Tuesday 23 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাষ্ট্র কি ‘ম্রো’দের বাঁচবার অধিকার নিশ্চিত করতে পারে না?

সুমিত বণিক
৪ জানুয়ারি ২০২৩ ১২:৩৬ | আপডেট: ৪ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৩৩

আইন ও সংবিধান খুব জটিল বিষয়, সেটা নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করার সুযোগ আমার হয় নি, আর হবেও না আশাকরি, তবে এটা বিশ্বাস করি একটি দেশের রাষ্ট্র কাঠামোতে ঐ দেশের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখার ভেতরে সকল জনগোষ্ঠীর মানুষের সমমর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের পূর্ণ অধিকার রয়েছে। ক্ষুদ্রতম ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, নৃ-তাত্ত্বিক ও নিজস্ব ভিন্ন ভাষাগত গোষ্ঠীর মানুষেরও রাষ্ট্র কর্তৃক সমান সুযোগ, সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখেন। এবং রাষ্ট্র সেটি নিশ্চিত করবে। এটি সংবিধানে কত নম্বর ধারায় বা অনুচ্ছেদে লেখা আছে, বা আদৌ লেখা আছে কিনা, সেটা নিয়ে আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে। মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, বান্দরবানের লামা উপজেলায় ম্রোপাড়ায় ফের হামলা বাড়িঘরে আগুন লুটপাট প্রসঙ্গ নিয়ে।

বিজ্ঞাপন

অতি সম্প্রতি বান্দরবানের লামা উপজেলায় রাতের আঁধারে ট্রাকভর্তি লোকজন এসে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ম্রো জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালিয়েছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে অভিযোগ ও খবরের সত্যতা পাওয়া গেছে। গত রোববার (১ জানুয়ারি) রাতে উপজেলার সরই ইউনিয়নের রেংয়েন ম্রো পাড়ার এ ঘটনাটি ঘটে। ঘটনার নেপথ্যে লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানির লোকজন জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন পাড়াবাসী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ম্রো পাড়ার বাসিন্দারা অভিযোগ করে জানান, রবিবার রাত ১টার দিকে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের ট্রাকভর্তি শতাধিক লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে আসে। তারা ‘ধর ধর, ম্রো ধর’ বলে চিৎকার করতে করতে পাড়ার বাড়িঘরে হামলা শুরু করে। ট্রাকের শব্দ ও হামলাকারীদের চিৎকার শুনে পাড়াবাসী ঘুম থেকে জেগে যে যেভাবে পারেন জঙ্গলে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। হামলাকারীরা পাড়ার বাসিন্দাদের ছাগল, হাঁস, মুরগি, কম্বল, সৌরবিদ্যুতের প্যানেলসহ যা পেয়েছে, সবই লুট করে নিয়ে যায়। এ হামলার বর্ণনা হিসেবে ডলুছড়ি মৌজার হেডম্যান জোহান ত্রিপুরার প্রকাশিত ভাষ্য অনুযায়ী, ‘গভীর রাতে ১০-১৫ জন মুখোশধারী সন্ত্রাসী রেয়াংপাড়ায় গিয়ে প্রথমে কামরুম মুরুং, চিংচং মুরুং ও রেঙইয়াং মুরুংয়ের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি আরও ১০টি বসতঘর ভাঙচুর ও মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়।’

গণমাধ্যমে পাড়ার আরেক বাসিন্দা রেংয়েন ম্রো কার্বারি’র প্রকাশিত ভাষ্য মতে, ‘রাতে আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পাড়াবাসীর চিৎকারে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি কয়েকটি ঘরে আগুন জ্বলছে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে তখন বাড়ির পাশের ঝোপে লুকিয়ে থাকি। হামলাকারীরা অনেক কিছু লুট করে নিয়ে গেছে।’ প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, পাড়ার বেশিরভাগ মানুষ জুমচাষ, বাগান ও দিনমজুরি করে সংসার চালায়। তাদের চাষ করা জমিগুলো দখলের জন্য লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে । তবে গণমাধ্যমে অভিযুক্ত লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা সদস্য মো. আবদুল মালেক অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘ম্রোদের সঙ্গে আমাদের ভূমির বিরোধ আছে সত্য। কিন্তু গভীর রাতে আমাদের পক্ষে ঘটনাস্থলে যাওয়া তো দূরে থাক, ম্রোদের সশস্ত্র পাহারার কারণে আমরা দিনের বেলায় পর্যন্ত ওখানে যেতে পারি না।’

এদিকে ২ জানুয়ারি বান্দরবানের লামা উপজেলায় ম্রো ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাটের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সহযোগিতায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)। সোমবার বিকেলে চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় চত্বরে আয়োজিত সমাবেশে বক্তারা বলেছেন, এক বছর ধরে লামার ম্রো ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ৪০০ একর ভূমি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ। পূর্বের হামলার সুষ্ঠু বিচার না হওয়ায় পুনরায় তারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

