‘ম্রো’ সমাজে বিয়ের প্রচলিত সামাজিক রীতিতে সংস্কার প্রয়োজন
২৮ ডিসেম্বর ২০২২ ১৮:২৭
অন্য সব সমাজের মতই ‘ম্রো’ সমাজেও বিয়ে একটি স্বাভাবিক সামাজিক প্রথা। যার মধ্য দিয়ে একজন নারী এবং একজন পুরুষ বৈধভাবে একসাথে বসবাস করার জন্য সমাজের নিকট অনুমতি লাভ করে। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি পায়। সমাজকে সুশৃঙ্খল রাখতে এবং সমাজের সামাজিক মূল্যবোধগুলো সমুন্নত রাখতে সামাজিকভাবে বিয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সামাজিক বিয়ে ছাড়া যুবক-যুবতীরা নিজেদের পছন্দের পাত্র-পাত্রীকে বিয়ে করলে ‘ম্রো’ সমাজে সামাজিকভাবে লঘুদন্ডের প্রচলন রয়েছে। সমাজ স্বীকৃত বিয়ের ক্ষেত্রে ‘ম্রো’ সমাজে ‘বংকম’ ও ‘মাংতাং’ নামক দু’ধরণের সামাজিকতা সম্পন্ন করতে হয়। এর সাথে যে সকল সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়ে থাকে, তার সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতি-নীতির কোন সম্পর্ক নেই। ‘ম্রো’ সমাজে বিয়ে সম্পূর্ণরূপে সামাজিক রীতি-নীতি এবং প্রচলিত প্রথা অনুসরণ করে সম্পন্ন হয়।
‘ম্রো’ সমাজে সাধারণত দুই প্রকার বিয়ের রীতির প্রচলন রয়েছে —
১. নিমাং (দিনের বেলা বউ আনা)
‘ম্রো’ সমাজে নিমাং বিয়ে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সামাজিক বিয়ের সকল রীতি-নীতিগুলো আবশ্যিকভাবে পালন করতে হয়।
ক) সাধারণত শীতের মৌসুমের শুরু থেকে বসন্তের শেষ সময়ের মধ্যে ছেলের অভিভাবক যে পাড়ায় বিয়ে করার জন্য বৈধ গোষ্ঠী আছে সে পাড়ায় বেড়াতে গিয়ে যোগ্যতা সম্পন্ন পাত্রীর সন্ধান পেলে বিবাহ উপযুক্ত ছেলেকে তার বন্ধু-বান্ধবসহ পাত্রী দেখার জন্য সে পাড়ায় যেতে বলে। প্রথানুযায়ী পাড়ার যুবক-যুবতীদের নিয়ে ‘চামপোয়া’ নামক একটি আড্ডার আয়োজন করা হয়। পাত্র-পাত্রী নিজেদের মধ্যে সম্মতি আদান-প্রদান সম্পন্ন হলে পর ছেলে অভিভাবককে তার সম্মতি জানায়। পরবর্তীতে ছেলের অভিভাবক কয়েকজন আত্মীয়সহ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে কনের বাড়িতে যায়। প্রথানুযায়ী ছেলের অভিভাবক বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করার পূর্বে তাদের সাথে নিয়ে আসা মদ কনের বাবা-মা’কে ও আগত আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে মদ পরিবেশন করে। অতঃপর কনেপক্ষ সম্মতি জানালে বিয়ের জন্য শুভদিন-ক্ষণ ঠিক করা হয় এবং এক সপ্তাহ পর চূড়ান্তভাবে বিয়ের বাগদান হিসেবে কনের বাবা-মা’কে ৩০টি রূপ্য মুদ্রা, ৩টি রূপ্য মুদ্রার সমমূল্যের ৩টি বল্লম, ২টি রূপার মূদ্রার সমমূল্যের তিনটি বল্লম, ২টি দা, ১টি নিড়ানী (তিম), ১টি তলোয়ার এবং ১টি তীর প্রদান করতে হয়। বিয়ের জন্য বরপক্ষ ২৫টি-৩০টি মাটির বড় কলসীতে ‘ইয়ো’ নামক কাঁচা মদ প্রস্তুত করে রাখে।
খ) বরপক্ষ একদিন পূর্বে ৩০-৬০টি দেশি মোরগ নিয়ে কনের বাড়িতে আগমন করে। বরপক্ষের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়ের হাতে কনেকে সম্প্রদান করার পর কনেপক্ষ বড় (পাঁচ মুঠো সাইজ) একটি শুকর কেটে মদসহ খাবার আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে।
