পুঁজিবাদের দাপটে সংকটে ‘আদিবাসী’রা
৯ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:২১
জানালার ফাঁকা কিংবা টিনের চালের ফাঁকা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করছে হিমেল হাওয়া। ভোরের সোনালী রোদ তো দূরের কথা দুপুরের সূর্যের আলোর দেখা মিলছে না। তাই তীব্র শীতে কাঁপছে দেশের উত্তরের জনপদ জয়পুরহাট জেলার মানুষ। শীত জেঁকে বসেছে। জনজীবন বিপর্যস্ত। শীতে দুর্দশা বাড়িয়ে তুলছে নিন্ম আয়ের শ্রমজীবী মানুষের। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের কষ্ট যেন পিরামিডের মত এগিয়ে চলছে।বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাগলা ঘোড়ায় নিন্মবিত্ত মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
যার কারণে কনকনে শীতে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলমান তীব্র শীতে গরম কাপড় কিনতে পারছে না হতদরিদ্র মানুষ। জয়পুরহাটের সীমান্ত ঘেঁষা নওগাঁ জেলার ধামইর উপজেলার ইশোকপুর ইউনিয়নের পড়ান গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ বয়সী মিনতি পাহান। তিনি কবে তার স্বামীকে হারিয়েছেন তার দিন তারিখও স্মরণ নেই। তবে তার মনে আছে তিনি যখন যুবতী ছিলেন তখন তার স্বামীর মৃত্যু দেখেছেন। স্বামীর অকাল মৃত্যুতে জেঁকে বসে দারিদ্রতার ছায়া। কারণ স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি কিছু নেই শুধু ভিটেমাটি। পরবর্তী তিনি তার ছোট তিন মেয়েকে বিপদে পড়েন। সন্তানদের লেখাপড়ার তো দূরের কথা মুখের খাবার জোগাড় করা যেন কঠিন হয়ে যায়।
মানুষের বাড়িতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শ্রম দিয়ে ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা দিনে আয় করে সামান্য কিছু টাকা জমিয়ে পাড়া প্রতিবেশির কাছে সাহায্য নিয়ে তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ঝামেলা মুক্ত হয়েছেন। এখন তিনি একাই স্বামীর ভিটেমাটিতে বসবাস করেন। কিন্তু দুঃখের কথা তার বয়সের ভাড়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে পারেন না। এর মধ্যের প্রকৃতি বিরূপ পরিবেশের কনকনে ঠাণ্ডা শীতে তার ভাঙা টিনের চালের ভিতর দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়ায় থরো থরো করে কাঁপতে থাকে। কোনো জনপ্রতিনিধি খোঁজ খবর নেই এই ঠাণ্ডায় তিনি কেমন আছেন! কি খাচ্ছেন? অসুখ বিসুখে কি চিকিৎসা নেন? এ যেন এক স্বার্থপর সমাজ। তবে প্রতিক্ষায় থাকে কখন সূর্য দেখা দিবে। সেই সূর্যের আলো দেহের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিবে। বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার জয়পুরহাট শহরে এসেছেন খালি পায়ে। জরাজীর্ণ শরীর নিয়ে ঠান্ডায় কাঁপছেন তিনি।
এমন বৃদ্ধ বয়সেও বুকে স্বপ্ন বুনে রাজপথে নেমেছে বৈষম্যমূলক সমাজ পাল্টানোর। ইট পাথরের শহরে তার খালি পায়ের শব্দ জানান দিচ্ছে এই সমাজে নিত্য নতুন ভাবে শোষিত হয় বারবার। তাই রাজপথে নেমেছে সাম্যের সমাজের দাবি নিয়ে। জেলা চিনিকল রোড থেকে বাটার মোড় পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের মিছিলে কাঁধে নিয়েছে লাল পতাকা। বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলেছেন ঘরে বাইরে নারী নির্যাতন বন্ধ কর, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে, কর্মক্ষেত্রে নারীদের ন্যায্য মজুরি দিতে হবে। আরও নানা স্লোগানে শরীর কাঁপছে, কাঁধে লাল পতাকা হিমেল হাওয়ায় উড়ছে অবিরাম। লাল পতাকা নাকি বিপদের সংকেত কিন্তু এ বিপদ তার যে একার তা নয় রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের আর বিপদ শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত। কারণ প্রতিদিন নারী নির্যাতনের খবর পত্রিকার পাতায় পাতায়।
