নাশকতার সুযোগ খুঁজছে জঙ্গি সংগঠন: গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে
৪ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:৫৪
বাংলাদেশে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই কোণঠাসা অবস্থায় থাকলেও শঙ্কা কাটেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থান ও অভিযানের মধ্যেও জঙ্গিরা নানাভাবে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। ধর্মের অপব্যাখ্যায় পথভ্রষ্ট হয়ে হিজরতের নামে গত ২২ ডিসেম্বর ঘর ছাড়ে ৯ তরুণ-তরুণী। এরপর র্যাব তাদের চট্টগ্রাম থেকে উদ্ধার করে হেফাজতে নেয়। কাউন্সেলিংয়ের পর কথিত হিজরতকারীরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে এবং পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। তরুণ প্রজন্মের এমন ভুল ও ধ্বংসাত্মক পথে চালিত হওয়া শঙ্কাজনক। একই দিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও টেকনাফ থেকে আল কায়দাপন্থি ঘরছাড়া ৬ যুবককেও গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। গ্রেপ্তারকৃতরা অনলাইন থেকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশে সশস্ত্র জিহাদ করার পরিকল্পনা নিয়ে সংগঠিত হচ্ছিল। জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইনভিত্তিক অ্যাপসে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে তারা দল গঠন করে। পরে স্থানীয় সহযোগীদের থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে টেকনাফে অবস্থান করে সশস্ত্র জিহাদের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ধীরে ধীরে সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছিল। কয়েক বছর ধরে জঙ্গি সংগঠনগুলোর সহিংস কর্মকা- না থাকলেও তারা ভেতরে ভেতরে সুসংগঠিত হওয়ার কাজ করছে, যা দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য চরম হুমকি। তারা যদি আবারো সহিংস কর্মকা-ে ফিরে আসে তবে বাংলাদেশের জন্য তা বড় শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। হিজরতের ঘটনায় জঙ্গিবাদের নতুন মেরুকরণে নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ মোকাবিলার ক্ষেত্রে হলি আর্টিজান হামলা একটি মোড় ঘোরানো ঘটনা বলে মনে করি। বর্তমান সরকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। বলা যায়, দেশে জঙ্গি তৎপরতা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগাম তথ্য নিয়ে বেশকিছু জঙ্গি আস্তানায় সফল অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছে। এই তৎপরতা ও অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। জঙ্গি ধরপাকড়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করতে হবে নতুন করে জঙ্গিবাদে যুক্ত হওয়ার ধারাও। পাশাপাশি জঙ্গি দমন অভিযান ও গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত থাকা অবস্থায় জঙ্গিদের গোপন তৎপরতা কীভাবে ও কিসের জোরে চলতে পারছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
জঙ্গিবাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িকতাবাদী রাজনীতি। বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী দীর্ঘদিন থেকেই জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর তৎপরতার কারণে জঙ্গিরা কিছুটা দুর্বল হলেও তাদের তৎপরতা থেমে নেই। ভেতরে ভেতরে নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে তারা, নতুন করে নাশকতার ছক আঁটছে। জঙ্গি তৎপরতা সচল রাখতে নানাভাবে অর্থায়ন করা হচ্ছে, বিদেশ থেকে নানাভাবে টাকা আসছে। অনেক এনজিও ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে রয়েছে জঙ্গিবাদে অর্থায়নের অভিযোগ। আর এক বছর পর একটি জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন থেকেই রাজনীতির মাঠ গরম হতে শুরু করেছে। অতীতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক উত্তাপ যখন তীব্র হয় তখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে জঙ্গিবাদ। এবারও যে তার ব্যতিক্রম হবে না, সে আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। রাজনীতির মাঠে যখন প্রধান দুই রাজনৈতিক দল উত্তাপ ছড়াচ্ছে, সেই অবসরে বাংলাদেশে নতুন করে জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। সাম্প্রতিক সময়ে হিজরতের নামে বেশ কিছু তরুণের নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনায় জঙ্গিবাদের বিষয়টি সামনে এসেছে। গত ২০ নভেম্বর আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর এটা স্পষ্ট হয়েছে যে জঙ্গিরা অনেক বেশি সংগঠিত এবং নতুন করে তারা দেশের অভ্যন্তরে অস্থিরতা তৈরি করতে যাচ্ছে। জঙ্গিবাদের সর্বনাশা অপতৎপরতা থেকে বাংলাদেশ এখনো মুক্ত নয়। জঙ্গি সংগঠনগুলো নতুন করে সংগঠিত ও সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে এখন আরো তৎপর হতে হবে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর তৎপরতার কারণে জঙ্গিরা কিছুটা দুর্বল হলেও তারা একেবারে হারিয়ে যায়নি। ভেতরে ভেতরে তারা সাংগঠনিক তৎপরতা ও নাশকতার ছক আঁটছে। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাব জানিয়েছে, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের ওপর আবার হামলার সুযোগ খুঁজছে জঙ্গিরা। সম্প্রতি গ্রেপ্তার পাঁচ জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পেয়েছে তারা।