গ) পরের দিন বিদায়ের পূর্বে কনেকে বিবিধ রূপার অলঙ্কারে সাজিয়ে একদিকে যেমন কনের জেঠি, কাকি, বৌদি ও প্রতিবেশীর বৌ’রা এসে কনেকে বিদায় জানায়, তেমনি অপরদিকে বরের জেঠি, কাকি ও বৌদিরা কনেকে বরণ করে শ^শুর বাড়িতে যাওয়ার জন্য কনেকে অনুরোধ করে। কনে ‘পানথিন’ নামক একটি কাপড় মাথায় দিয়ে শ^শুর বাড়ি যাত্রা করে। কনে বরের বাড়িতে পৌঁছলে বরপক্ষ ও কনেপক্ষের আগত সকল অতিথিদের মদ দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়, যা সারারাত চলমান থাকে।
ঘ) ‘ম্রো’ বিয়ের আবশ্যিকভাবে পালনীয় রীতি হচ্ছে বংকম বা জোড় বাঁধা। এটি কনেকে বরের গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্তকরণ প্রথা বিশেষ। এটি ব্যতীত সামাজিক বিয়েকে বৈধ বলা যাবে না। অপদেবতাদের বা অশুভ শক্তির দৃষ্টি না লাগার জন্য সাত গাছি কার্পাস সুতায় শুকরের পিঠের সাতটি কেশ বেঁধে বর ও কনের ডান হাতের কব্জিতে বেঁধে মঙ্গল ঘটে মদ ও আদার জল ছিটিয়ে চাউল ভরা লাউয়ের খোলে ছয়বার ফুঁ দিয়ে নবদম্পতির কপালে মদ ও আদার জল ছিটানো হয়। একজন অভিজ্ঞ ও বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি এই অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। অনুষ্ঠানের পর অতিথিদের খাবার পরিবেশন করা হয়।
ঙ) প্রথানুযায়ী বরের পিতা একটি কুলার উপর ১১০টি রূপার মুদ্রা, ৬টি বল্লম, ২টি দা, ১টি নিড়ানী এবং ১টি তলোয়ার রেখে কনের পিতাকে মাংতাং (মায়ের দুধের দামসহ) দিতে হয়। অপরদিকে কনের পিতা বরের পিতাকে সম্মান স্বরূপ ৪০ হাত সাদা কাপড় (পাগড়ি) দেয়। পাশাপাশি কনে পক্ষের আগত সকল অতিথিগণকে একটি করে বল্লম এবং একটি মোরগ উপহারস্বরূপ দিতে হবে এবং যাঁরা বরের বাবার নিকট হতে উপহার গ্রহণ করবেন, পরবর্তীতে বরের বাবাকে পাঁচ হাত লম্বা সাদা কাপড় এবং ১ কেজি হাঙ্গর শুটকি দিতে হবে।
চ) মাংতাং অনুষ্ঠান শেষে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়বে তখন বর ও কনে মিলে একটি মুরগীর বাচ্চাকে গলা টিপে হত্যা করার মধ্যে দিয়ে একে অপরের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে শপথ গ্রহণ করে। এই কাজটি একজন ওঝা পরিচালনা করে থাকেন।
ছ) মাংতাং অনুষ্ঠান শেষে বর ও কনেকে একসাথে বসিয়ে কুলার উপর পাঁচটি রূপার মুদ্রা দিয়ে কনের বাবা-মা আর্শীবাদ এবং আগত সকল অতিথিরা আর্শীবাদ করবেন।
২. ওয়ার্মাং (রাতের বেলা বউ আনা)
এই বিয়ের রীতিটি মূলত বর-কনের অভিভাবকদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে বিয়ের আয়োজন করলেও ‘বংকম’ করার ও ‘মাংতাং’ প্রদান করার পদ্ধতি একই রকম হয়ে থাকে। সাধারণত পাত্র-পাত্রী নিজেদের পছন্দে বিয়ে করতে চাইলে কিংবা বর-কনের অভিভাবকদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল না হলে উভয় পরিবারের সম্মতিতে এই রীতিতে বিয়ের আয়োজন করা হয়। রাত্রি বেলায় বউকে বরের গৃহে নিয়ে আসা হয় বলে একে ওয়ার্মাং বলা হয়।