৩ জানুয়ারি লামার সরইয়ের ঘটনাটি নিয়ে বান্দরবানের স্বনামধন্য গণমাধ্যম কর্মী উসিথোয়াই মারমা‘র ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে ঘটনার বিবরণ, একাধিক ছবিসহ একটি পোস্ট করেন। পোস্টটিতে একটি ভিডিও রয়েছে, যেখানে ঘটনার শিকার ম্রো জনগোষ্ঠীর একজন ক্ষতিগ্রস্থ নারী তার ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে কান্নায় আহাজারি করছিলেন। তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পোস্টটি ৫১২ বার শেয়ার করা হয়েছে। মন্তব্যে অনেকেই এ ধরণের অমানবিক ঘটনার প্রতিবাদ ও দোষীদের শাস্তি দাবী করেছেন। তার ব্যক্তিগত অনুসন্ধানে গিয়ে তিনি সেই রেংয়েন ম্রো পাড়ায় গিয়ে সরজমিনে যা দেখেছেন, সেটি হলো নতুনভাবে নির্মাণ করা ৩টি ঘর সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ৩টি ঘর পুরোপুরি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। পাড়ার ভেতরে আরও ২টি ঘরে ভাঙচুর ও হামলা চালানো হয়েছে। এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মোট ৮টি ঘরবাড়ি। রেংয়েন ম্রো পাড়ায় পড়ন্ত বিকালে যখন পুলিশ এসে পৌঁছায়, তখন রেংয়েন ম্রো কার্বারি ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বলছিলেন, ‘দেখেন স্যার, আঁরা তো এ দেশত নাগরিক। আঁরা মানুষ না?’ তিনি তার স্ট্যাটাসে আরো লেখেন, সেই করোনার সময় থেকে পাড়া বন্ধ। ভেঙ্গে গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে, ৪০০ একরের মধ্যে ৩৫০ একর আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ঝিরিতে বিষ ঢেলে দেওয়া হয়েছে, কলা গাছ কেটে ফেলা হয়েছে এবং সর্বশেষ রেংয়েন ম্রো পাড়ার ৮টি ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে ও ভাঙচুর করা হয়েছে। তার দেয়া স্ট্যাটাসটিতে আরও একটি লাইন ছিলো, ‘এতসব ধারাবাহিক ঘটনায় প্রশাসনের ‘খতিয়ে দেখা’, ‘তদন্ত করা’ এবং ‘ব্যবস্থা নেওয়ার’ আশ্বাসের মধ্যেই আটকে থাকবে এই সব মানুষের জীবন?’

অভিযোগ রয়েছে, পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকারকে তোয়াক্কা না করে গত শতকের আশি বা নব্বইয়ে দশকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাবার, টিক, পাল্প উডের বাণিজ্যিক প্ল্যান্টেশনের জন্য বহিরাগত ব্যক্তিদের দীর্ঘ মেয়াদে জমি ইজারা দেওয়ার কারণে উক্ত জুম ভূমি থেকে এক দিকে ম্রো ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মানুষ উচ্ছেদ হতে থাকে, অন্যদিকে রাবার, টিক ইত্যাদির মনোকালচার প্ল্যান্টেশনের প্রভাবে উক্ত এলাকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।

লামার ‘ম্রো’ জনগোষ্ঠীর এই মানুষগুলো জীবনে এই করুণ কান্নার কি অবসান হবে না? অভিযুক্ত লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের ক্ষমতার দৌরাত্ব কি এতই বেশি যে, রাষ্ট্রযন্ত্র বা স্থানীয় প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবে না? আমি অন্তত এটা বিশ্বাস করি না। আমার প্রত্যাশা, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করবে। ঘটনার সাথে যুক্ত সকলকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করবেন। কারণ কোন ভূমিদস্যূ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে একটা দেশের সাধারণ মানুষ কুক্ষিগত থাকতে পারে না, অন্তত মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের ইতিহাস সেটা বলে না। আশাকরি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের পুনর্বাসনের দ্রুত ব্যবস্থা করবেন। সেই সাথে অভিযুক্ত লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের চলমান এই অত্যাচার থেকে লামার ‘ম্রো’ জনগোষ্ঠীর মানুষদের স্থায়ী মুক্তি দিবেন।

লেখক: জনস্বাস্থ্য কর্মী ও প্রশিক্ষক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
বিজ্ঞাপন

আমাদের সীমান্ত পরিচিতি
২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:০০

নরসিংদীতে যুবককে কুপিয়ে হত্যা
২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:৫৮

আরো