জঙ্গিদের এখন বড় ধরনের হামলা চালানোর কোনো সক্ষমতা নেই বলে কিছু একটা করে নিজেদের তৎপরতা জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে তারা। র্যাব মনে করে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভিযানে জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক ভেঙে যাওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে টার্গেট করছে তারা।
দেশে জঙ্গিবাদের চর্চা দৃশ্যমান হয় দুই দশক আগে আত্মঘাতী বোমা হামলার মধ্য দিয়ে। শুরুর দিকে পল্টন ময়দানে সিপিবির সমাবেশে, রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে, ময়মনসিংহে সিনেমা হলে এবং আরো কিছু জায়গায় বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। এরপর বাংলা ভাইয়ের উত্থান ঘটে। জঙ্গিরা সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটায় ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। ২০১৩ সালে একটু ভিন্নভাবে। ব্যক্তিবিশেষকে টার্গেট করে চাপাতি হামলা চালাতে শুরু করে তারা। কোথাও কোথাও আত্মঘাতী বোমা হামলার কৌশলও প্রয়োগ করা হয়। এ পর্বের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটানো হয় ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে। ওই হামলায় ১৭ বিদেশিসহ ২০ জন নিহত হন। একই বছর ৭ জুলাই ঈদের দিন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সর্ববৃহৎ ঈদের জামাত শুরুর প্রাক্কালে জঙ্গিরা কর্তব্যরত পুলিশের ওপর এলোপাতাড়ি আক্রমণ চালায়। তাতে পুলিশসহ চারজন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান।
ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গিকে আটক করা সম্ভব না হলেও ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে যেসব তথ্য দিয়েছেন, তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। জঙ্গিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাতে র্যাব বলেছে, জঙ্গিদের অর্থের জোগানদাতা দেশ ও দেশের বাইরের অনেক কুশীলব। এর মধ্যে অনেক ধর্মীয় রাজনৈতিক নেতাও রয়েছেন।
বিভিন্ন সংগঠনের ছত্রছায়ায় সেখানে তাদের প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে। গোপনে উগ্রপন্থি কার্যক্রম পরিচালনা করছে তারা। হিজরতের নাম করে জঙ্গিবাদের নতুন মেরুকরণ এক ভয়াবহ নাশকতার পূর্বাভাস। বর্তমান সরকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। বলা যায়, দেশে জঙ্গি তৎপরতা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগাম তথ্য নিয়ে বেশ কিছু জঙ্গি আস্তানায় সফল অভিযান পরিচালনা করে জঙ্গি সদস্যদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। এই তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। জামায়াতের জঙ্গি কানেকশন হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ার মামলাটি ঝুলে আছে। জামায়াত সত্যি নিষিদ্ধ হবে কিনা, নিষিদ্ধ হলে জামায়াত কী কৌশল নেবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। দেশবাসী চান, জামায়াতকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক।
জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর অর্থায়ন বন্ধ হয়নি, তাদের জনবল সংকটও স্থায়ী হয়নি। জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধ হলে এদের অপতৎপরতাও কমে যাবে। জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। গত সোমবার গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গিরা আল কায়দার মতাদর্শ অনুসারী। অনলাইনে বিভিন্ন ভিডিও কনটেন্ট দেখে তারা ভুল মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। অনলাইন থেকে এসব কনটেন্ট মুছে ফেলতে হবে এবং অনলাইনে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। এছাড়া প্রতিটি সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দেয়া এবং তাদের গতিবিধির দিকে পরিবারের নজর রাখা জরুরি।
লেখক: কবি, সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
নাসকতার সুযোগ খুঁজছে জঙ্গি সংগঠন: গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে মুক্তমত রনি অধিকারী