‘ম্রো’দের পারিবারিক ও সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে যেটি বোঝা যায়, সেটি হলো ‘ম্রো’রা জাতীয় পর্যায়ে নয় বরং আঞ্চলিক পর্যায়েও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সমগ্র জনগোষ্ঠীর সিংহভাগের জীবন-জীবিকা এখনো জুম চাষ নির্ভর। শিক্ষার হার জনসংখ্যানুপাতে এখনো ৫% অতিক্রম করতে সক্ষম হয়নি। সরকারি-বেসরকারি চাকুরীজীবি কয়েকজন মাত্র। নামমাত্র যে ক’জনের নিজস্ব জায়গা রয়েছে তাদের কেউ কেউ ফলজ বাগান করে আয়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া অধিকাংশই দিন মজুরী করে জীবিকা নির্বাহ করছে। জুম থেকে আগের মতো ফসল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারিগরী জ্ঞান ও দক্ষতার দিকেও ‘ম্রো’ জনগোষ্ঠী অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মানুষের তুলনায় অনেকাংশেই পিছিয়ে রয়েছে। জুম চাষের ভূমি কমে যাওয়ার পাশাপাশি জুমচাষে কম লাভ হওয়ার কারণে এই জনগোষ্ঠীর মানুষজন মৌসুমী সবজি চাষের দিকে ঝুঁকছে। এই ক্ষেত্রটিতেও সকলেই সমানভাবে লাভের মুখ দেখছে না। তার উপর অনেকেই বিয়ে এবং ‘পণ’র ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে নিজেদের ভূমি বন্ধক রাখতে বা বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা। বছরের কয়েকটি মাসই মাত্র কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায়। বাকী মাসগুলো কর্মহীন ভাবেই কাটে। এভাবে প্রতিনিয়ত পাল্লা দিয়ে কর্মহীন মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। ভাবতে অবাক লাগে এমন আর্থিক দৈন্যতার মাঝেও সামাজিক বিয়েতে ‘পণ’ আদান-প্রদানের রীতি-নীতিগুলো কট্টরভাবে পালন করতে গিয়ে ‘ম্রো’ জনগোষ্ঠী নিজেদের অজান্তেই দরিদ্র থেকে হতদরিদ্র হচ্ছে। এমনটা হলে আগামী প্রজন্ম ‘ম্রো’দের সামাজিক প্রথার উপর শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলবে।
আমি কোন ভাবেই সামাজিক প্রথার বিরূদ্ধে নয়। তবে আমার অবস্থান সব সময় ইতিবাচক সামাজিক আচরণ ও প্রথার পক্ষেই। তাই সামাজিক প্রথায় যেগুলোর মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব লক্ষণীয়, সে সকল সামাজিক প্রথাগুলোকে জনগোষ্ঠীর মঙ্গলার্থেই ইতিবাচক সংস্কার করার প্রয়োজন। সময়ের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে সমাজে প্রচলিত সামাজিক প্রথাগুলোর যুগোপযোগী সংস্কার করা না গেলে আগামী প্রজন্মকে শিক্ষিত হয়েও বারংবার হোঁচট খেতে হবে। তাই ‘ম্রো’ সমাজে প্রচলিত সামাজিক প্রথাগুলোর যতদ্রুত সম্ভব ইতিবাচক সংস্কার করা প্রয়োজন। ‘ম্রো’ সমাজে বিয়ের সামাজিক প্রথাসমূহ সংস্কারের ক্ষেত্রে আমার কিছু সুপারিশমালা এখানে তুলে ধরছি —
ক) দিনের বেলা বা রাতের বেলা যে কোন ধরণের বিয়ের ক্ষেত্রেই সামাজিকতার বাহুল্যতা যথা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে।
খ) সামাজিকভাবে যে সকল প্রথাগুলোর ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে, সেগুলোকে চিহ্নিত করে নিজেদের সামর্থ্যের মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে।
গ) কনে পক্ষের পণ প্রদানকরাকে প্রতীকী প্রথায় প্রচলন ঘটাতে পারলে সবচেয়ে ভাল; তবে তা করা না গেলে সর্বোচ্চ ৩-৫টি রূপার মুদ্রা গ্রহণ করার প্রথা প্রচলন করতে হবে। তার সাথে কনের মামার গোষ্ঠীগণের দাবী ধরার প্রথাগুলোর প্রচলন বন্ধ করলেই বরং সমাজের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
ঘ) কনের পণ’র সাথে অন্যান্য যে সকল দাবীগুলো (বল্লম, তীর, দা ও তলোয়াড় ইত্যাদি) সংযুক্ত রয়েছে; সেগুলোর প্রচলন বন্ধ করতে হবে এবং কনে পক্ষের সকল অতিথিদের বল্লম ও দেশি মোরগ উপহার দেয়ার প্রথাটির প্রচলন বন্ধ করে প্রতীকীরূপে একটি মোরগ উপহার দেয়া যেতে পারে।
ঙ) বিয়ের দিন নববিবাহিত দম্পতি মিলে গভীর রাতে একটি প্রাণীকে গলা টিপে হত্যার প্রথাটি বন্ধ করতে হবে। তার পরিবর্তে পাড়ার সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ কয়েকজন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাকে অথবা পাড়ার সবচেয়ে দরিদ্র কয়েকজন লোককে খাবার বা পরনের নতুন কাপড় দিয়ে নতুন দিনটি শুরু করার প্রথা প্রচলন সমাজের জন্য আরো বেশী মঙ্গলজনক এবং ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
চ) বরপক্ষ এবং কনেপক্ষ একই খাবার গ্রহণ করার প্রথা প্রচলন করতে হবে।
সমাজে বিয়ে এবং এর অনুষ্ঠানাদি স্বাভাবিক ভাবেই চলমান থাকবে। তবে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বিয়ের প্রচলিত প্রথাসমূহের পরিমার্জন করে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারলেই এটি সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে। তাছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, একটি বিয়েতে দু’টি পরিবার দারুণভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে। এমনিতেই বিভিন্ন প্রকার চাপে ‘ম্রো’ জনগোষ্ঠী প্রায় বিধ্বস্ত। তার উপর সামাজিক কঠোর প্রথার বেড়াজালে জড়িয়ে পরিবারগুলো প্রতিনিয়ত নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। বলা বাহুল্য, ‘ম্রো’ সমাজের ৯০% এর বেশী মানুষ দরিদ্র সীমার নীচে বসবাস করছে। তাই এখনই সমাজে প্রচলিত সামাজিক প্রথাগুলোর ইতিবাচক সংস্কার জরুরি। এই পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়িত হলে প্রথমত, শুধুমাত্র বিয়ের জন্য ‘ম্রো’ পরিবারগুলো আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে না। দ্বিতীয়ত, শুধুমাত্র সন্তানের বিয়ের ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে কোন পরিবারকে ভূমিহীন হতে হবে না। তৃতীয়ত, সন্তানের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে যে কোন পরিবারের পক্ষে অর্থের ব্যয়ভার বহন করার সামর্থ্য গড়ে উঠবে। চতুর্থত, সামজের সাধারণ মানুষ নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তনের চিন্তা করতে সক্ষম হবে। পঞ্চমত, যুগোপযোগী নতুন ধ্যান-ধারণা তৈরি হবে, ইতিবাচক নতুন নতুন প্রথার প্রচলন শুরু হবে এবং নতুন প্রথাগুলোকে গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে উঠবে। ষষ্ঠত, পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে আরো বেশি মনোনিবেশ করতে সক্ষম হবে।
