করোনায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা কেমন আছে?
১৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১৪:২৮
২০২০ সালের ৮ মার্চ সর্বপ্রথম বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। প্রায় দেড় বছর করোনার তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের স্বার্থের সাথে জড়িত প্রতিটি খাত। শিক্ষা, অর্থনীতি, বানিজ্য – সহ প্রতিটি খাত কমবেশ মহামারীর সময় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলো। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা প্রতিটি খাতেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অর্থনীতির পর করোকালীন সময়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বলা যায় শিক্ষা খাতকে। শিক্ষার্থীদের মাঝে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল ১৭ মার্চ ২০২০ হতে, যা পরবর্তিতে ১ বছরেরও বেশি সময় কার্যকর ছিল। করোনা সংক্রমণ তীব্র থেকে তীব্রতর হলে একপর্যায়ে সব ধরনের জনসমাগমের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। যার ফলে স্থবির হয়ে যায় জনজীবন। সরকারি চাকুরীজীবিরা মোটামুটি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও বেকায়দায় পড়ে যায় একটি বৃহত্তর অংশ। বিশেষত হতদরিদ্র ও দিনমজুরদের জন্য লকডাউন ধরা দিয়েছিলো অভিশাপ হিসেবে। লকডাউনকালীন সময়ে মিডিয়ার কল্যাণে আমরা দেখেছিলাম পেটের দায়ে শাস্তি উপেক্ষা করে মানুষ কীভাবে ঘর থেকে বের হয়েছিলো। একটি সূত্রমতে, করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশে দারিদ্রের হার বেড়ে ৪২ শতাংশে উন্নিত হয়েছিলো৷ মানুষের দুর্ভোগ দেখে সরকারের পক্ষ থেকে, বিভিন্ন দাতা সংগঠনের পক্ষ থেকে এছাড়াও ছোট-বড় নানা রাজনৈতিক দলকেই জনগণের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে। কিন্তু লকডাউনের দীর্ঘ সময়ে তা কোনোভাবেই যথেষ্ট ছিলো না। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অর্থনৈতিক সংকট প্রকটভাবে দেখা দিয়েছিলো। অনেক পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী চাকুরী হারিয়েছিলেন, কেউ হারিয়েছেন ভরণপোষণের উৎস, অনেককে আবার হতে হয়েছে একদম নিঃস্ব। পারিবারিক এই অর্থনৈতিক দুরাবস্থা সরাসরি প্রভাব ফেলেছে পরিবারের শিক্ষার্থী সদস্যদের উপর। একেতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো অপ্রতুল, তার উপর পারিবারিক অর্থনৈতিক মন্দা শিক্ষার্থীদের জন্য ছিলো মরার উপর খাঁড়ার ঘা। অনেকটা বাধ্য হয়েই হাজার হাজার অভিভাবক সন্তানের শিক্ষাজীবনের ইতি টেনে দিয়েছিলেন। ছেলে সন্তানদের ছোটখাটো বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়েছিলো, অনেক অল্পবয়সী মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছিলো।
ব্র্যাক, সেভ দ্য চিলড্রেন, ওয়ার্ল্ড ভিশন, ব্রিটিশ কাউন্সিল, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, রুম টু রিডসহ ২১টি প্রতিষ্ঠানের ‘নিরাপদে স্কুলে ফিরি’ শীর্ষক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, পুনরায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করার পর মাধ্যমিকে গড় উপস্থিতির হার ৫৭ থেকে ৬৯ শতাংশ এবং প্রাথমিকে ৬৫ থেকে ৮৬ শতাংশ। অর্থাৎ শ্রেণিভেদে মাধ্যমিকে ৪৩ থেকে ৩১ শতাংশ এবং প্রাথমিকে ৩৫ থেকে ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী করোনার পর শ্রেণিকক্ষে আসছে না।
একটি মাধ্যমিক স্কুলের কয়েকটি তথ্য-উপাত্তে চোখ রাখলেই বিষয়টি ভালোভাবে বোঝা যাবে। সিলেটের জৈন্তাপুরের শাড়িঘাট হাইস্কুলে ২০২০ সালে শিক্ষার্থী ছিল ৭৪৬ জন। এক বছর পর ২০২১ সালে বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থী কমে দাঁড়ায় ৬৮৪ জনে। বিদ্যালয়টির ১৪ জন শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে যায় । মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কাছে এই তথ্য দিয়েছিলো বিদ্যালয়টি।
ইউনেস্কো জানিয়েছিলো- মহামারী চলাকালে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে। বাংলাদেশে এমনিতেই শিক্ষার্থীদের ঝরে পরার হার অন্যতম একটি প্রধান সমস্যা ছিলো, করোনা মহামারী এসে তা দ্বিগুন করেছে।
একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, ২০২০ সালে কোভিড-১৯ সংক্রমণের পর ২০২১ সালে দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার। আর শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী। ২০২২ সালে ৪ লাখ ৬২ হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী বার্ষিক পরীক্ষা দেয়নি। এই ২ বছরে প্রাথমিক স্তরের অন্তত ৫ লাখের বেশি পরীক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় বসেনি। তবে করোনাকালে কতসংখ্যক শিক্ষার্থী প্রকৃতপক্ষে ঝরে পড়েছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো উপাত্ত জানা যায়নি।
শিক্ষার্থীদের এই ঝরে পড়ার হার দেশের ভবিষ্যতের জন্য দুঃশ্চিতার বিষয়। জনসংখ্যার ঊর্ধ্বগতির বিপরীতে শিক্ষার হার নিম্নগামী হলে তা কখনোই দেশের জন্য ভালো কোনো সংকেত বহন করে না, বরং তা একটি উন্নয়নশীল দেশের সম্ভাবনার সবগুলো চাকা স্থবির করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। উন্নয়নের দশকে দেশের এমন একটি প্রজন্ম প্রয়োজন যারা হবে শতভাগ শিক্ষিত। তাদের মেধা ও দক্ষতা পরবর্তী দশকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশের সমমর্যাদায়। কিন্তু শিক্ষাবঞ্চিত বা ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফেরানো না গেলে দেশের অগ্রগতির চলমান প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফেরানোর জন্য প্রথমেই তাদের তালিকা তৈরী করতে হবে। এ দায়িত্বটি পালন করবে দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যারা শিশুশ্রমের মতো কাজে অথবা বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হয়েছে কর্মস্থল থেকে তাদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছিলো যেসকল মেয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবারের সাথে আলোচনা করে শিক্ষার বিষয়ে তাদের উৎসাহী করে তুলতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক সহযোগিতা ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার জন্য ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ে তালিকা প্রণয়ন ও তাদের বর্তমান অবস্থা নীরিক্ষার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিয়মিত সভা, সেমিনারের মাধ্যমে শিক্ষার গুরুত্ব সবার মাঝে তুলে ধরতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই