ছাত্রছাত্রীর বই কিনতে হয়েছে। এই বই আবার নতুন বইয়ের অর্ধেক দামে কিনতে হয়েছে। এখানেও প্রতিযোগীতা করে কিনতে হয়েছে। এমনকি গাইড বইও কিনতে হয়েছে এভাবেই। আমাদের সময়ের কথাই যদি বলি। এখনকার মতোই বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হতো। আর আমরা দুঃশ্চিন্তায় কাটাতাম যে নতুন বই পড়তে পারবো তো। কারণ ফল প্রকাশের পরপরই আশেপাশের বইয়ের দোকানগুলোতে বই কিনতে রীতিমত হুড়োহুড়ি পরে যেত। এখনকার ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিষয়টা রীতিমত অবাক করার। এরা জানেও না একসময় এই নতুন বইয়ের জন্য লাইব্রেরিতে গিয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এক সময় এই ঘটনা কেবল গল্পের মত মনে হবে। যারা তুলনামূলকভাবে পয়সাওয়ালা তাদের সন্তানদের তেমন কোন সমস্যা হতো না। কিন্তু যাদের নতুন বই কেনার সামর্থ্য থাকতো না তারা পুরাতন বই দিয়েই বছর শুরু করতো। এমন হতো যে দুই তিনটি নতুন বই বহু কষ্টে কিনে দিতে পারলেও অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর প্রথম দুই তিন মাস সেই দুই তিনটি নতুন বই দিয়েই কেটে যেত। সবগুলো নতুন বই পেতে অনেকেই বছরের অর্ধেক সময় অপেক্ষা করেছে। আর কেবল বই কিনলেই চলতো না। বইয়ের থেকেও গাইড নোট কেনার দরকার বেশি ছিল! কারণ তখন তো এমন সৃজনশীল প্রশ্ন ছিল না। ছিল মুখস্থ ভিত্তিক প্রশ্ন পদ্ধতি। নোট থেকে গোটা কতক প্রশ্ন মুখস্থ করে নিলেই কাজ শেষ। তাই গাইড নোট কেনার দরকারও ছিল। একে নতুন বই তারপর আবার নোটবই কেনার প্রয়োজন। অভিভাবককে রীতিমত হিমশিম খেতে হতো। যে ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকের নতুন বই কেনার সামর্থ্য ছিল না তারা আশেপাশের উপর ক্লাসের বই মাস দুয়েক আগেই বলে কয়ে রাখতো। তবে পুরাতন হলেও আমাদের কাছে তা ছিল নতুন। আর সেই বইয়ের আকর্ষণ আজকের নতুন বইয়ের থেকে কম ছিল না। কিন্তু নতুন আর পুরাতনে পার্থক্য থেকেই যায়। আজকের এই সময়ের সাথে সে সময়ের কত পার্থক্য। এদিক থেকে আজকে একটি শিশু আমদের থেকে অনেক সৌভাগ্যবান। প্রতি বছর অন্তত সে নতুন বই হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারে। তাকে সেই বই কেনার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয় না। সেকালেও বই উৎসব হতো। তবে একালের সাথে তার বিস্তর ব্যবধান।

দেশের অগ্রগতির প্রধান হাতিয়ার অর্থনীতি হলেও শিক্ষাই হলো তার মূল চালক। সব প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে শিক্ষাই আমাদের পথপ্রদর্শক। শিক্ষার প্রধান উপকরণ বই। বছরের শুরুতে এখন আর বই কেনার টেনশন নিয়ে শুরু হয় না। শিক্ষকদের হাত থেকে নতুন বই নিয়ে বাড়ি ফিরে দিন শুরু হয়। শুরু হয় নতুন বই হাতে নিয়ে। কালের ব্যবধান যতই হোক আজও আমরা প্রশান্তি পাই। নিজের সন্তান যখন নতুন বই হাতে বাড়ি ফেরে, যখন নতুন বই কেনার জন্য কোনো অভিভাবককে দুঃশ্চিন্তা করতে হয় না তখন মনে হয় এ এক অভূতপূর্ব অর্জন আমাদের জন্য। এই অর্জনের সাথে আমাদের আরও অর্জন যোগ হয়েছে এতদিনে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে আমাদের শিক্ষা খাতেও উন্নয়ন হয়েছে। বই বিতরণ এক বিশাল অর্জন। প্রাথমিকের সব শিক্ষার্থী আজ উপবৃত্তি পায়। প্রতি মাসে তাদের উপবৃত্তির টাকা দেয়া হয়। এটাও কম বড় অর্জন নয়। আমাদের দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে এই অগ্রগতি নিয়ে আমরা আজ গর্বিত। বিনামূল্যে বই বিতরণের মধ্যে দিয়ে যে বিশাল উৎসবের সূচনা হয়েছে তা একসময় আরও বহুদূর ছাড়িয়ে যাবে। সময়ের সাথে সাথে বই বিতরণ কর্মসূচিও আরও এগিয়ে যাবে। দেশে শতভাগ শিক্ষিত হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। বই বিতরণ কর্মসূচির ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। সেই সাথে আনন্দও বৃদ্ধি পাবে। দেশের ধনী-দরিদ্র প্রত্যেকের সন্তান একসাথে নতুন বই নিয়ে বাড়ি ফিরছে এ দৃশ্য অভূতপূর্ব।

লেখক: কলামিষ্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

অলোক আচার্য বই উৎসব; অপেক্ষায় কোটি-কোটি শিক্ষার্থী মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর