Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের সাম্প্রতিক প্রবণতা

মেহজাবিন বানু
৯ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:২৭

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে দৃঢ় আগ্রহ দেখিয়েছে। বাংলাদেশ একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও শক্তিশালী করতে চায়। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য বাংলাদেশের সঙ্গে শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কই নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত বর্তমান আমেরিকান রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বারবার বলছেন, বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র ও উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে একটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে ২০০৯ সালে বর্তমান প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নত হয়েছে। বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্বার্থের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে একটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রবৃদ্ধি এবং বিনিয়োগের পাশাপাশি নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। এটা বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অফিসিয়াল বক্তব্য।

বিজ্ঞাপন

তবে অফিসিয়াল সম্পর্কের মধ্যে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক বিভিন্ন ঘটনা ঘটে চলছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের একজন উপদেষ্টা (বিশেষ সহকারী) এবং হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ডিরেক্টর রিয়ার অ্যাডমিরাল আইলিন লাউবাচার রাজনৈতিক সফরের ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে গতকাল শনিবার বিকেলে ঢাকায় এসেছেন। তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সিনিয়র প্রতিরক্ষা প্রতিনিধি দলও ছিলেন। তাদের সফরে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হবে বলে জানা গেছে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রত্যার্বাসন আলোচনার মূল বিষয় হবে। আজ রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে মার্কিন প্রতিনিধি দলের সরকারি সফর। এর আগে আইলিন লাউবাচার যখন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী ছিলেন, তখন তিনি ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ দূতাবাসে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের সাথে দেখা করেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

এর বাইরেও যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু শিগগিরই বাংলাদেশে আসছেন। বাংলাদেশও বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সফরে আসছেন এটা চমৎকার খবর। এ ক্ষেত্রে, তিনি একজন নীতিনির্ধারকের মতো। এখানে তাকে স্বাগত জানাই।’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্ক চমৎকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে, আমরা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত। তিনি (ডোনাল্ড লু) এলে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে।’ উপরন্তু আবদুল মোমেন আশা প্রকাশ করে বলেন, ডোনাল্ড লুর সফর দুই দেশের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ককে মজবুত করতে সাহায্য করবে।

তবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাছে বেশ কিছুদিন ধরেই একটি বিষয় পীড়ার কারণ। সেটি র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে কাছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন মন্তব্য করেন, ‘দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করে এমন অনেক কারণ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী এবং ভোক্তা উভয়ই। আমাদের শুধুমাত্র একটি সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই কারণ আমরা অন্যান্য ক্ষেত্রে পারষ্পরিকভাবে সংযুক্ত। আমাদের একই নৈতিকতা ও বিশ্বাস রয়েছে।’ তিনি আরও দাবি করেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরাও এটা চাই। মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং গণতন্ত্রের নামে ত্রিশ লাখ বাংলাদেশি তাদের জীবন দিয়েছেন।’

এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও বলেছেন তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক চান। হোয়াইট হাউসে বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে মোহাম্মদ ইমরানের পরিচয়পত্র গ্রহণ করার সময় তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ঢাকার সাথে তাদের দীর্ঘস্থায়ী সহযোগিতাকে স্বীকৃতি দেয় এবং গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যকে তিনি ‘আশ্চর্যজনক সাফল্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন, শরণার্থী এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তার মতো সমস্যাগুলো মোকাবিলার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। আমরা আপনার কৃতিত্বের প্রতি যত্নশীল এবং প্রত্যেকের স্বাধীনভাবে অংশ নেওয়ার এবং তাদের জাতির বৃদ্ধিতে অবদান রাখার অধিকারকে সমর্থন করি।’

লিখিত মন্তব্যে বাইডেন বলেছেন, ‘২০২২ ইউএস-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকীতে আমি বাংলাদেশের সাথে আমাদের অব্যাহত সহযোগিতা উদযাপন করতে চাই। বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রে আগত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতকে স্বাগত জানান এবং দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করতে তার সঙ্গে কাজ করার জন্য তার প্রশাসনের আগ্রহ প্রকাশ করেন। উপরন্তু, বাইডেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি মার্কিন নাগরিক থাকাকালীন সব ধরনের সহযোগিতা করবেন।