মিছিল শেষে বাসদ অফিসে আসা মাত্রই কম্বল দিয়ে জড়িয়ে দিলেন জেলা বাসদ নেতৃবৃন্দ। কম্বল পেয়ে তিনি বলেন, গরিব হয়ে জন্ম নেওয়া পাপের। বয়সের ভাড়ে পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য টাকা ইনকাম করতে পারি না। এরমধ্যে শীতে কম্বল কেনার টাকা কই পাবো? তবে এই কম্বল পেয়ে এবারের শীত কাটতে পারব। কম্বল পেলাম কিন্তু আমরা আদিবাসী মানুষ সাংবিধানিক স্বীকৃতি কবে পাব? তার প্রশ্ন শুনে ভাবনার জায়গা তৈরী হয়েছে। ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা, সে স্বাধীনতা সংগ্রামে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের লেগে রয়েছে। কারণ আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান আছে। উদ্বিগ্নতার বিষয় পুঁজিবাদের দাপটে সংকটে আদিবাসীরা।
আর সেই রক্তের অক্ষরে আছে বর্মন, বানাই, হদি, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, রাখাইন, সাঁওতাল, মাহাতো, বাগদী, রাই, সিং, মুনিপুরী, খাসিয়া, ম্রো, তংচংগা, বং, পাংখুয়া, চাক, খুমী, লুসাই, ডালু, মং, উড়াও ও কোলসহ ৫৪টির মত আদিবাসী সম্প্রদায়কে বাঙালি নামে অভিহিত করে বাঙালি জাতিতে পরিণত করেছে। যার প্রমাণ হিসেবে আমরা দেখতে পাই সংবিধানের ৬ (২) অনুচ্ছেদে বলা আছে _
১. বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে।
২. বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলিয়া পরিচিত হইবেন।
এখানে আদিবাসী জাতির জনগণ গণপ্রজাতন্ত্রের ‘জনগণ’। সুতরাং জনগণ বলতে যেহেতু আদিবাসী জাতি সমূহকে বুঝানো হয়, সেহেতু গারো, হাজং, চাকমা, মারমা- এরাও জাতি হিসাবে বাঙালি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যদি কোন গারো, কিংবা হাজংকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনারা কি বাঙালি? তখন উত্তর নিশ্চিত পাওয়া যাবে তারা বাঙালি নয়। কারণ তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস ইত্যাদি । ফলে জাতি হিসেবে বাঙালি নয় আদিবাসী। আর এ জাতিকে স্বীকৃতি দিতে চলে নানা টালবাহানা। এক দল ক্ষমতা ধরের রাখার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ছে আর একদল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কেউ এ জাতির দুর্দশার কথা চিন্তা করে না। দুঃখজনক কথা যে আদিবাসীরা নানামুখী শোষণ ও বৈষম্যের শিকার হয়ে তাদের আত্মপরিচয় ও সংস্কৃতি হারাতে বসেছে।
তাই সময় এসেছে নয় বাঙালি, আর নয় উপজাতি, আর নয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী তাদের আদিবাসীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। তাই দেশের জাতির উন্নয়ন করতে হলে সবাইকে একসাথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, নিজ নিজ মাতৃভাষার শিক্ষক নিয়োগ এবং পর্যায়ক্রমে দেশের সব আদিবাসী ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে। আদিবাসীদের নিজ নিজ সামাজিক অনুশাসন, প্রথা, কৃষ্টি, নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস ও মর্যাদা বৃদ্ধি এবং প্রতিপালনে ‘আদিবাসী কল্যাণ ট্রাস্ট’ গঠন করতে হবে। আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক একাডেমিগুলোতে আদিবাসীদের সংস্কৃতি উন্নয়নে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে এবং তাদের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও গবেষণার জন্য বিশেষ বরাদ্দসহ একাডেমির পরিচালক, কর্মকর্তা বা কর্মী নিয়োগে আদিবাসীদের প্রাধান্য দিতে হবে। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে আদিবাসীদের বৈষম্য দূর করতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
পুঁজিবাদের দাপটে সংকটে ‘আদিবাসী’রা মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