‘ম্রো’ সমাজ শত শত বছর ধরে চলে আসা প্রচলিত সামাজিক প্রথার অদৃশ্য জালে জড়িয়ে রয়েছে। যে কেউ চাইলেই এই জাল ছিড়ে ফেলতে পারবে না। এক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিগণের ইতিবাচক পরিবর্তনের ভাবনা প্রয়োজন ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে সমাজপতিদের নিকট এডভোকেসি করা, কর্মজীবি মানুষসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের জনসাধারণ পর্যায়ক্রমে নিয়মিত ইতিবাচক ভাবনা ও ধ্যান-ধারণার প্রচার করতে পারেন। তাছাড়াও জনপ্রতিনিধিগণ পাড়া পর্যায়ের বিভিন্ন জনসভায়, কর্মশালায় ও চা-চক্রে সামাজে প্রচলিত নেতিবাচক প্রথাসমূহের কুফল এবং এর ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন। প্রয়োজনে সরকারি বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমের পরিকল্পনায় অন্তর্ভূক্ত করে বাস্তবায়িত বিভিন্ন কার্যক্রমের আওতায় সামাজিক প্রথাসমূহের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেও সমাজের বিভিন্ন স্তরের জনসাধারণের অংশগ্রহণে প্রথাসমূহের ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। সমাজের যে কোন ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের মূলমন্ত্র হল সর্বস্তরের জনসাধারণের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো, সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ। ইতিবাচক পরিবর্তনকে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি ও সর্বোপরি নতুন পরিবর্তনের উপর আস্থা রাখা। ‘ম্রো’ সমাজের সর্বস্তরে এরূপ পরিবর্তন আনার জন্য এখন থেকেই কাজ শুরু করা প্রয়োজন। কাজ শুরু করার সাথে সাথেই পরিবর্তন আসবে এমন আশা করাটা ভুল। কারণ যে জনগোষ্ঠির অধিকাংশ মানুষ এখনো নিরক্ষর। জীবিকা বলতে জুম চাষ, মৌসুমী সবজি চাষ, কেউ বাগান চাষী এবং বাকীদের কেউ মোটর সাইকেলে যাত্রী পরিবহনের কাজ করে। কেউবা সিএনজিচালক এবং বাকীরা দিনমজুরী করেই জীবিকা নির্বাহ করে। আর যাই হোক খুব অল্প সময়ে সেই জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সামাজিক প্রথার যুগোপযোগী পরিবর্তন আনা সম্ভব না। শুধুমাত্র দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতায় দীর্ঘমেয়াদে এসম্পর্কিত কোন প্রকল্প বা কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা গেলে, তবেই ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। এই পরিবর্তনের জন্য ‘ম্রো’ সমাজের সুচিন্তক মহল ও সুশীল সমাজকেই প্রথমে সর্বস্তরের জনসাধারণের মধ্যে সমন্বয়ের কাজটি করতে হবে। নিজেদের সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য সফলতা বা ব্যর্থতার কথা চিন্তা না করে নিজেদেরকেই উদ্যোগী হতে হবে। চলমান প্রথাগত সামাজিক রীতির বিরুদ্ধাচারণ নয়, বরং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই এই সংস্কার জরুরি। ক্রমাগত চেষ্টার ফলে নিশ্চয় একদিন ‘ম্রো’ সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবেই। নিজেদেরকে যুগোপযোগী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে এগিয়ে আসবেই।
লেখক: উন্নয়নকর্মী ও সংগঠক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
‘ম্রো’ সমাজে বিয়ের প্রচলিত সামাজিক রীতিতে সংস্কার প্রয়োজন চিন্ময় মুরুং মুক্তমত