বাইডেন আরও বলেন, বাংলাদেশ সমুদ্র নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, মানবিক সহায়তা, শরণার্থী সংকট, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা এবং সন্ত্রাস দমন সংক্রান্ত বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠেছে। বাইডেনের মতে, বাংলাদেশ তার বেশিরভাগ কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছে যা বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার জন্য ভাল অবস্থানে রয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের উদারতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং এই উদ্বাস্তু ও তাদের আশ্রয়দাতা সম্প্রদায়কে সহায়তা এবং তাদের অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশকে সমর্থন করার অঙ্গীকার করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ঘোষণা করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এই মানবিক সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী, নির্ভরযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করার জন্য নিবেদিত।’ কোভিড-১৯ মহামারী সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, কোভিড-১৯ গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যানের অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী মহামারী মোকাবিলায় বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা করতে পেরে দেশটি সন্তুষ্ট। আগামী মাস এবং বছরগুলিতে যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে এমন অঙ্গিকারও তিনি করেন।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির পুনরুজ্জীবনও দুই দেশের সম্পর্কের অন্যতম অনুষঙ্গ। ২০২২ সালের প্রথম দশ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগ দ্বারা সংগৃহীত তথ্য অনুসারে, বিশ্বের বৃহত্তম পোশাক প্রস্তুতকারক চীন থেকে আমেরিকান আমদানির তুলনায় বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের জন্য আমেরিকান অর্ডার দ্রুত বাড়ছে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের অফিস অফ টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলস (ওটিএক্সএ) অনুসারে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮.৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি করেছে যা বাংলাদেশে তৈরি পোশাক আমদানির তুলনায় ৪৯ শতাংশ বেশি। ২০২১ সালে একই সময়কালের তুলনায় প্রায় ৫১% পোশাক শিপমেন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা লক্ষণীয় যে রপ্তানি যথেষ্ট উন্নতির অভিজ্ঞতা অর্জন করায় বাংলাদেশী পোশাক প্রস্তুতকারীরা আমেরিকান বাজারে একটি দৃঢ় উপস্থিতি অর্জন করছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের মর্যাদা নিশ্চিত করেছে ঢাকার আমেরিকান দূতাবাস।

বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, তিনি চলতি বছরে (২০২৩) বাংলাদেশ-মার্কিন সহযোগিতা বজায় রাখার জন্য উন্মুখ। দূতাবাসের একটি সাম্প্রতিক বিবৃতি অনুসারে, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এবং পোশাক শিল্পে মার্কিন কোম্পানিগুলি ক্রমবর্ধমানভাবে বাংলাদেশকে তাদের শীর্ষ ব্যবসায়িক ও বিনিয়োগ অংশীদারদের একটি হিসাবে তালিকাভুক্ত করছে। পিটার হাস বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সাথে আমাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ককে মূল্য দিই। বিশ্বের অষ্টম সর্বাধিক জনবহুল দেশ; মার্কিন বাণিজ্যিক আমদানিতে এর অন্তর্ভুক্তি বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পণ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করে।’

এছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি সমর্থন পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই বছরের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সময় মানবিক সহায়তার জন্য অতিরিক্ত ১৭০ মিলিয়ন ডলার অনুদান ঘোষণা করেছেন। ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গা বিপর্যয়ের জন্য ১৯০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি দেশ দান করেছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বলেছে তারা বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের অন্যত্র সরিয়ে নিতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের জনসংখ্যা, শরণার্থী ও অভিবাসন বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি জুলিয়েটা ভালস নয়েস গত মাসে বাংলাদেশ সফর করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের সাথে মার্কিন প্রশাসনের সহযোগিতা খুবই প্রশংসিত। পশ্চিমা বিশ্ব এবং যারা মানবিক কারণে সমর্থন করে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদচিহ্ন অনুসরণ করতে পারে।’

এক কথায় ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক ও যোগাযোগ ক্রমেই বাড়ছে। মানবিক, অর্থনৈতিক, জলবায়ু ও নিরাপত্তা উদ্বেগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মিত্র। ২০২২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করায় দ্বিপাক্ষিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা সম্প্রসারণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ ঢাকা এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে অনেক উচ্চ-পর্যায়ের ব্যস্ততা এবং কৌশলগত কথোপকথন করেছে। বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান আন্তঃনির্ভরশীলতার এটা একটি বড় কারণ।

(মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যম ‘দ্য সান ডেইলি’ থেকে অনুবাদ করা)

লেখক: কলামিস্ট, উন্নয়ন ও সমাজকর্মী

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের সাম্প্রতিক প্রবণতা মুক্তমত মেহজাবিন বানু

বিজ্ঞাপন

সাগরে লঘুচাপ, কমছে তাপমাত্রা
২৫ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:৩৩

ঢামেকে অভিযানে ২১ দালাল আটক
২৫ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:২০

আরো

সম্পর্কিত খবর